মো. আমিনুল হক
সুনামগঞ্জ, ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ (বাসস) : সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজা। আর তাই এ সময়টাতে প্রতিমা তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন মৃৎশিল্পীরা। জেলায় অনেকেই বংশানুক্রমিক মৃৎ শিল্পী। তারা এই কাজ করেই আনন্দ পান। ইতোমধ্যে প্রতিমার অবকাঠামোগত মাটির কাজ শেষ হয়েছে। এখন কেউ দেবীকে রাঙ্গাতে, আবার কেউ নানান সাজ সজ্জায় ব্যস্ত রয়েছেন। যেন তাদের দম ফেলার সময় নেই।
সুনামগঞ্জ জেলায় দুর্গোৎসবকে সামনে রেখে বিভিন্ন এলাকায় শুরু হয়েছে পূজার চূড়ান্ত প্রস্তুতি। পাড়ায় পাড়ায় উৎসবের আমেজ। মণ্ডপে মণ্ডপে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন কারিগর ও আয়োজকরা। অভ্যর্থনা গেইট নির্মাণ, আলোকসজ্জা, প্যান্ডেল সাজানো, প্রতিমার ফিনিশিংসহ সব কাজ চলছে একই সাথে।
প্রতিটি মণ্ডপে প্রতিমা শিল্পীরা এখন শেষ মুহূর্তের কাজ করছেন। বিভিন্ন মণ্ডপে প্রতিমার ফাটল মেরামত, মাটির শাড়ি, অলংকার বসানো ও রঙ করার কাজ চলছে দ্রুতগতিতে। এদিকে প্রতিমা নির্মাণস্থলে ভিড় জমাচ্ছেন দর্শনার্থীরাও। নারী পুরুষ, শিশু-বৃদ্ধ সবার মাঝে উৎসাহ উদ্দীপনা বিরাজ করছে। কেউ ছবি তুলছেন, কেউ ভিডিও করছেন, আবার কেউবা দাঁড়িয়ে থেকে প্রতিমা গড়ার শিল্পকর্ম দেখে মুগ্ধ হচ্ছেন।
মোহনগঞ্জের তিতলি ইউনিয়নের রঘুরামপুরের বাসিন্দা প্রতিমা শিল্পী সুষেন পাল (৩৮) এর সাথে কথা হলে তিনি বলেন, আমরা বংশপরম্পরায় মায়ের প্রতিমা তৈরি করে আসছি। মা আমাকে দিয়ে এই কাজ করাচ্ছেন মনে করেই কাজ করি। এটা আমার আবেগের জায়গা। ভক্তদের মাঝে মাকে পরিপূর্ণভাবে নিয়ে আসাই আমার প্রধান কাজ। মায়ের প্রতিমা দেখে ভক্ত ও দর্শনার্থীরা যেন মুগ্ধ হয়, সে জন্য মনের মাধুরী দিয়ে প্রতিমা তৈরি করি। তিনি বলেন, আমার পুর্ব পুরুষের হাত ধরে আমি ছোটবেলা থেকেই এ কাজ করছি। প্রতিমা তৈরি করেই আমার সংসার চলে।
তিনি জানান, আমার বড় ছেলে সূর্যও (১৫) এবার আমাকে সহযোগিতা করছে। সূর্য আগে বাড়িতে থেকেই সাহায্য করতো। এখন ও পড়াশোনা করছে, তবে ভবিষ্যতে সে কী করবে তা সে নিজেই ঠিক করবে। মন চাইলে অন্য কাজ করেও মায়ের প্রতিমা তৈরি করতে পারে। আমার ছোট ছেলে রুদ্র (৭) প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ছে। পড়াশোনার পাশাপাশি প্রতিমা শিল্পের কাজে তারও আগ্রহ রয়েছে। তিনি আরও জানান, ইতোমধ্যে তিনটি প্রতিমার রঙ করা শেষ করেছেন তিনি। ষষ্ঠী পর্যন্ত প্রতিমার কাজ চলবে। তবে প্রতিদিনই ভক্ত ও দর্শনার্থীরা প্রতিমা দেখতে আসছেন। রঙের কাজ চলার সময় ভিড় বেশি হয়, সেটাই আমাদের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি।
এ বছর জেলা শহরের নবীনগর, ষোলঘর, শান্তিবাগ, মধ্যবাজার ও গৌরারংসহ মোট ৯ টি পূজামণ্ডপের প্রতিমা তৈরির কাজ করছেন বলে জানান তিনি। গত বছর দশটি মণ্ডপে প্রতিমা তৈরি করেছিলেন। এবছর খরচ বেড়ে যাওয়ায় কাজ করা কঠিন হয়ে পড়ছে।
সুতা, দড়ি, পাট, বাঁশসহ উপকরণের দাম এখন দ্বিগুণ। কিন্তু মণ্ডপে কমিটির লোকজন আগের দামেই কাজ করাতে চান। কিন্তু খরচ বেড়ে যাওয়ায় লাভ তেমন থাকে না। তবে বাপ-দাদারা করে গেছেন, তাই আমিও করছি। এবার বিশ হাজার থেকে পঁয়তাল্লিশ হাজার টাকার প্রতিমা নির্মাণের কাজ করছি। তিনি বলেন, প্রায় এক মাস আগে থেকেই প্রতিমার কাজ শুরু করেছি। প্রতিমা তৈরিতে নির্দিষ্ট কিছু ডিজাইন থাকে, তবে অনেক সময় মণ্ডপ কমিটির পক্ষ থেকেও ডিজাইন দেওয়া হয়। এক কাঠামো, তিন কাঠামো ও পাঁচ কাঠামোর প্রতিমা তৈরি হয়। এ বছর সবচেয়ে বেশি চাহিদা তিন কাঠামোর প্রতিমার। বিশেষ করে মাটির শাড়ি পড়ানো প্রতিমার কাজ বেশি করছি।
কারিগরের কাকাতো ভাই সুব্রত পাল (৩০) বলেন, আমরা ছোট থেকেই এই কাজ দেখে আসছি। প্রতিমা তৈরি করে আনন্দ পাই। ভক্তদের মাঝে মাকে নিয়ে আসতে পেরে মনে খুব শান্তি পাই।
ফ্রেন্ডস স্টাফ সার্বজনীন পূজা কমিটির সাবেক সভাপতি জগদীশ বণিক জানান, প্রতিমা নির্মাণ শুধু একটি শিল্প নয়, এর সাথে পারিবারিক ঐতিহ্য ও ভক্তি জড়িয়ে আছে। আমরা প্রায় দশ বছর ধরে সুষেনকেই দিয়ে প্রতিমা নির্মাণ করাই।
উৎস সংঘ সার্বজনীন দুর্গাপূজা কমিটির সভাপতি সুভাস চন্দ্র দাস ও সাধারণ সম্পাদক কৃষাণ দাস বলেন, সুষেন দীর্ঘদিন ধরে দক্ষ হাতে প্রতিমা তৈরি করে আসছেন। এ বছরও মনোমুগ্ধকর প্রতিমা তৈরি করছেন। ভক্ত ও দর্শনার্থীরা প্রতিমা দেখে মুগ্ধ হবেন। এবছর প্রতিটি মণ্ডপে সিসি ক্যামেরা স্থাপনসহ নিরাপত্তার ব্যবস্থা নেওয়া হবে।