বাসস
  ০৭ জানুয়ারি ২০২৫, ১৭:২৬
আপডেট : ০৭ জানুয়ারি ২০২৫, ২০:০৭

জাস্টিন ট্রুডো : উত্থান ও উত্তরাধিকার

কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো। ছবি : সংগৃহীত

হারুন আল নাসিফ

ঢাকা, ৭ জানুয়ারি, ২০২৫ (বাসস) : কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো ৬ জানুয়ারি সোমবার রাজধানী অটোয়ায় এক সংবাদ সম্মেলনে লিবারেল পার্টির প্রধান পদ থেকে তার পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছেন।

তিনি জানান, দলের নতুন নেতা নির্বাচিত না হওয়া পর্যন্ত তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। সাম্প্রতিক সময়ে খাদ্য ও আবাসনের ক্রমবর্ধমান ব্যয় এবং অভিবাসন ইস্যুতে ভোটারদের মধ্যে অসন্তোষ বৃদ্ধি পায়, যা তার জনপ্রিয়তাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। এ পরিস্থিতিতে, লিবারেল পার্টির অভ্যন্তরীণ লড়াই এবং জনমত জরিপে নেতিবাচক ফলাফলের পরিপ্রেক্ষিতে ট্রুডো এই সিদ্ধান্ত নেন।

জাস্টিন ট্রুডো কানাডার ২৩তম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আধুনিক রাজনীতিতে এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। ২০১৫ সালে ক্ষমতায় এসে তিনি শুধু একটি রাজনৈতিক পরিবর্তনের সূচনা করেননি, বরং কানাডার সামাজিক ও অর্থনৈতিক কাঠামোকেও নতুনভাবে গড়ে তোলার চেষ্টা করেছেন। তার উত্থান এবং উত্তরাধিকার একসঙ্গে বিবেচনা করলে একটি প্রগতিশীল,অন্তর্ভুক্তিমূলক ও মানবিক নেতৃত্বের প্রতিচ্ছবি দেখা যায়।

উত্থান: এক উত্তরাধিকার থেকে নেতৃত্বে

জাস্টিন ট্রুডো ১৯৭১ সালের ২৫ ডিসেম্বর মন্ট্রিয়লে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন কানাডার অন্যতম প্রভাবশালী নেতা পিয়ের এলিয়ট ট্রুডোর পুত্র। এমন একটি পরিবারে বেড়ে ওঠা,যেখানে রাজনীতি এবং নেতৃত্ব ছিল জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, ট্রুডো ছোটবেলা থেকেই সমাজ পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখেছিলেন।

শিক্ষকতা দিয়ে তার পেশাগত জীবন শুরু হলেও, রাজনীতিতে প্রবেশের জন্য ২০০৮ সাল ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ বছর। তিনি মন্ট্রিয়লের পাপিনো নির্বাচনী এলাকা থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এর পর দ্রুতই তিনি একজন উদারনৈতিক এবং তরুণদের প্রিয় নেতা হয়ে ওঠেন। ২০১৩ সালে তিনি লিবারেল পার্টির নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। তার নেতৃত্বে, ২০১৫ সালের নির্বাচনে লিবারেল পার্টি ঐতিহাসিক বিজয় অর্জন করে এবং ট্রুডো প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেন।

উত্তরাধিকার: প্রগতিশীল নেতৃত্বের প্রতীক

অন্তর্ভুক্তিমূলক নেতৃত্ব

ট্রুডো তার নেতৃত্বে সমতা এবং বৈচিত্র্যের প্রতি যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তা তার উত্তরাধিকারের একটি বড় অংশ। তার মন্ত্রিসভায় প্রথমবারের মতো লিঙ্গ সমতা নিশ্চিত করা হয়, যেখানে পুরুষ এবং নারীর সমান অংশগ্রহণ ছিল। এছাড়াও তিনি এলজিবিটিকিউ+ সম্প্রদায়ের অধিকারের পক্ষে জোরালো ভূমিকা পালন করেছেন।

জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াই

ট্রুডো পরিবেশ সুরক্ষায় তার প্রতিশ্রুতি বজায় রেখে প্যারিস জলবায়ু চুক্তিতে কানাডার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করেন। তিনি কার্বন ট্যাক্স প্রবর্তনের মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের চেষ্টা করেন। যদিও কিছু ক্ষেত্রে তার পরিবেশ নীতির দ্বৈততা সমালোচিত হয়েছে, তবে তার পদক্ষেপগুলো বৈশ্বিক পর্যায়ে কানাডার অবস্থানকে দৃঢ় করেছে।

আদিবাসী জনগণের অধিকারে অগ্রগতি

কানাডার আদিবাসী জনগণের অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠায় ট্রুডো কাজ করেছেন। ‘ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশন’-এর সুপারিশ বাস্তবায়নে তার উদ্যোগ এবং আদিবাসী সম্প্রদায়ের মৌলিক চাহিদা পূরণে বিনিয়োগ তার নেতৃত্বের গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সমাজে সাম্য

ট্রুডোর অর্থনৈতিক নীতিগুলো মধ্যবিত্ত শ্রেণির উপর বিশেষভাবে কেন্দ্রীভূত ছিল। তিনি কর হ্রাস, পরিবার ও শিশু কল্যাণে বিনিয়োগ, এবং কর্মসংস্থান বৃদ্ধিতে মনোযোগ দেন। তার সময়ে বেকারত্বের হার উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পায়, যা কানাডার অর্থনীতিতে একটি ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।

আন্তর্জাতিক নেতৃত্ব

ট্রুডো আন্তর্জাতিক মঞ্চে কানাডার অবস্থানকে শক্তিশালী করেছেন। তিনি জাতিসংঘ, জি৭, এবং জি২০-এর মতো ফোরামে কানাডার ভূমিকা সুদৃঢ় করেন। বিশেষত শরণার্থী গ্রহণে তার নেতৃত্ব এবং মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি বৈশ্বিক প্রগতিশীল নেতৃত্বের উদাহরণ সৃষ্টি করেছে।

বিতর্ক ও সীমাবদ্ধতা

ট্রুডোর শাসনামল সমালোচনামুক্ত ছিল না। ‘স্নাকাভাল স্ক্যান্ডাল’ এবং কিছু নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পূরণে ব্যর্থতা তার জনপ্রিয়তাকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। এছাড়া, কিছু অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত নীতির দ্বৈততা তার নৈতিক অবস্থানকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। তবে, এসব বিতর্ক তার বৃহত্তর উত্তরাধিকারের গুরুত্বকে ম্লান করতে পারেনি।

উত্তরাধিকার: দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব

জাস্টিন ট্রুডোর উত্তরাধিকার শুধুমাত্র তার সময়ের নয়; এটি কানাডার ভবিষ্যত রাজনীতির জন্য একটি মডেল হয়ে থাকবে। তিনি একটি উদার, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং দায়িত্বশীল সমাজ গঠনের যে পথ দেখিয়েছেন, তা তরুণ প্রজন্মের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস। তার নেতৃত্বে কানাডা প্রগতিশীল নীতির একটি শক্তিশালী দৃষ্টান্ত হয়ে উঠেছে, যা বিশ্বজুড়ে উদারনৈতিক রাজনীতির সমর্থকদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা।

জাস্টিন ট্রুডোর উত্থান এবং উত্তরাধিকার একটি প্রগতিশীল, মানবিক এবং দায়িত্বশীল নেতৃত্বের গল্প। তার নেতৃত্বে কানাডা শুধু একটি উন্নত রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেনি; বরং বৈশ্বিক রাজনীতিতে এক প্রগতিশীল ভূমিকা রেখেছে। তার উত্তরাধিকার ভবিষ্যতের কানাডার সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক অগ্রগতির ভিত্তি হিসেবে দীর্ঘকাল ধরে বিদ্যমান থাকবে।