ভোলায় মেঘনা নদীর তীব্র ভাঙন, অসহায় নদী পাড়ের মানুষ

বাসস
প্রকাশ: ২৭ জুন ২০২৫, ১৬:৩০
ছবি : বাসস

প্রতিবেদন: আল-আমিন শাহরিয়ার

ভোলা, ২৭ জুন, ২০২৫ (বাসস): উজানের পানির চাপে ভোলার মেঘনায় নদী তীব্র ভাঙন শুরু হয়েছে। এরই মধ্যে বিলীন হয়ে গেছে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক ঘরবাড়ি,ফসলি জমি'সহ বিভিন্ন স্থাপনা। হুমকির মুখে পড়েছে মাছ ঘাট, শত শত ঘরবাড়ি,বাজার ও মসজিদসহ বহু মাছের ঘের। এতেকরে অসহায় হয়ে পড়েছে নদী পাড়ের মানুষ।

দেশের বৃহত্তম এই দ্বীপজেলাকে রক্ষার জন্য বছরের পর বছর কয়েক হাজার কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়ন করেও ঠেকানো যায়নি এ ভাঙন। নদী শাসনের মাধ্যমে স্থায়ী প্রকল্প গ্রহণ না করে পানি উন্নয়ন বোর্ড শুধু জিও ব্যাগ ডাম্পিং এবং সি.সি.ব্লক দ্বারা নদী তীর আচ্ছাদিত করার মতো অস্থায়ী প্রকল্পেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। কিন্তু সেই সি.সি.ব্লক আর জিও ব্যাগেও সুফল মিলছে না। স্থানীয়দের মতে,এ ধরনের অপরিকল্পিত প্রকল্প নিয়ে শুধু রাষ্ট্রের হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট হচ্ছ,কার্যকর কিছুই হচ্ছে না। ভাঙনের ধারাবাহিকতায় দ্বীপজেলা ভোলার মানচিত্র থেকে গত ৫০ বছরে ২৫৭ বর্গকিলোমিটার জনপদ হারিয়ে গেছে ।ফলে ভাঙাগড়ার খেলায় ছোট হয়ে আসছে ভোলা,বদলে যাচ্ছে দৃশ্যপট।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত কি পরিমাণ মানুষ যে নদী ভাঙনের শিকার হয়ে নিঃস্ব হয়েছে তার কোন তালিকা নেই স্থানীয় প্রশাসন কিংবা পাউবোর কাছে।

পাউবো সূত্র জানায় , ৩ হাজার ৪৪৮ বর্গকিলোমিটার আয়তনের ভোলা থেকে গত ৫০ বছরে ২৫৭ বর্গ কিলোমিটার এলাকা মেঘনা নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। প্রতি বছরই ভেঙে যাচ্ছে ১ থেকে ২ বর্গকিলোমিটার এলাকা। যদিও ভাঙন বন্ধে গৃহীত হচ্ছে ছোট-বড় স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদি প্রকল্প কিন্তু তাতে আশানুরূপ ফল মিলছে না।

বিশেষজ্ঞদের মতে, ভাঙন বন্ধে স্থায়ী পদ্ধতি হচ্ছে-নদী শাসন করে প্রকল্প গ্রহণ করা। এ ধরনের প্রকল্পের মাধ্যমে পদ্মা ও যমুনা'সহ  বিভিন্ন সেতু এলাকার ভাঙন বন্ধের নজির  রয়েছে। কিন্তু ভোলায় নদী শাসনের মতো তেমন প্রকল্প নেই। আছে শুধু জিও ব্যাগ ডাম্পিং এবং সি.সি.ব্লক দ্বারা নদী তীর আচ্ছাদিত করার মতো অস্থায়ী প্রকল্পই বার বার নেয়া হচ্ছে। ।

আবার এ ভাঙনের মধ্য দিয়ে মেঘনার বিভিন্ন পয়েন্ট থেকে ড্রেজার দিয়ে অপরিকল্পিতভাবে বালু উত্তোলনের কারণে ভোলার ইলিশা, রাজাপুর, কাচিয়া, মাঝেরচর মদনপুর এবং শিবপুর ইউনিয়নে ব্যাপক ভাঙন দেখা দিয়েছে। ইতিমধ্যে এসব এলাকাগুলোতে ঘর-বাড়ি, রাস্তাঘাট ও ফসলি জমি হারিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছে কয়েক লক্ষাধিক মানুষ। 

সরেজমিনে দেখা গেছে, ভোলা সংলগ্ন মেঘনায় অপরিকল্পিতভাবে বালু উত্তোলন এবং সাম্প্রতিককালের ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে সৃষ্ট প্রবল স্রোতে শস্যভাণ্ডার খ্যাত ভোলার মেঘনা নদী বেষ্টিত সদর উপজেলার কাচিয়া ইউনিয়নের বিচ্ছিন্ন মাঝের চর এলাকায় প্রবল ভাঙন দেখা দিয়েছে। গত ১৫ দিনের ভাঙনে সেখানে গৃহহীন হয়ে পড়েছে প্রায় দুই শতাধিক পরিবার। ভেঙে গেছে একটি বাজার, মসজিদ, ২টি মক্তব, হেফজ মাদ্রাসাসহ বেশ কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। 

ভাঙনের তীব্রতা এতোই বৃদ্ধি পেয়েছে যে অনেক পরিবার তাদের ঘরবাড়ি সরিয়ে অন্যত্র নেওয়ার সময়ও পাচ্ছেন না। যারা ভাঙন থেকে বসতঘর রক্ষা করতে পারেননি, তারা নিঃস্ব হয়ে নদী পাড়ে বসে আর্তনাদ করছেন। চোখের পলকেই মেঘনা নদীতে বাড়ি ঘর ও ফসলি জমি বিলীন হয়ে যাওয়ায় দিশেহারা হয়ে পড়েছে স্থানীয়রা। ফলে নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছে এই চরে বসবাসকারী দুই গ্রামের প্রায় ৮ হাজার মানুষের। তবে নদী ভাঙনরোধে ভোলা পানি উন্নয়ন বোর্ড কার্যকরী কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ না করায় স্থানীয়দের মাঝে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে ।

কাচিয়া চরের বাসিন্দা আবুল হোসেন মাঝি বলেন, নদী আগে অনেক দূরে ছিল। এখন খুব জোরেশোরে ভাঙছে। নদী আমাগো বাড়িঘর ভাইঙা নিয়া গেছে। এখন আমরা কই যামু?

অপর বাসিন্দা আরজন আলী বলেন, ভাঙতে ভাঙতে নদী আমাগো ঘরের লগে আইস্যা গেছে। যহন-তহন আমাগো ঘরবাড়ি ভাইঙ্গা লইয়া যাইতে পারে।

স্থানীয়রা বলেন,নদী এই পর্যন্ত আমাদের ৭/৮বার ভাঙছে। ভাঙনের শিকার এসব মানুষ সরকারের কাছে শুধু মাথা গোজার ঠাঁই চান।

সম্প্রতি ভাঙন কবলিত এলাকাগুলো পরিদর্শন করেছেন, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব এনামুল হক। তিনি জেলা সদর ভোলার ভাঙ্গনকবলিত শিবপুর ইউনিয়নের মাছঘাট ও স্লুইজগেট এলাকাও পরিদর্শন করেন। এ সময় তার সঙ্গে ছিলেন, ভোলার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মো. মিজানুর রহমান ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রকৌশলী মো. হাসানুজ্জামান।

স্থানীয়রা জানান, নদীর ভাঙনের তীব্রতা বেড়েছে। বেড়ীবাঁধ ভেঙে গেলে অতি জোঁয়ার ও স্রোতে আমরা ভেসে যাবো। বর্তমানে এ বাঁধ থেকে নদী মাত্র ১০০ ফুট দূরে রয়েছে। বাঁধের বাইরে মেঘনার কুল ঘেঁষে বসবাসরত পরিবারগুলো ভাঙনের শিকার হয়ে অন্যত্রে চলে গেছে। কেউবা ঠাঁই নিয়েছেন বেড়িবাঁধের পাশে। কিন্তু অচিরেই এই বেড়িবাঁধও ভেঙে যাওয়ার পথে।

অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) গণমাধ্যমকে জানান,জেলা সদর উপজেলার শিবপুর ইউনিয়নের  স্লুইসগেট পয়েন্টে যে মাছ ঘাট রয়েছে, সেখান থেকে প্রায় ৫ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে এখন ভাঙন চলমান রয়েছে। নদী ভাঙন রক্ষায় যে প্রকল্প পাঠিয়েছি তা অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। এছাড়া ভোলা খাল সচল রাখতে খাল খনন ও প্রশস্তকরণ এবং স্লুইস গেটটি  আরও আধুনিক করতে ৬৩০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প পাঠানো হয়েছে, এটি পাশ হলে কাজ শুরু করা হবে।

জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ড ডিভিশন-০১ এর ভারপ্রাপ্ত তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. হাসানুজ্জামান বলেন,শিবপুর ইউনিয়নটি মেঘনা নদীর তীরবর্তী। বেড়ীবাঁধ থেকে নদীর দূরত্ব ৬০ থেকে ৭০ মিটার। বর্তমানে এ এলাকায় নদী ভাঙন দেখা দিয়েছে। নদী ভাঙন রোধে ৪ কিলোমিটার নদীর তীর সংরক্ষণ এবং ৬ কিলোমিটার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ নির্মাণের জন্য পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ে প্রকল্প পাঠানো হয়েছে। এর মধ্যে ২৬০ মিটার দৈর্ঘ্য নদী ভাঙনরোধে কাজ শুরু করে দিয়েছি। এর মাধ্যমে আমরা সাময়িক ভাবে ভাঙন রোধ করতে পারবো।

তিনি জানান, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সচিব নদী ভাঙন এলাকা পরিদর্শন করে ভাঙন রোধের গুরুত্ব অনুভব করেছেন। এ জন্য একটি প্রকল্প প্রস্তুত করে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো  হয়েছে,এটি অনুমোদন হলে নদী ভাঙন সম্পূর্ণ রোধ করা সম্ভব হবে বলে আশা প্রকাশ করেন জেলা প্রশাসনের এ কর্মকর্তা।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
পবিত্র হজ পালন শেষে ৫৪,৩৯৭ জন হাজী দেশে ফিরেছেন
নির্বাচনের আগে মৌলিক সংস্কারগুলো বাস্তবায়ন করতে হবে : গোলাম পরওয়ার
মাদারীপুরে পৌরসভার উদ্যোগে খাল খনন 
সাম্য ও সম্প্রীতির শহর চট্টগ্রামে ঐক্যই আমাদের শক্তি : চসিক মেয়র
পাবনায় নদীতে ডুবে দুই শিশুর মৃত্যু 
কুলাউড়ায় হত্যার শিকার আনজুমের বাড়িতে জামায়াতের আমির 
রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রে অভিযান পরিচালনা করেছে দুদক 
বাংলাদেশ ও জাপানের মধ্যে ৬৩০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের ঋণচুক্তি স্বাক্ষরিত
জাতিসংঘ উন্নয়ন সম্মেলন : ট্রাম্পের সহায়তা কর্তনের প্রভাব কাটাতে সহায়তা আহ্বান
বিএফআইডিসিকে লাভজনক প্রতিষ্ঠানে রূপান্তর করা হবে: সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান
১০