।। মহিউদ্দিন সুমন।।
টাঙ্গাইল, ২৩ জুলাই, ২০২৫ (বাসস) : লাল মাটির সমতল ভূমির আনারসের রাজধানী হিসেবে খ্যাত টাঙ্গাইলের মধুপুর। ইতোমধ্যে টাঙ্গাইলের বাজারগুলোতে উঠতে শুরু করেছে ঐতিহ্যবাহী জিআই পণ্য মধুপুরের রসালো মিষ্টি আনারস। এ বছর অনুকূল আবহাওয়া ও যথাযথ পরিচর্যার ফলে টাঙ্গাইলে আনারসের অধিক ফলন হয়েছে।
চলতি মৌসুমী প্রায় ২০০ কোটি টাকার বাণিজ্যের সম্ভাবনা দেখছে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। সেই সাথে বিদেশে রপ্তানিসহ আনারস থেকে বিভিন্ন খাদ্যসামগ্রী তৈরির কারখানা করার পরিকল্পনাও আছে তাদের।
টাঙ্গাইলের মধুপুর উপজেলার জলছত্র কৃষি মার্কেট, গারোবাজার, ইদিলপুর, আশ্রাবাজার ও মোটেরবাজার থেকে প্রতিদিন ২৫ থেকে ৩০টি ট্রাকে করে দেশের বিভিন্ন জেলায় প্রতিদিন ছড়িয়ে পড়ছে প্রায় ৩ কোটি টাকার আনারস।
জানা গেছে, বাংলাদেশে আনারস চাষের গোড়াপত্তন হয় ১৯৪২ সালে। মধুপুরের ইদিলপুর গ্রামের ক্ষুদ্র নৃতাত্তিক গারো সম্প্রদায়ের মিজি দয়াময়ী সাংমা প্রথম আনারস চাষ শুরু করেন। তিনি ভারতের মেঘালয় থেকে ৭৫০টি চারা এনে তাঁর বাড়িতে আনারস চাষ শুরু করেন। সেই চাষকে সমৃদ্ধ করার ধারাবাহিকতায় বতর্মানে সারা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আনারস চাষ হয়ে থাকে। শত বছরের ঐতিহ্য-ইতিহাসের সঙ্গে মিশে আছে সুস্বাদু এ আনারস।
বাংলাদেশ সরকারের ভৌগলিক নির্দেশক ইউনিট ২০২৪ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর মধুপুরের আনারসকে জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি সনদ দেয়। শিল্প মন্ত্রণালয়ের পেটেন্ট, শিল্প-নকশা ট্রেডমার্ক অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. মুমিন হাসানের সই করা সনদে ৩১ শ্রেণিতে জিআই-৫২ নম্বরে মধুপুরের আনারসকে ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য হিসেবে উল্লেখ করেন।
জেলা কৃষি সম্প্রসারন সূত্রে জানা গেছে, চলতি মৌসুমে টাঙ্গাইলে ৭ হাজার ৭৯৪ হেক্টর জমি থেকে ২ লাখ ৭২ হাজার ৭৯০ মেট্রিক টন আনারস উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। মধুপুরের গারোবাজারের পাশাপাশি জলছত্র ও মোটেরবাজারসহ বিভিন্ন বাজারে প্রতিদিন ১০ লাখ পিসের বেশি আনারস বিক্রি করে তিন কোটি টাকার বেশি বাণিজ্য হয়। এ বছর আনারস বিক্রি করে প্রায় ২০০ কোটি টাকার উপরে বাণিজ্য হবে বলে আশা করছেন টাঙ্গাইল কৃষি বিভাগ।
সরেজমিনে মধুপুর জলছত্র বাজারে গিয়ে দেখা যায়, উপজেলার বিভিন্ন বাগান থেকে সাইকেল, ভ্যান ও পিকআপসহ বিভিন্ন যানবাহনে করে চাষীরা আনারস নিয়ে আসছেন বাজারে। স্তুপে স্তুপে সাজিয়ে রাখা হয়েছে আনারস। কেউ বিক্রি করছেন, আবার কেউ কিনছেন।
জলছত্র বাজারের আনারস ব্যবসায়ীরা জানান, বিগত বছরের তুলনায় এই বছরে আনারসের দাম ভালো। আম, কাঁঠালসহ অন্যান্য মৌসুমী ফল বর্তমানে বাজারে থাকায় আনারসের চাহিদা কিছুটা কম। মৌসুমী ফল শেষ হওয়ার সাথে সাথে আনারসের দাম আরো বাড়বে বলে আশা করছেন ব্যবসায়ীরা।
আনারস ব্যবসায়ী উজ্জ্বল মিয়ার সাথে কথা হলে তিনি বাসসকে জানান, আমি প্রতিদিন গারোবাজার ও আশ্রাবাজার থেকে দুই থেকে তিন হাজার পিস আনারস কেনা বেচা করি। প্রতি পিচ আনারস ৩০/ ৪০ টাকা করে কিনে ঢাকা, সিলেট, রংপুরসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় বিক্রি করে থাকি। খরচ বাদে লাভ ভালোই থাকে।
জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত মধুপুরের আনারস চাষি ছানোয়ার হোসেন বলেন, জমি প্রস্তুত, সার-কীটনাশক, পিজিআর প্রয়োগ, রোপণ ও বাজারজাত পর্যন্ত প্রতিটি আনারসে খরচ পড়ে ১৫-১৮ টাকা। বাজারে ছোট আনারস ১৫-২০, মাঝারি ২৫-৩৫ এবং বড় আনারস ৩৫-৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আষাঢ় থেকে ভাদ্র মাস পর্যন্ত চলবে সংগ্রহ ও বিপণন।
তিনি আরো জানান, মধুপুরের ইতিহাস ও ঐতিহ্য আমাদের আনারস। জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ায় আমরা গর্বিত আনন্দিত ও উদ্বেলিত। বিশ্ব মানচিত্রে এই আনারসের কল্যাণে মধুপুর উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে টিকে থাকবে বলে আমার বিশ্বাস।
মধুপুর গারোবাজার গ্রামের আনারস চাষি রমজান আলী জানান, চলতি মৌসুমে লক্ষাধিক টাকা খরচ করে ৫ বিঘা জমিতে ক্যালেন্ডার জাতের আনারসের চাষ করেছেন। প্রতি পিস বিক্রি হচ্ছে ১৫ থেকে ৪০ টাকায়। তবে, আনারসের দাম বাড়লেও চাহিদা কম থাকায় তেমন লাভ হচ্ছে না বলে জানান তিনি।
জলছত্র ট্রাক ড্রাইভার্স ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক শহীদুল ইসলাম মুন্সি বলেন, উপজেলার জলছত্র, গারোবাজার, আউশনারা, মহিষমারা, মোটেরবাজার, শোলাকুড়ী, দোখলাসহ বিভিন্ন স্থানে আনারস বেচাকেনা হচ্ছে। বাজারের পাশাপাশি আনারসের বাগান থেকেই ট্রাকে পণ্য যাচ্ছে বিভিন্ন স্থানে।
মধুপুর গারোবাজারের ইজারাদার জুলহাস উদ্দিন বলেন, আগে আনারস প্রাকৃতিকভাবে পাকতো, এতে ফল মিষ্টি ও সুস্বাদু হতো। কিন্তু এখন মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক দেয়ার কারণে ফলের গুণগত মান কমে গেছে। সেই সঙ্গে চাহিদাও কমে গেছে। তাই মধুপুরের আনারসের ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতে কৃষি বিভাগের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরী বলে মনে করেন তিনি।
আনারস ব্যবসায়ী শরিফ বলেন, ‘আমাদের উৎপাদিত আনারস সঠিকভাবে বাজারজাতের বিষয়ে কেউ আমাদের সাথে যোগাযোগ এবং সহযোগিতা করেন না। মধুপুর আনারস ব্যবসায়ী আছেন প্রায় দেড়শোর মতো, আবার খুচরা ব্যবসায়ী আছেন প্রায় ২০০ শতাধিক। তাই আমরা যাতে সঠিকভাবে আনারস বাজারজাত করতে পারি সে বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কতৃপক্ষের দৃষ্টি দেয়ার দাবি জানাই।
মধুপুর উপজেলা উদ্ভিদ সংরক্ষণ কর্মকর্তা মো. মিজানুর রহমান বলেন, মধুপুর উপজেলায় ৬ হাজার ৬৪০ হেক্টর জমিতে আনারসের চাষ হয়েছে। এর মধ্যে ক্যালেন্ডার জাতের আবাদ হয়েছে ৪ হাজার ২২০ হেক্টরে, জলডুগি বা হানিকুইন ২ হাজার ৩৯২ হেক্টরে এবং এমডি-টু জাতের আবাদ হয়েছে ২৬ হেক্টর জমিতে। বর্তমানে মধুপুরের পাহাড়ি অঞ্চলে ৬ হাজার ৬৪০ হেক্টর জমিতে প্রায় ১৭ কোটি আনারস গাছ রয়েছে। আর এর মধ্যে ক্যালেন্ডার জাতের রয়েছে প্রায় ১১ কোটি আনারস গাছ।
মধুপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা রকিব আল রানা বাসস কে বলেন, চলতি মৌসুমে আনারসের অধিক ফলন হয়েছে। আকারে বড় হওয়ায় দামও ভালো পাচ্ছেন কৃষকেরা। বিদেশে রপ্তানি এবং আনারস দিয়ে জেলিসহ উপকরণ তৈরি করে বিপণনের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন সম্ভব। এ নিয়ে কৃষি বিভাগ ইতিমধে কাজ শুরু করছে।
টাঙ্গাইল মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফুড টেকনোলজি অ্যান্ড নিউট্রিশন সায়েন্স বিভাগের চেয়ারম্যান ড. মো. আজিজুল হক বলেন, জিআই স্বীকৃতি পেয়েছে মধুপুরে আনারস। সেক্ষেত্রে কৃষির একটা আলাদা স্বীকৃতি এটা। জিআই স্বীকৃতি পাওয়া আনারসের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ আশেক পারভেজ বাসস কে বলেন, টাঙ্গাইলের মধুপুর হলো আনারস চাষের জন্য বিখ্যাত। মধুপুরে সবচেয়ে বেশি আনারসের চাষ হয়। এ ছাড়াও ঘাটাইল, মির্জাপুর ও সখিপুর উপজেলায় আনারসের আবাদ হয়ে থাকে।
চলতি মৌসুমে মধুপুরের গারোবাজার, জলছত্র, মোটের বাজারসহ বিভিন্ন বাজারে প্রতিদিন ১০ লাখ পিসের বেশি আনারস বিক্রি হয়। যার বাজার মূল্য প্রায় তিন কোটি টাকা। এ বছর জেলায় আনারস বিক্রি করে প্রায় ২০০ কোটি টাকার বেশি বাণিজ্য হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।
তিনি আরো জানান, এ বছর জন প্রতি ২১০ জন চাষীকে প্রণোদনা হিসেবে ২ হাজার ২৫০টি আনারস চারা বিনামূল্যে প্রদান করা হয়েছে। অন্যদিকে কৃিষ বিভাগের পক্ষ থেকে আনারসের ফলন বৃদ্ধির পাশাপাশি ক্ষতিকারক মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক ব্যবহার বন্ধে আনারস চাষীদের মূল্যবান পরামর্শ ও সহযোগিতা প্রদান করা হচ্ছে।