দেলোয়ার হোসাইন আকাইদ
কুমিল্লা, ২৩ অক্টোবর, ২০২৫ (বাসস): বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুরা যেন সমাজের মূলধারায় থেকে নিজেদের সক্ষমতা বিকাশ করতে পারে-এই লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে বিশেষায়িত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ‘প্রতিভা’। এটি শুধু একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নয়, বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের জীবনের গতি বদলে দিতে পারে এই স্কুল। কুমিল্লার মুরাদনগরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এই ব্যতিক্রমী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি।
এক বছরের পথচলায় বিদ্যালয়টি এখন হয়ে উঠেছে বিশেষ শিশুদের শেখা, খেলাধুলা ও আত্মনির্ভরতার এক নিরাপদ আশ্রয়স্থল। এই মানবিক উদ্যোগে সার্বিক সহায়তা দিচ্ছেন কুমিল্লার জেলা প্রশাসক মো. আমিরুল কায়ছার। ২০২৪ সালের ১০ অক্টোবর তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সিফাত উদ্দিনের উদ্যোগে ‘প্রতিভা’র যাত্রা শুরু হয়। উপজেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের কারিগরি সহায়তায় উপজেলা পরিষদ ও উপজেলা প্রশাসনের আর্থিক সহায়তায় এই প্রতিষ্ঠানটি পরিচালিত হচ্ছে।
প্রতি শুক্রবার ও শনিবার ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থান থেকে বিশেষজ্ঞ শিক্ষক, একজন স্পিচ থেরাপিস্ট ও একজন ফিজিও থেরাপিস্ট এসে এই বিদ্যালয়ের শিশুদের থেরাপি ও প্রশিক্ষণ দেন। সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত চলে ক্লাস। পাঠের পাশাপাশি রয়েছে গান, আঁকিবুঁকি, খেলা ও শারীরিক বিকাশের নানা কার্যক্রম।
বিদ্যালয়ের লক্ষ্য শুধু পাঠদান নয়, বরং এমন এক অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষার পরিবেশ তৈরি করা, যেখানে মানসিক বা শারীরিক প্রতিবন্ধকতা শিশুদের পিছিয়ে রাখবে না।
প্রতিষ্ঠার এক বছরেই বিদ্যালয়টিতে এখন ৫০ জনের বেশি বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশু নিয়মিত পাঠ নিচ্ছে। তাদের মধ্যে কেউ অটিজম, কেউ ডাউন সিনড্রোম, আবার কেউ বুদ্ধিবিকাশজনিত সীমাবদ্ধতায় ভুগছে। শিক্ষকরা ভালোবাসা ও ধৈর্যের মাধ্যমে তাদের সামাজিক ও মানসিক বিকাশে কাজ করছেন।
অভিভাবক জাহাঙ্গীর আলম ইমরুল বলেন, ‘আমার মেয়ের জন্য আগে কোথাও উপযুক্ত পরিবেশ পাইনি। এখানে শিক্ষকরা যেভাবে ধৈর্য ধরে কাজ করেন, তা সত্যিই অনুপ্রেরণাদায়ক। তাদের দেখে আমরাও সাহস পাই।’
অন্য এক অভিভাবক রুবিনা আক্তার জানান, ‘আমার ছেলে আগে কারও সঙ্গে কথা বলত না, কিছু শেখাতে গেলেই রেগে যেত। এখন সে নিজেই স্কুলে যেতে চায়। ‘প্রতিভা’ ওকে বদলে দিয়েছে।’
বিদ্যালয়ের পরিচালক শারমিন ফাতেমা বলেন, ‘আমরা শুধু বই পড়া শেখাই না, শেখাই জীবনের পাঠ। আমরা তাদের বোঝাতে চেষ্টা করি কীভাবে নিজের কাজ নিজে করতে হয়, কীভাবে আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠতে হয়।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের শিক্ষার্থীদের মধ্যে ইয়াছিন, তাশফিয়া ও ফাতেমার মতো শিশুরা এখন দৃশ্যমান অগ্রগতি দেখাচ্ছে। ইয়াছিন আগে কারও সঙ্গে কথা বলত না, এখন স্বাভাবিকভাবে মিশছে। তাশফিয়া আগে সারাক্ষণ শুয়ে থাকত, এখন হামাগুড়ি দিতে পারে। ফাতেমার অবস্থাও অনেকটা উন্নত হয়েছে।’
মুরাদনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আবদুর রহমান বলেন, ‘প্রতিভা’ কেবল একটি বিদ্যালয় নয়, এটি মানবিকতার প্রতীক। এই শিশুরা আমাদের সমাজের অংশ, তাদের বিকাশে সবাইকে একসঙ্গে এগিয়ে আসতে হবে।’
কুমিল্লার জেলা প্রশাসক মো. আমিরুল কায়ছার বলেন, ‘বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুরা সমাজের বোঝা নয়, বরং সম্ভাবনার প্রতীক। তাদের প্রতিভা বিকাশে প্রশাসন ও সমাজকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘বিশেষ শিশুদের প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে ‘প্রতিভা’র মতো উদ্যোগকে সর্বাত্মক সহযোগিতা দেওয়া হবে।’
তিনি বিদ্যালয়ের স্থায়ী অবকাঠামো নির্মাণ ও প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম প্রদানের জন্য জেলা পরিষদের পক্ষ থেকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বরাদ্দ দেওয়ার আশ্বাস দেন।
কুমিল্লা জেলা প্রশাসক মো. আমিরুল কায়ছার বলেন,‘প্রতিভা’ স্কুলের এক বছরের এই যাত্রা কেবল একটি বিদ্যালয়ের নয়, বরং অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গঠনের এক উজ্জ্বল উদাহরণ। যেখানে প্রশাসন, শিক্ষক, অভিভাবক ও সাধারণ মানুষ একসাথে গড়ে তুলছেন মানবতার নতুন মানচিত্র।