ঢাকা, ৫ মার্চ, ২০২৫ (বাসস) : শামীমা ফিরোজ চার মাসের গর্ভবতী ছিলেন। মাঝে মাঝে তার পেটে ব্যথা এবং রক্তক্ষরণ হচ্ছিল। গর্ভধারণের পর চিকিৎসক তাকে একবার আলট্রাসনোগ্রাম করতে বলেছিলেন। শামীমা তা করেননি। ভেবেছিলেন, আলট্রাসনোগ্রাম শেষের দিকে করবেন। তবে ব্যথা বেশি হওয়ায় শেষ পর্যন্ত তাকে আলট্রাসনোগ্রাম করতে হয়।
শামীমা বলেন, ‘পেটে ব্যথা হওয়ায় চিকিৎসকের কাছে গেলে তিনি আমার আলট্রাসনোগ্রাম করান এবং এতে দেখা যায় আমার জরায়ু একটু ছেঁড়া বা একটি ফুটা রয়েছে। এজন্য মাঝে মধ্যে রক্তক্ষরণ এবং ব্যথা হচ্ছে।’
জরায়ুতে ভ্রুণের অবস্থান বা জরায়ুতে কোনো ধরনের সমস্যা আছে কি না এসব জানতে চিকিৎসকরা প্রথম তিন মাসের মধ্যে আলট্রাসনোগ্রাম করতে বলেন। এতে সব কিছু বোঝা যায়।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের সাবেক অধ্যাপক এবং স্ত্রী রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. ফারহানা দেওয়ান বলেন, ‘অনেকেই মনে করেন জরায়ু শুধুমাত্র সন্তান জন্মদানের ক্ষেত্রে কাজ করে। এটা ঠিক নয়। জীবনের কয়েকটি পর্যায়ে জরায়ুর বিষয়ে বিশেষ যত্নবান হওয়া প্রয়োজন। এর মধ্যে মাসিকের সময়, সহবাসের সময়, গর্ভকালীন সময় এবং মেনোপজের (মাসিক ঋতুচক্র চিরতরে বন্ধ হয়ে যাওয়া) আগে ও পরে।’
তিনি বলেন, ‘মাসিকের সময় স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার করা প্রয়োজন। এ সময় ময়লা বা বেশি ভেজা ন্যাপকিন ব্যবহার করা ঠিক নয়। এ সময় মাঝে মাঝে গরম পানি ব্যবহার জরায়ুকে অনেক বেশি সুরক্ষা দেবে। এ সময় জরায়ুর মুখ খোলা থাকে। তাই পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকা প্রয়োজন। নইলে জরায়ুতে ইনফেকশন বা অন্য কোনো সমস্যা হতে পারে। অতিরিক্ত জোর জবরদস্তি করে সহবাস করা ঠিক নয়। এতে জরায়ু আঘাত পেয়ে ইনফেকশন হতে পারে। সহবাসের আগে ভালোভাবে প্রস্রাব করে যোনিপথ পানি দিয়ে ধুয়ে নেয়া উচিত এবং সহবাসের পরেও অবশ্যই তা ভালোভাবে পরিষ্কার করা প্রয়োজন। মাসিকের সময় সহবাস করা ঠিক নয়। এতে জরায়ুর নানা রকম সমস্যা হতে পারে।’
তিনি আরো বলেন, ‘গর্ভকালীন সময়ে এবং প্রসব পরবর্তী সময়েও জরায়ুর দিকে বিশেষ নজর দেয়া প্রয়োজন। ভ্রুণ জরায়ুতে অবস্থান করে এবং সেখানে বেড়ে ওঠে। তাই ভ্রুণ জরায়ুতে অবস্থান করছে কি না বিষয়টি জানার জন্য গর্ভকালীন চেকআপ খুবই জরুরি। কেননা অনেক সময় দেখা যায় ভ্রুণ ডিম্বাশয়ে বা পেটের কোনো নালিতে বড় হতে থাকে। এতে অনেক জটিলতা সৃষ্টি হয়। বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার জন্য চিকিৎসকরা শুরুর দিকে আলট্রাসনোগ্রাম করে ভ্রুণের অবস্থান দেখে নেন। অনেক সময় গর্ভকালীন সময়ে জরায়ু বা প্রস্রাবে ইনফেকশন হতে পারে। এ সময়েও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকা এবং যৌন আচরণে সংযত হওয়া প্রয়োজন। নইলে ভ্রুণ বা জরায়ুর ক্ষতি হতে পারে’।
তিনি বলেন, ‘মেনোপজের আগে ও পরে জরায়ুর কিছু পরিবর্তন দেখা যায়। মেনোপজ হওয়ার আগে অনেকের বেশি ব্লিডিং হয়। অনেক সময় যোনিপথ শুষ্ক হয়ে যায়।
বিষয়টিকে অনেকে জরায়ুর সমস্যা মনে করে ভয় পান। মেনোপজের পর অনেকের জরায়ু বড় হয়ে যায়। পরিস্থিতি এমন হয় যে মনে হয় জরায়ু বাইরে বেরিয়ে আসছে ইত্যাদি। তাই এ সময়ে এ ধরনের সমস্যা হলে চিকিৎসকের কাছে যাওয়া উচিত।’
সাধারণত জরায়ুতে সমস্যা হলে এর উপসর্গগুলো কেমন হয় জানতে চাইলে বিশিষ্ট স্ত্রী রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. মালিহা রশিদ বলেন, ‘মাসিকের সময় অতিরিক্ত রক্তস্রাব, তলপেটে ব্যথা, মাসিকের নির্ধারিত সময় পার হয়ে যাওয়ার পর মাসিক না হওয়া, দুর্গন্ধযুক্ত সাদা স্রাব, পুঁজযুক্ত ঋতুস্রাব, সহবাসের পর রক্ত বের হওয়া, মাসিক ছাড়া রক্তস্রাব ইত্যাদি। এ ধরনের কোনো উপসর্গের সাথে জ্বর থাকলে কিংবা পেট ব্যথা, পেটের যে কোনো সমস্যা বা অতিরিক্ত গ্যাস, কোষ্ঠ্যকাঠিন্য দেখা দিলেও স্ত্রী রোগ চিকিৎসকের কাছে যাওয়া উচিত। কেননা এ ধরনের সমস্যায় জরায়ু বা ডিম্বাশয়ের রোগ হতে দেখা যায়।’
সাবধান হওয়ার জন্য বা কিছু লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে বলেন ডা. মালিহা। ‘যেমন- নিম্নাঙ্গের চারপাশে চাপ লাগা, ঘন ঘন মূত্রত্যাগ, গ্যাস, বদহজম, কোষ্ঠ্যকাঠিন্য, হালকা খাবার খেলেও মনে হয় পেট ভর্তি, পেটে কোনো ধরনের অস্বাভাবিকতা, পেটে অতিরিক্ত ব্যথা, পেট ফুলে থাকা, বমি বমি ভাব বা বমি হওয়া, ক্ষুধা কম, ওজন কম বা বেশি হওয়া, যৌন মিলনে ব্যথা হওয়া, অতিরিক্ত ক্লান্তি এবং মেনোপজের পরেও এ ধরনের কোনও সমস্যা থাকা ইত্যাদি।’
সাধারণত অল্প বয়সে বিয়ে, অল্প বয়সে সন্তান হওয়া, ঘন ঘন সন্তান ধারণ, পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার অভাব, ইনফেকশন, তামাক গ্রহণ বা ধূমপান, বংশগত ইত্যাদি কারণে জরায়ু ক্ষতিগ্রস্ত হয় বা জরায়ুতে নানা ধরনের রোগ হয়ে থাকে।
‘সরকার এ বিষয়ে বিশেষভাবে সচেতন। তাই দেশের প্রত্যেক জেলা ও সদর হাসপাতালগুলোতে জরায়ু এবং ব্রেষ্ট ক্যান্সারের জন্য কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা ফ্রিভাবে করানো হয় এবং স্বল্প মূল্যে এ সংক্রান্ত চিকিৎসাও রয়েছে। এজন্য এ ধরণের কোনো সমস্যা দেখা দিলে হাসপাতাল, স্বাস্থ্যকেন্দ্র বা চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে’- বললেন ডা. আশরাফুন নেসা।
তবে যেখানে নিম্নবিত্ত নারীরা বাস করেন যেমন, বস্তি বা যৌনকর্মীদের আবাসস্থল, সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠী এবং প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের নারীরা যাতে বিষয়গুলো জানতে পারেন সেজন্য এ বিষয়ে সে সব জায়গায় এ বিষয়ে ক্যাম্পেইন হলে নারীরা বিশেষভাবে উপকৃত হবেন এমনই বলছেন সংশ্লিষ্টজন।