।। দেলোয়ার হোসাইন আকাইদ ।।
কুমিল্লা, ১৯ আগস্ট ২০২৫ (বাসস): বাংলাদেশের প্রাচীন নগরীগুলোর মধ্যে কুমিল্লা অন্যতম একটি ঐতিহ্যবাহী শহর। এ নগরীর ইতিহাস, সংস্কৃতি, জনজীবন ও বিনোদনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছে ধর্মসাগর দিঘি। প্রায় পাঁচ শতাব্দী আগে খনন করা এ দিঘি আজও কুমিল্লাবাসীর কাছে শুধু একটি জলাধার নয়। বরং ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি এবং সামাজিক মিলনমেলার প্রতীক হিসেবে টিকে আছে।
কুমিল্লা নগরীর ‘ফুসফুস’ খ্যাত এই দিঘির সৌন্দর্য বাড়াতে কুমিল্লা সিটি করপোরেশন ইতোমধ্যে ৪৮ কোটি টাকার একটি উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করেছে।
ঐতিহাসিক দলিলপত্রে উল্লেখ আছে, ১৪৫৮ খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন ত্রিপুরার রাজা ধর্মমানিক্য কুমিল্লা অঞ্চলে পানীয় জলের সংকট দূর করতে বিশাল এক দিঘি খনন করান।
তাঁর নামানুসারেই এর নামকরণ করা হয় ধর্মসাগর। প্রায় ছয়শ বছরের ইতিহাস বহনকারী এ দিঘি বর্তমানে নগরীর প্রাণকেন্দ্রে প্রায় ২৫ একর এলাকা জুড়ে বিস্তৃত।
নগরীর ব্যস্ততা ও কর্মচাঞ্চল্যে ক্লান্ত মানুষ প্রতিদিনই কিছুটা প্রশান্তির খোঁজে ছুটে আসেন ধর্মসাগরের পাড়ে। বিশেষত সকালে ও সন্ধ্যায় স্বাস্থ্যসচেতন মানুষ পশ্চিম পাড়ে হাঁটার পথে ভিড় করেন নির্মল বাতাসে শ্বাস নিতে। কেউ শরীর চর্চা করেন, কেউ বা আড্ডায় মেতে ওঠেন। স্থানীয়দের ভাষায় ‘ধর্মসাগরে এলেই নাগরিক জীবনের যাবতীয় ক্লান্তি দূর হয়ে যায়।’
কুমিল্লাবাসী ধর্মসাগরকে নগরীর ‘ফুসফুস’ হিসেবে আখ্যায়িত করে থাকেন। শহরের যানজট, ভাঙাচোরা সড়ক কিংবা কোলাহলপূর্ণ পরিবেশের মধ্যেও দিঘির চারপাশের সবুজ বেষ্টনী মানুষের মনে প্রশান্তি এনে দেয়। ভোরের প্রথম আলো কিংবা বিকেলের সূর্যাস্তে ধর্মসাগর এক অন্য রূপে ধরা দেয়। যা নগরবাসীর কাছে অমূল্য সম্পদ।
নগরীর প্রবীণ বাসিন্দা মো. হাবিবুর রহমান (৭৫) তার শৈশবের স্মৃতিচারণ করে বলেন, শৈশব-কৈশোরে আমরা ধর্মসাগরের চারপাশে খেলাধুলা করেছি। একসময় দিঘিতে নৌকাবাইচ হতো। আজও এখানে এসে মনে হয় শহরের কোলাহলের মাঝে এখানেই এক টুকরো শান্তি লুকিয়ে আছে।
কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের শিক্ষার্থী মৌমিতা পরান নিশি বাসসের সাথে আলাপকালে বলেন, ‘ক্লাস শেষে বান্ধবীদের সঙ্গে হাঁটার জন্য ধর্মসাগর আমাদের প্রথম পছন্দ।
এখানকার সবুজ পরিবেশ ও খোলা হাওয়ায় মন ভালো হয়ে যায়।’
কুমিল্লার সংস্কৃতিকর্মী শামস আল মামুন বলেন, ‘ধর্মসাগর দিঘি ঘিরে নগর উদ্যানের জামতলা, নজরুল ইন্সটিটিউট, রানির কুঠি ও আর্ট স্কুলসহ আশপাশের এলাকা কুমিল্লার সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র হয়ে উঠেছে। প্রতিদিন এখানে গান, আবৃত্তি ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এ দিঘি কেবল জলাধার নয়, এটি কুমিল্লার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক।’
তবে ধর্মসাগরের সৌন্দর্য রক্ষায় যথাযথ উদ্যোগের অভাব রয়েছে বলে অভিযোগ করেন স্থানীয়রা। নগরীর কাপ্তান বাজার এলাকার বাসিন্দা মশিউর রহমান সজিব বলেন, ‘শহরের বর্জ্য অনেক সময় এই দিঘিতে ফেলা হয়। ফলে পানির স্বচ্ছতা নষ্ট হচ্ছে। পাশাপাশি অব্যবস্থাপনা ও অতিরিক্ত বাণিজ্যিকীকরণের কারণে ধর্মসাগরের ঐতিহ্য ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।’
লাভ ফর বাংলাদেশ ট্যুরিজম ক্লাবের চেয়ারম্যান মীর মফিজুল ইসলাম বাসসকে বলেন, ‘ময়নামতি, শালবন বৌদ্ধবিহার ও রূপবন মুড়ার মতো প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানের পাশাপাশি ধর্মসাগরও কুমিল্লাকে পর্যটনের রাজধানী হিসেবে গড়ে তুলতে পারে। তবে এর জন্য ধর্মসাগরকে পরিচ্ছন্ন ও পরিকল্পিতভাবে সংরক্ষণ করতে হবে।’
কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আবু সায়েম ভূইঁয়া বাসসকে বলেন, ধর্মসাগর সংরক্ষণে একটি উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। জাইকার অর্থায়নে ৪৮ কোটি টাকার এ প্রকল্পের টেন্ডার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে। আশা করা হচ্ছে আগামী মাসে কাজ শুরু হবে। প্রকল্পের আওতায় দিঘির চারপাশের পার উদ্ধার, পার বাঁধাই, হাঁটার জন্য আধুনিক ওয়াকওয়ে, সৌন্দর্যবর্ধনে বৃক্ষরোপণ এবং উত্তরপূর্ব কর্নারে একটি ছোট ঝুলন্ত সেতু নির্মাণসহ অন্যান্য সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ করা হবে।
তিনি বলেন, ‘ধর্মসাগর কুমিল্লার ফুসফুস। এর সৌন্দর্য ও ঐতিহ্য ধরে রাখতে সিটি করপোরেশন সর্বাত্মক উদ্যোগ গ্রহণ করবে।’
নগরবাসীর প্রত্যাশা, ‘নগরীর ফুসফুস’ হিসেবে খ্যাত পৌনে ছয় শতাব্দীর ইতিহাস সম্বলিত ধর্মসাগর দিঘি যেন তার ঐতিহ্য অক্ষুণ্ন রেখে আরও সুন্দরভাবে সংরক্ষিত হয়।
অতীতের সাক্ষী, বর্তমানের বিনোদন কেন্দ্র এবং ভবিষ্যতের পর্যটন সম্ভাবনা হিসেবে ধর্মসাগরকে জাতীয় পর্যায়ে একটি ঐতিহাসিক ও পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার দাবি দিন দিন জোরালো হচ্ছে।