
ঢাকা, ১৯ নভেম্বর, ২০২৫ (বাসস): বাংলাদেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে দেশি-বিদেশি বড় বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে পূর্বানুমানযোগ্য দীর্ঘমেয়াদি নীতি, আধুনিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা এবং সুসংহত জাতীয় জ্বালানি রূপকল্পের প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন নীতিনির্ধারক, ব্যবসায়ী নেতা ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা।
তারা বলেছেন, শিল্প খাতের প্রবৃদ্ধি ও জাতীয় উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করতে নির্ভরযোগ্য, প্রতিযোগিতামূলক এবং টেকসই বিদ্যুৎ নিশ্চিত করতে দৃঢ় নীতি ও নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
আজ রাজধানীর এক হোটেলে আয়োজিত ‘বিদ্যুৎ খাতে বেসরকারি বিনিয়োগ ত্বরান্বিত করতে সহায়ক নীতির পরিবেশ’ শীর্ষক এক প্যানেল আলোচনায় বক্তারা এসব কথা বলেন। ‘বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ও সমৃদ্ধি: টেকসই বিদ্যুৎ খাতে বিনিয়োগ পরিবেশ উন্নয়ন’ শীর্ষক উচ্চপর্যায়ের সংলাপের অংশ হিসেবে এ প্যানেল আলোচনার আয়োজন করা হয়।
ইএমএ পাওয়ারের সহায়তায় পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশ ও ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ) যৌথভাবে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে।
বিকেএমইএ’র সাবেক সভাপতি মো. ফজলুল হক সেশনটি পরিচালনা করেন। এতে ডিএফডিএল পার্টনার শাহওয়ার নিজামও বক্তব্য দেন।
অনুষ্ঠানে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের উপদেষ্টা ড. মাহাদী আমিন বলেন, জ্বালানি নিরাপত্তা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, শিল্পায়ন এবং কর্মসংস্থানের একটি মৌলিক স্তম্ভ হিসেবে রয়ে গেছে।
তিনি বলেন, বহু বছর ধরে শিল্পখাত জ্বালানি, গ্যাস, এমনকি পানির ঘাটতিতে ভুগছে। বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ সত্ত্বেও জ্বালানি নিরাপত্তা অন্যতম বড় উদ্বেগের বিষয় হয়ে আছে। অতীত অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, কিছু মেগা প্রকল্প ‘দায়মুক্তির সংস্কৃতিতে’ ভুগেছে। ভবিষ্যৎ নীতি অবশ্যই স্বচ্ছ ও টেকসই হতে হবে।
ড. আমিন বলেন, তার দলের জ্বালানি ভিশন সৌর, বায়ু, বর্জ্য থেকে জ্বালানি, পারমাণবিক, তেল, কয়লা ও গ্যাসের একটি ভারসাম্যপূর্ণ মিশ্রণের ওপর গুরুত্ব দেয়, যেখানে দেশীয় সম্পদ অনুসন্ধান, বিশেষ করে নীল অর্থনীতির সুযোগগুলোর ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, ভবিষ্যৎ জ্বালানি কৌশল বেসরকারি খাত নেতৃত্বাধীন হওয়া উচিত এবং উদার অর্থনৈতিক নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়া উচিত, যা ঐতিহাসিকভাবে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করেছে।
ড. আমিন বিদ্যুৎ ও অবকাঠামোহীন স্থবির শিল্পাঞ্চলগুলোকে অগ্রাধিকার দেওয়ার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন এবং গৃহস্থালি ও শিল্প উভয়ের জন্য বর্জ্য থেকে জ্বালানি সমাধানের সম্ভাবনা তুলে ধরেন।
তিনি বলেন, নীতিগুলো বিশেষজ্ঞ, সুশীল সমাজ, একাডেমিয়া ও শিল্পখাতসহ বহুপক্ষীয় অংশীদারিত্বের মাধ্যমে তৈরি করতে হবে। ভবিষ্যৎ সংস্কারগুলোতে টেকসই ব্যবস্থা ও জবাবদিহিতা অবশ্যই নির্দেশক হতে হবে।
মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এমসিসিআই) সভাপতি কামরান টি রহমান বলেন, বাংলাদেশকে ভবিষ্যতে বেসরকারি বিনিয়োগ উন্মোচনে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে জরুরি সংস্কার প্রয়োজন। সেগুলো হলো- নীতির পূর্বানুমেয়তা, আধুনিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ও টেকসই আর্থিক ব্যবস্থা।
তিনি বলেন, আমাদের স্থাপিত বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা প্রায় ২৮ হাজার থেকে ২৯ হাজার মেগাওয়াট। কিন্তু দুর্বল গ্রিড, ব্যয়বহুল জ্বালানি এবং অব্যবহৃত বিদ্যুৎকেন্দ্রের কারণে আমরা এর অর্ধেকও ব্যবহার করতে পারি না।
তিনি একটি স্বায়ত্তশাসিত নিয়ন্ত্রকের ক্ষমতায়ন, প্রতিযোগিতামূলক দরপত্র সম্প্রসারণ, অনুমোদন প্রক্রিয়া সহজীকরণ এবং বেসরকারি বিনিয়োগকারীদের জন্য ওয়ান-স্টপ সার্ভিস চালুর আহ্বান জানান।
বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিজিএমইএ) সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বলেন, দীর্ঘমেয়াদি মূল্য নির্ধারণের পূর্বানুমেয়তা শিল্প প্রতিযোগিতার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
তিনি বলেন, মূল্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তবে আমাদের অন্তত তিন থেকে পাঁচ বছরের জন্য নীতি প্রয়োজন। আমরা সরকারি আশ্বাসের ভিত্তিতে কারখানা স্থাপন করি, কিন্তু যখন আমরা কার্যক্রম শুরু করতে যাই, তখন প্রায়ই মূল্য নির্ধারণ নীতি পরিবর্তিত হয়।
বিজিএমইএ সভাপতি সরকারকে ছাদে সৌরবিদ্যুৎ সম্প্রসারণে কর-বৈষম্য দূর করার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, প্যানেল ও ইনভার্টারে মাত্র এক শতাংশ শুল্ক, কিন্তু সংশ্লিষ্ট উপাদানে ৫০ শতাংশেরও বেশি। আমাদের সদস্যরা এনবিআর ও কাস্টমসে সমস্যায় পড়েন, এমনকি নীতিগুলো কাগজে অনুকূল দেখালেও।
মার্চেন্ট পাওয়ার পারচেজ এগ্রিমেন্ট (পিপিএ) কাঠামো নিয়ে তিনি বলেন, উদ্যোগটি আশাব্যঞ্জক হলেও এখনও অস্পষ্ট। নীতিটি শুরু হওয়ার আগেই হুইলিং চার্জ বাড়ানো হয়েছে। বিলিং পদ্ধতিগুলো এখনও চূড়ান্ত হয়নি।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের উপাচার্য ড. এম তামিম সতর্ক করে বলেন, বর্তমানে অতিরিক্ত সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ ২০২৯ সালের মধ্যে জ্বালানি ঘাটতির মুখোমুখি হতে পারে।
তিনি বলেন, আমাদের নবায়নযোগ্য জ্বালানির লক্ষ্য রয়েছে। কিন্তু কোনো কর্মপরিকল্পনা নেই।
তিনি আরও বলেন, দুই থেকে তিন বছরের মধ্যে দেশ বড় ধরনের গ্যাস সংকটে পড়তে পারে। শিল্প, পরিবহন ও গৃহস্থালি সবই গ্যাসের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু আমরা দেখছি না, খাতগুলোতে পরিবর্তনের কোনো পরিকল্পনা আছে।
ড. তামিম এলএনজি আমদানি সক্ষমতার সীমাবদ্ধতা, অপর্যাপ্ত স্থানীয় অনুসন্ধান এবং পারমাণবিক ও বিকাশমান ছোট মডুলার রিঅ্যাক্টর প্রযুক্তির জন্য স্পষ্ট রোডম্যাপের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, পরবর্তী সরকারের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে জ্বালানি খাত।