ঢাকা, ১৫ এপ্রিল ২০২৫ (বাসস) : আবহমান গ্রামবাংলার ইতিহাস ঐতিহ্যের অনেক কিছুই কালের বিবর্তনে আজ বিলুপ্তির পথে। এসব ঐতিহ্যবাহী খেলার মধ্যে একসময় গ্রামবাংলার অন্যতম ঐতিহ্য ছিল ঘোড়ার দৌড় (ঘোড়দৌড়) প্রতিযোগিতা। কালের বিবর্তনে আজ হারিয়ে যেতে বসেছে গ্রামবাংলার জনসাধারণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণমূলক এই ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতা। তবে এখনও লালমনিরহাটে এই ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতা হাজার হাজার নারী পুরুষের স্বতঃস্ফূর্ত উপস্থিতিতে আয়োজন করা হয়ে থাকে।
বাংলা নববর্ষ ১৪৩২ উপলক্ষে লালমনিরহাটের কেন্দ্রীয় বিএনপি'র সাংগঠনিক সম্পাদক (রংপুর বিভাগ) অধ্যক্ষ আসাদুল হাবিব দুলুর উদ্যোগে গ্রাম বাংলার হারিয়ে যাওয়া কিছু ঐতিহ্যবাহী খেলা প্রতিবছর পহেলা বৈশাখে আয়োজিত হয়ে আসছে, যা ইতোমধ্যে সমগ্র দেশে সবার নজর কেড়েছে। এসব খেলার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো দাড়িয়াবান্ধা, চকরচাল, ঠুস, ঘুড়ি উড়ানো, সাঁতার ও ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতা। প্রতি বছর নিয়মিত আয়োজনের অংশ হিসেবে এবছরও ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতা আয়োজন করা হয়।
সোমবার বিকেলে বড়বাড়ি শহীদ আবুল কাশেম মহাবিদ্যালয় মাঠে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী খেলা ঘোড় দৌড় উদ্বোধন করেন অধ্যক্ষ আসাদুল হাবিব দুলু। চার দিন হবে এই ঘোড় দৌড় প্রতিযোগীতা। আজকে দ্বিতীয় দিনের খেলা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। চতুর্থ দিন ফাইনাল রাউন্ডের মধ্য দিয়ে প্রতিযোগিতা শেষ হবে।
প্রতিবছরের ন্যায় এবারও বাংলা নববর্ষ ১৪৩২ উপলক্ষে ও ঘোড় দৌড় প্রতিযোগিতাকে কেন্দ্র করে নানা সাজে সজ্জিত করা হয় বড়বাড়ি শহীদ আবুল কাশেম মহাবিদ্যালয় মাঠ। এছাড়াও আয়োজিত হচ্ছে মেলা। মেলার দোকান গুলোতে হরেক রকমের পসরা সাজিয়ে বসেছে দোকানীরা। মাঠের এক কোনায় রয়েছে বাচ্চাদের বিনোদনের জন্য ট্রেন, নাগরদেলাসহ বিভিন্ন রাইড। তবে এসবের মধ্যে আগত উৎসুক জনতা ঘোর দৌড়কেই বেশি প্রাধান্য দিয়ে থাকে।
ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়ার জন্য দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে সাওয়ারিরা ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়। তাদের সাথে টগবগিয়ে খুরের আওয়াজ তুলে আসে রঙ-বেরঙের বিভিন্ন প্রকারের ঘোড়া। এ ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতা ও মেলা উপভোগ করতে লালমনিরহাট জেলাসহ পার্শ্ববর্তী জেলা ও উপজেলা থেকে হাজার হাজার মানুষ আসে। এছাড়াও শিশু-কিশোর, নারী-পুরুষসহ নানা শ্রেণীপেশার হাজারো মানুষেরও ভিড় হয়। অনেকে আবার ঘোড়াদৌড় দেখতে আগের দিনই মাঠে এসে বসে থাকে।
শুধুমাত্র ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতা দেখার জন্য সকাল থেকে হাজার হাজার নারী-পুরুষসহ বিভিন্ন বয়সী শিশুরা মাঠে জড়ো হতে থাকেন। উৎসবমুখর পরিবেশে ঘোড়ার দৌড় ও সওয়ারিদের রণকৌশল উপভোগ করতে মাঠের চতুরদিকে হাজির হয় হাজার হাজার দর্শনার্থী। তারা মাঠে দাঁড়িয়ে-বসে এই ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতা উপভোগ করেন। খেলা শুরু হলে মাঠের চারদিকে হাজারো দর্শকের উচ্ছ্বসিত আনন্দ ছড়িয়ে পড়ে। দুরন্ত গতিতে ছুটে চলে ঘোড়া, আর সেই ঘোড়দৌড় দেখে উৎসাহিত হয় নানা বয়সের দর্শনার্থীরা। দর্শকের মুহুর্মুহু করতালি আর চিৎকারে অন্যরকম আনন্দ বয়ে যায়। এ যেনো চিরায়ত বাঙালির চিরচেনা মিলনমেলা। প্রথম দিনের ঘোড়দৌড় প্রতিযোগীতায় ৩২টি ঘোড়া অংশ নেয়।
এসব সাওয়ারিদের মধ্যে সবার নজর ছিল সর্বকনিষ্ঠ ১২ বছরের হালিমা বেগমের উপর। চারজনের ঘোড় দৌড় প্রতিযোগিতায় হালিমা প্রথম স্থান অধিকার করে সবার নজরও কাড়েন।
লালমনিরহাট জেলার কালীগঞ্জ থেকে ঘোড়দৌড় দেখতে আসা আলেক মিয়া বলেন, আমি পরিবার নিয়ে বুড়িমারী থেকে ঘোড় দৌড় দেখতে এসেছি। আমার ঘোড়দৌড় দেখতে অনেক ভালো লাগে। ভালো লাগে বলেই পরিবার নিয়ে এখানে আসা। আমি প্রতি বছর পরিবার নিয়ে বড়বাড়ির এই কলেজ মাঠে ঘোড়দৌড় দেখতে আসি।
ঘোড়াদৌড় দেখতে আসা অবুল কালাম বলেন, আমি পাটগ্রাম থেকে ঘোড়াদৌড় দেখতে এসেছি। প্রতি বছর এখানে ঘোড়াদৌড় অনুষ্ঠিত হচ্ছে। সবসময়ই এখানকার ঘোড়াদৌড় দেখতে আসি। এবছরও এসেছি। আমি চাই প্রতি বছর যেনো এখানে ঘোড়াদৌড় ও গ্রামীন মেলা অনুষ্ঠিত হয়। এমন আয়োজনে হাজারো দর্শকের উপস্থিতিতে আবেগ আপ্লুত হয়েছি। এ প্রতিযোগিতা হারিয়ে যাওয়া ঐহিত্যকে মনে করিয়ে দিবে। তবে এমন আয়োজন প্রতিবছর হলে ভালো হয়। তাহলে মানুষ গ্রামীণ ঐতিহ্য হারাবে না।
ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারী হালিমা বেগম বলেন, আমি নাটোর থেকে বাবার সাথে এই ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে এসেছি এবং এখানে খেলায় অংশ নিয়ে প্রথম স্থান অধিকার করি। বাবার মুখে শুনেছি, এখানে এই প্রতিযোগিতা খুবই আকর্ষণীয় এবং হাজার হাজার দর্শক হয় । এখানে এসে এর সত্যতা পেলাম। এজন্য হালিমা আয়োজক অধ্যক্ষ আসাদুল হাবিব দুলুকে ধন্যবাদ জানান।
প্রতিযোগিতার আয়োজক কেন্দ্রীয় বিএনপি'র সাংগঠনিক সম্পাদক অধ্যক্ষ আসাদুল হাবিব দুলু বলেন, প্রতি বছরের মতো এবছরও ঘোড়ার দৌড় প্রতিযোগীতার আয়োজন করা হয়েছে। মূলত গ্রামীন ঐতিহ্য ধরে রাখতে ও বিনোদনের উদ্দেশ্যেই এ আয়োজন করা হয়। ঘোড়দৌড় ছাড়াও বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে হারিয়ে যাওয়া গ্রামীণ ঐতিহ্য দাড়িয়াবান্ধা, চকরচাল, ঠুস, ঘুড়ি উড়ানো ও সাঁতারেরও আয়োজন করা হয়েছে। ৪ দিনের এ প্রতিযোগিতা শেষে বিজয়ী ঘোড়ার সাওয়ারদের পুরস্কৃত করা হবে।
তিনি আরো বলেন, প্রতিযোগিতার পাশাপাশি গ্রামীণ এ মেলা প্রতিদিন সকাল থেকে অনেক রাত পর্যন্ত চলে। গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে বাংলার সংস্কৃতি মনে করিয়ে দিতে আর এলাকাবাসীকে আনন্দ দিতেই তার এই সামান্য আয়োজন। গ্রামীন ঐতিহ্য ধরে রাখতে ও মাদক মুক্ত সামজ গড়ে তুলতে এ আয়োজনের ধারাবাহিকতা বজায় রাখার কথাও তিনি জানিয়েছেন।