ঢাকা, ১৬ এপ্রিল, ২০২৫ (বাসস) : দেশব্যাপী নতুন উদ্দীপনায় ও শান্তির বার্তা নিয়ে সর্বজনীনভাবে এ বছর বাংলা নববর্ষ ১৪৩২ উদযাপিত হয়েছে।
এবারের বাংলা নববর্ষ বাংলাদেশের সকল নাগরিক, বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের কাছে অন্যরকম এক উৎসবের আবহ তৈরি করেছে।
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সার্বিক তত্ত্বাবধানে এই প্রথমবারের মতো দেশের সকল নাগরিক, সকল সম্প্রদায় ও নৃ-গোষ্ঠী ঐক্যবদ্ধভাবে উদযাপন করে সর্বজনীন উৎসব ‘পহেলা বৈশাখ’।
জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে এ দেশের সকল শ্রেণি পেশার-মানুষ একাকার হয়ে বরণ করে নিয়েছে ১৪৩২ বাংলা বছরকে।
সংবাদপত্রগুলোতে পহেলা বৈশাখের তাৎপর্য তুলে ধরে বিশেষ ফিচার প্রকাশ করা হয়েছে। বাংলাদেশ টেলিভিশন, বাংলাদেশ বেতার এবং বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলসহ অন্যান্য প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া বিশেষ অনুষ্ঠান সম্প্রচার করেছে।
দিনটি উদযাপন উপলক্ষে সরকারের নেয়া বিভিন্ন কর্মসূচির পাশাপাশি, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, জেলা ও উপজেলা প্রশাসন, মহানগর ও পৌরসভা এবং বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন নিজস্ব কর্মসূচি পালন করে।
পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠান ঘিরে ঢাকাসহ সারাদেশে কঠোর নজরদারি নিশ্চিত করে র্যাব, পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। যে কোনো পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সর্বোচ্চ প্রস্তুত ছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।
রমনা বটমূল, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, টিএসসি, শাহবাগ, রবীন্দ্র সরোবর, মানিক মিয়া এভিনিউ, হাতিরঝিলসহ সারাদেশে জনসমাগমস্থলে র্যাব ও পুলিশের পর্যাপ্ত সদস্য মোতায়েন ছিল। বৈশাখের অনুষ্ঠান ঘিরে ইভটিজিংসহ কোনো ধরনের অপতৎপরতা হয়নি।
পহেলা বৈশাখে এ বছর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ব্যান্ডশো’র আয়োজন করা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার আয়োজনে বের হয় ‘বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা’। রবীন্দ্র সরোবরে দিনব্যাপী অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এছাড়া মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে বিকেলে কনসার্টসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। মূল অনুষ্ঠান হয় রমনা বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণের আয়োজনে ।
র্যাবের মোটরসাইকেল পেট্রোল, গাড়ি পেট্রোল, চেকপোস্ট, অবজারভেশন টাওয়ার এবং গোয়েন্দা নজরদারি অব্যাহত ছিল। কেউ যাতে এ অনুষ্ঠান নিয়ে অপপ্রচার চালাতে না পারে সে কারণে সাইবার ওয়ার্ল্ডে মনিটরিং করা হয়েছিল।
এ বিষয়ে রাজধানীর শান্তিনগর এলাকার বাসিন্দা সালাউদ্দিন জানান, এ বছর পহেলা বৈশাখ শান্তিপূর্ণ ও উৎসবমুখর পরিবেশে অনুষ্ঠিত হয়েছে। প্রতি বছরের মতো এবারও তিনি রমনা বটমূলে পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানে অংশ নেন। রমনা বটমূলে পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানে অংশ নেয়া সোহেল রানা বলেন, এ বছর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা তৎপর থাকায় সন্ত্রাসীরা কোনো ধরনের নাশকতা করতে পারেনি।
‘এসো হে বৈশাখ’ গানের সুর এবং বাঙালির লোক গান, প্রদর্শনী, র্যালি, আল্পনা, নানা বর্ণের ফেস্টুনে রঙিন হয়ে ওঠে ঢাকাসহ দেশের রাজপথ। নারী পুরুষ, শিশু-কিশোর রং বেরঙের পোশাকে সজ্জিত হয়ে মেতে উঠে বর্ষবরণের আনন্দে। রমনার বটমূল থেকে শাহবাগ, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, হাইকোর্ট-প্রেসক্লাব, রাজপথ অলিগলি সবখানে ভোর থেকে উৎসবমুখর মানুষের পদচারণা। যেন এ এক নতুন বাংলাদেশ।
দিনটিকে স্বাগত জানাতে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি, তিন পার্বত্য জেলা এবং অন্যান্য নৃ-গোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক দল রাজধানীতে শোভাযাত্রা বের করে। পহেলা বৈশাখকে স্বাগত জানাতে ভোরে রমনা বটমূলে শুরু হয় ছায়ানটের বর্ষবরণের আয়োজন। বাংলা একাডেমি এবং বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশন (বিসিক), বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে এবং বাংলাদেশ লোকশিল্প ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন বৈশাখী মেলার আয়োজন করে।
বাংলা বছরের প্রথম দিনটিকে উৎসবমুখর করে তুলতে বের হয় শোভাযাত্রা। দেশের বিভিন্ন স্থানে বসে বৈশাখী মেলা। মেলাগুলোতে মেলে স্থানীয় কৃষিজাত দ্রব্য, কারুপণ্য, লোকশিল্পজাত পণ্য, কুটির শিল্পজাত সামগ্রী, সব প্রকার হস্তশিল্পজাত ও মৃৎশিল্পজাত সামগ্রী, খেলনা এবং বিভিন্ন লোকজ খাদ্যদ্রব্য চিড়া, মুড়ি, খৈ, বাতাসা, বিভিন্ন প্রকার মিষ্টি প্রভৃতির বৈচিত্র্যময় সমারোহ। গ্রামে, নগরে ও বন্দরে বাঙালির আনন্দঘন লোকায়ত সংস্কৃতি মেলায় বসে নাগরদোলা, পুতুলনাচ, যাত্রা, লোকজ গানের আসর। এই বিনোদন বাঙালি সমাজের হাজার বছরের এক শাশ্বত রূপ।
র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) মহাপরিচালক (ডিজি) এ কে এম শহিদুর রহমান পহেলা বৈশাখের আগে রোববার (১৩ এপ্রিল) সকালে রমনা বটমূলের নিরাপত্তা ব্যবস্থা পর্যবেক্ষণ শেষে এক ব্রিফিংয়ে জানিয়েছিলেন,পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠান ঘিরে ঢাকাসহ সারাদেশে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়েছে। যে কোনো পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থানে থাকবে র্যাব।
তিনি বলেছেন, নিরাপত্তা দিতে মোটরসাইকেল পেট্রোল, গাড়ি পেট্রোল, চেকপোস্ট, অবজারভেশন টাওয়ার এবং গোয়েন্দা নজরদারি অব্যাহত রয়েছে। সাইবার ওয়ার্ল্ডেও মনিটরিং চলছে।
একই স্থানে পুলিশ কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী রমনা বটমূলের নিরাপত্তা ব্যবস্থা পর্যবেক্ষণ শেষে এক ব্রিফিংয়ে পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানকে ঘিরে ঢাকায় ১৮ হাজার পুলিশ মোতায়েন থাকার কথা জানিয়েছিলেন। তিনি বলেছেন, ঢাকাকে ২১টি বিভাগে ভাগ করে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে।
বর্তমান সরকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের অক্লান্ত পরিশ্রমের কারণে এবার দেশবাসী উৎসবমুখর ও শান্তিপূর্ণভাবে বাংলা নববর্ষ-১৪৩২ সালের পহেলা বৈশাখ উদযাপিত হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
জানা গেছে পাকিস্তান আমলে ১৯৬৭ সালে ছায়ানট রমনা বটমূলে পহেলা বৈশাখ উদযাপন শুরু করে। বাংলাদেশে পহেলা বৈশাখের প্রথম অনুষ্ঠান হয়েছিল ১৯৫১ সালে। আয়োজক ছিল একটি 'লেখক-শিল্পী-মজলিশ' নামের সংগঠন, যার নেতৃত্বে ছিলেন প্রখ্যাত কিছু শিক্ষাবিদ, শিল্পী ও সাংবাদিক।