আব্বাছ হোসেন
লক্ষ্মীপুর, ১৪ আগস্ট ২০২৫(বাসস): জেলার রামগতি উপজেলার বাসিন্দাদের স্বতঃস্ফূর্ত উদ্যোগে ভুলুয়া নদী খননে ব্যাপক সাড়া পড়েছে। ২০ দিনে প্রায় ২.৫ কিলোমিটার নদী খনন সম্পন্ন হয়েছে। এলাকাবাসীর সহযোগিতার টাকায় প্রাথমিকভাবে কাজ শুরু করা হলেও লক্ষ্মীপুর জেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত ৪০ কিলোমিটার নদী খননে প্রয়োজন প্রায় ৩০ কোটি টাকা। তা বলে থেমে নেই এলাকাবাসী। তারা কাজ শুরু করেছেন। পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) কর্তৃপক্ষ তাদের সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছে। এটাই তাদের সান্ত্বনা।
নদী খনন কাজের উদ্যোক্তা শফিকুল ইসলাম বাসসকে বলেন, জনগণ নিজ নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী টাকা দিচ্ছে। অনেকে আবার মসজিদ ভিত্তিক মাইকিং করেও টাকা তুলছেন। মানুষের কাছ থেকে পাওয়া টাকা দিয়ে নদী খননের কাজ চালিয়ে নেওয়া হচ্ছে।
তিনি বলেন, এলাকাবাসীর টাকা দিয়ে ভুলুয়া নদী খনন করা হচ্ছে। কয়েক লাখ টাকা তোলাও হয়েছে। কিন্তু দরকার কোটি টাকা। কোটি টাকা দেওয়ার সামর্থ্য এই এলাকার মানুষের নেই। পাউবোর কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। তারা এলাকাবাসীর উদ্যোগের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে সার্বিক সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন।
স্থানীয়রা জানান, জনগণের কাছ থেকে যে টাকা তোলা হয়েছে, সে টাকা দিয়ে কাজ হচ্ছে। তবে সরকারিভাবে বরাদ্দ দিয়ে নদী খননের উদ্যোগ নিলে এ অঞ্চলের মানুষের দুর্ভোগ ও দুর্দশা কমে যাবে। চাষাবাদেও কোনো সমস্যা থাকবে না।
সরেজমিনে দেখা যায়, রামগতি উপজেলার চর পোড়াগাছা ইউনিয়নের আজাদনগর স্টিল ব্রিজ এলাকা থেকে এক্সকেভেটর (খননযন্ত্র) দিয়ে নদী খননের কাজ চলছে। সেখানে কয়েকজন শ্রমিক বিনা পারিশ্রমিকে খনন কাজে সহযোগিতা করছেন।
খননকাজে নিয়োজিত জাহাঙ্গীর আলম, মিজানুর রহমান পিংকু ও কামাল উদ্দিন আর্থিক সহযোগিতা করতে না পারলেও স্বেচ্ছাশ্রম দিয়ে নদী খননে সহযোগিতা করছেন। বাসসের সাথে আলাপকালে তারা বলেন, নদী খননকাজে সহযোগিতা করতে পেরে অনেক ভালো লাগছে। মনে হচ্ছে ঈদের আনন্দ।
এই অংশের ভুলুয়া নদীর কোথাও পলি জমে ভরাট হয়ে গেছে। কোথাও আবার অবৈধ বাঁধ দিয়ে বাধাগ্রস্ত করা হয়েছে নদীর স্বাভাবিক পানিপ্রবাহ। ফলে টানা বৃষ্টি বা মেঘনার অস্বাভাবিক জোয়ার হলেই বাড়িঘরে পানি উঠে।
তলিয়ে যায় পুরো গ্রাম। নদীর গভীরতা কম হওয়ায় পানি নামতে সময় লাগে। ফলে এলাকাবাসীকে দিনের পর দিন পানিবন্দি থাকতে হয়। চরম দুর্ভোগে দিন পার করতে হয়। এ কারণেই এলাকাবাসী নদী খননের উদ্যোগ নেয়।
গত ২৪ জুলাই ভুলুয়া নদীর বাঁধ অপসারণ ও খনন শুরু হয়। ২০ দিনে প্রায় আড়াই কিলোমিটার নদী খনন হয়েছে। নদীতে এখন পানির স্রোত বইছে। উঁচু এলাকা থেকে পানি নামতে শুরু করেছে। এইভাবে যদি নদী খনন অব্যাহত থাকে, তাহলে নদীর হারানো ঐতিহ্য ফিরে আসবে বলে আশা করেন এলাকাবাসী।
রামগতির বাসিন্দা সোয়াব খন্দকার বাসসকে বলেন, গত ২০ বছর ধরে অনেকটা মৃতপ্রায় ভুলুয়া নদী। দূষণ আর দখলের কারণে নদীর ঐতিহ্য হারাতে বসেছে। বর্তমানে এ নদীর খনন চলছে স্থানীয় কৃষক ও বাসিন্দাদের অর্থায়নে।
তিনি জানান, যখন সময় পান তখনই এসে সময় দেন। কেউ কেউ বাড়ি বাড়ি গিয়ে টাকা তোলেন। ওই টাকা দিয়ে খনন কাজ করা হচ্ছে। এটি একটি ভালো উদ্যোগ। তিনি নদী খনন কাজ সম্পন্ন করতে সরকারি সহযোগিতার দাবি জানান।
নদী পারের বাসিন্দা কোহিনুর আক্তার বাসসকে বলেন, টানা বৃষ্টি ও নদীর জোয়ারের পানিতে গত ১ মাসের বেশি সময় ধরে পানিতে ভাসছি। নদী ভরাট থাকায় পানি নামছে না। কিন্তু এখন নদী খনন করায় ঘর থেকে পানি নেমে গেছে। অনেক ভালো লাগছে। এখন চাষাবাদ করতেও সমস্যা হবেনা। একই কথা বলেন, আজাদ নগরের বাসিন্দা আবুল কালাম, নুরুল আমিন ও আবদুল খালেকসহ আরো অনেকে।
পাউবো লক্ষ্মীপুর জেলা কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, ৭৬ কিলোমিটার দীর্ঘ ভুলুয়া নদীর প্রস্থ স্থানভেদে ১০০ থেকে ১৭৬ মিটার। এটি লক্ষ্মীপুরের রামগতি, কমলনগর ও সদর উপজেলা এবং নোয়াখালীর সদর ও সুবর্ণচর উপজেলা হয়ে মেঘনা নদীতে মিলিত হয়েছে। এর মধ্যে লক্ষ্মীপুর জেলা অংশে নদী রয়েছে ৪০ কিলোমিটার। নদীটি লক্ষ্মীপুর ও নোয়াখালী জেলার ২০টি ইউনিয়নকে সংযুক্ত করেছে। আর এসব এলাকা থেকে একমাত্র এই নদীটি দিয়েই পানি চলে যায় মেঘনায়। নদীটি ভরাট হয়ে যাওয়ায় ও বাঁধ দেওয়ার কারণে এলাকায় পানি নিষ্কাশন বাধাগ্রস্ত হচ্ছিল।
এতে গত বছরের আগস্ট মাসে লক্ষ্মীপুরে বন্যা ও জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। এলাকার ঘরবাড়ি, রাস্তা, ফসলের মাঠ ডুবে যাওয়ায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
পাউবোর লক্ষ্মীপুরের নির্বাহী প্রকৌশলী নাহিদ-উজ-জামান খান বাসসকে বলেন, ‘ভুলুয়া নদীর লক্ষ্মীপুর অংশে খননের জন্য মন্ত্রাণালয়ে একটি প্রকল্প প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। এর প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ৩০ কোটি টাকা। প্রকল্পটি অনুমোদন পেলে খনন কাজ শুরু করা হবে।’
তিনি বলেন, ‘এলাকাবাসীর উদ্যোগে যেটুকু করা হচ্ছে, তার সাথে পানি উন্নয়ন বোর্ডের সহযোগিতা রয়েছে।
প্রাথমিকভাবে এই কাজটি করায় পানির প্রবাহ বাড়ছে। পানি নেমে যাচ্ছে। আমরা চেষ্টা করব প্রশাসনিক সহযোগিতার মাধ্যমে যত দ্রুত সম্ভব উদ্যোগটিকে আরও কার্যকর ও টেকসই করতে।’