হারিয়ে যেতে বসেছে ভ্রাম্যমাণ নরসুন্দর পেশা

বাসস
প্রকাশ: ২৭ জুন ২০২৫, ১৮:২১
ছবি : বাসস

প্রতিবেদক: বিপুল ইসলাম

লালমনিরহাট, ২৭ জুন, ২০২৫ (বাসস) : সময়ের বিবর্তনে বদলে গেছে মানুষের জীবনযাপন ও পেশার ধরন। আধুনিকতার ঢেউয়ে গ্রামবাংলার বহু চেনা পেশা আজ হারিয়ে যেতে বসেছে। তেমনই এক পেশা ‘ভ্রাম্যমাণ নরসুন্দর’। যারা একসময় হাটবাজারে কাঠের বাক্স, পিঁড়ি ও সরঞ্জাম নিয়ে হাজির হতেন। ক্ষুর, কাঁচি, আয়না, চিরুনি আর সাবান হাতে তারা শিশু থেকে বৃদ্ধ সবার চুল-দাড়ি কেটে জীবিকা নির্বাহ করতেন। তাদের দেখা আজ আর তেমন মেলে না। 

একসময় গ্রামীণ জীবনের অপরিহার্য অংশ হলেও বর্তমানে এই পেশার অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া দায়। শহর তো বটেই, গ্রামাঞ্চলেও আধুনিক সেলুনের প্রচলন হওয়ায় হারিয়ে যেতে বসেছে ভ্রাম্যমাণ নরসুন্দরদের পদচিহ্ন। আধুনিকতার ভিড়ে এখনও কিছু প্রান্তিক নরসুন্দরের দেখা মেলে গ্রামীণ হাটগুলোতে। লালমনিরহাট সদরের বড়বাড়ী হাটে দেখা নরসুন্দর বাবুল চন্দ্র শীল-এর সাথে। খোলা আকাশের নিচে কাঠের পিঁড়িতে বসিয়ে চুল-দাড়ি কাটেন ঠিক আগের মতোই।

দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে এই পেশায় যুক্ত বাবুল চন্দ্র শীল বাসসের সাথে আলাপকালে বলেন, ‘আগে দিনে যা আয় হতো, তা দিয়ে সংসার চালানো যেতো। এখন সারাদিন খেটে আয় হয় ৩৫০-৪৫০ টাকা। এ আয় দিয়ে সংসার চালানো কঠিন। দোকান ভাড়া নেওয়ারও সামর্থ্য নেই। সরকারের সহায়তা পেলে একটি দোকান ভাড়া নিয়ে নিজের অবস্থার উন্নতি করতে পারতাম।’ 

প্রবীণ নরসুন্দর পরিমল চন্দ্র শীল বলেন, ‘পথের পাশে বসেই পার করেছি ৩০-৪০ বছর। এই পেশাতেই জীবনের অনেকটা সময় কাটিয়ে দিলাম। আয় খুব একটা বাড়েনি, অথচ ব্যয় বেড়েছে বহুগুণ।’

ভ্রাম্যমাণ নরসুন্দরদের প্রধান গ্রাহক সমাজের নিম্ন আয়ের মানুষ। যেখানে আধুনিক সেলুনে চুল কাটা ও দাড়ি শেভের জন্য গুনতে হয় ১০০ থেকে ২০০ টাকা। সেখানে ভ্রাম্যমাণ নরসুন্দরদের কাছে মাত্র ৩০ থেকে ৫০ টাকায় চুল ও দাড়ি কাটানো যায়। কখনও কখনও আরও কমে পাওয়া যায়। তাই রিকশাচালক, দিনমজুরসহ নিম্নআয়ের শ্রমজীবীরা এদের ওপরই ভরসা করেন।

চুল কাটাতে আসা গ্রাহক মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘আধুনিক সেলুনে যাওয়ার সামর্থ্য আমাদের নেই। তাই আমরা এই ভ্রাম্যমাণ নরসুন্দরদের কাছেই চুল কাটাই।’

আফসার হোসেন বলেন,  ‘ছোটবেলায় বাবার সঙ্গে হাটে গিয়ে চুল কাটাতাম। এখনও সেই অভ্যাস রয়ে গেছে। তবে নতুন প্রজন্ম হয়ত এসব আর দেখতে পাবে না।’

বড়বাড়ী হাট নরসুন্দর সমিতির সাধারণ সম্পাদক সাধন চন্দ্র শীল বলেন, ‘আগের মতো কাজ পায় না ভ্রাম্যমাণ এই নরসুন্দররা। এই পেশা টিকিয়ে রাখতে সরকারি পৃষ্টপোষকতা প্রয়োজন। সহযোগিতা  পেলে  দোকান করে সম্মানজনকভাবে পেশাটি চালিয়ে যেতে পারবে তারা।’

সমিতির সভাপতি কাজল চন্দ্র শীল বলেন, ‘আমরা শুধু নরসুন্দর নই, আমরা বাংলার গ্রামীণ সংস্কৃতির বাহক। অথচ আমরা আজ অবহেলিত।’

এ প্রসঙ্গে লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক এইচ এম রকিব হায়দার বলেন, ‘আধুনিকতার ছোঁয়ায় ভ্রাম্যমাণ নরসুন্দরদের পেশা হারিয়ে যাচ্ছে। তবে কেউ যদি পেশাগত বা সামাজিক কারণে পিছিয়ে পড়ে এবং সহযোগিতা চান, তাহলে প্রশাসনের পক্ষ থেকে বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা হবে।’

গ্রাম বাংলার এই ভ্রাম্যমাণ নরসুন্দররা কেবল পেশাজীবী নন, তারা এক ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক। আধুনিকতার ভিড়ে টিকে থাকা এই মানুষগুলো আমাদের ঐতিহ্যের জীবন্ত সাক্ষী। প্রয়োজন এখন রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ও সহানুভূতির হাত। যাতে তারা নিজেদের পেশায় মাথা উঁচু করে বাঁচতে পারেন।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
বাংলাদেশ সিরিজে শ্রীলংকা ওয়ানডে দলে ফিরলেন মাদুশঙ্কা-সামারাবিক্রমা
পবিত্র হজ পালন শেষে ৫৪,৩৯৭ জন হাজী দেশে ফিরেছেন
নির্বাচনের আগে মৌলিক সংস্কারগুলো বাস্তবায়ন করতে হবে : গোলাম পরওয়ার
মাদারীপুরে পৌরসভার উদ্যোগে খাল খনন 
সাম্য ও সম্প্রীতির শহর চট্টগ্রামে ঐক্যই আমাদের শক্তি : চসিক মেয়র
পাবনায় নদীতে ডুবে দুই শিশুর মৃত্যু 
কুলাউড়ায় হত্যার শিকার আনজুমের বাড়িতে জামায়াতের আমির 
রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রে অভিযান পরিচালনা করেছে দুদক 
বাংলাদেশ ও জাপানের মধ্যে ৬৩০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের ঋণচুক্তি স্বাক্ষরিত
জাতিসংঘ উন্নয়ন সম্মেলন : ট্রাম্পের সহায়তা কর্তনের প্রভাব কাটাতে সহায়তা আহ্বান
১০