ঢাকা, ২৫ এপ্রিল, ২০২৫ (বাসস) : কাশ্মীরের পাহালগামে ভয়াবহ বন্দুক হামলার জন্য পাকিস্তানকে দায়ী করার পর বৃহস্পতিবার ভারত ও পাকিস্তান পাল্টাপাল্টি কূটনৈতিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।
নয়াদিল্লি থেকে এএফপি জানায়, মঙ্গলবার পর্যটনকেন্দ্র পাহালগামে ২৬ বেসামরিক নাগরিক হত্যার ঘটনায় জড়িতদের খুঁজে বের করে শাস্তি দেওয়ার অঙ্গীকার করে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেন, পাকিস্তান 'সীমান্তপারে সন্ত্রাসে' সহায়তা করছে।
'আমি বিশ্বকে বলছি: ভারত প্রতিটি সন্ত্রাসী এবং তাদের পৃষ্ঠপোষকদের শনাক্ত করবে, অনুসরণ করবে ও শাস্তি দেবে,' হামলার পর প্রথমবারের মতো দেওয়া এক ভাষণে তিনি বলেন। 'আমরা তাদের পৃথিবীর শেষ সীমানা পর্যন্ত তাড়া করব।'
কাশ্মীরে ভারতীয় পুলিশ জানিয়েছে, পলাতক তিন বন্দুকধারীর মধ্যে দুজন পাকিস্তানি নাগরিক।
মুসলিম-সংখ্যাগরিষ্ঠ বিতর্কিত কাশ্মীর অঞ্চলের পাহালগামে হামলাটি গত ২৫ বছরে বেসামরিক নাগরিকদের ওপর সবচেয়ে ভয়াবহ হামলা, যেখানে নিরাপত্তা বাহিনী লক্ষ্যবস্তু ছিল না।
এই হামলার পর বুধবার রাতে নয়াদিল্লি ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের পানি বণ্টন চুক্তি স্থগিত করে, মূল স্থল সীমান্তপথ বন্ধ ঘোষণা করে, কূটনৈতিক সম্পর্ক হ্রাস করে এবং পাকিস্তানি নাগরিকদের ভিসা বাতিল করে।
বৃহস্পতিবার পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফ সেনাপ্রধান আসিম মুনিরসহ শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তাদের নিয়ে বিরল জাতীয় নিরাপত্তা কমিটির বৈঠক আহ্বান করেন।
বৈঠক শেষে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে বলা হয়,' পাকিস্তানের সার্বভৌমত্ব ও জনগণের নিরাপত্তার প্রতি যেকোনো হুমকির জবাব দেওয়া হবে কঠোর পাল্টা পদক্ষেপের মাধ্যমে।'
"যথাযথ তদন্ত ও যাচাইযোগ্য প্রমাণ ছাড়াই পাহালগাম হামলার সঙ্গে পাকিস্তানকে জড়ানো অর্থহীন, যুক্তিহীন ও বিপরীতমুখী," বলা হয় ওই বিবৃতিতে।
- ‘তাৎক্ষণিক দেশত্যাগ’-
পাকিস্তান পাল্টা যে পদক্ষেপগুলো ঘোষণা করেছে তার মধ্যে রয়েছে ভারতীয় কূটনীতিকদের বহিষ্কার, ভারতীয় নাগরিকদের (শিখ তীর্থযাত্রী ব্যতীত) ভিসা বাতিল এবং ভারতীয় সামরিক উপদেষ্টাদের 'তাৎক্ষণিক পাকিস্তান ত্যাগের নির্দেশ'।
পাকিস্তান জানায়, সীমান্তবর্তী প্রধান স্থলপথ দু’দেশের উভয় প্রান্তেই বন্ধ করে দেওয়া হবে।
এছাড়া পাকিস্তান হুঁশিয়ার করে বলেছে, যদি ভারত সিন্ধু নদ থেকে পানি সরবরাহ বন্ধের চেষ্টা করে, তবে তা 'যুদ্ধ ঘোষণার সামিল হবে।'
যদিও এখন পর্যন্ত নেওয়া পদক্ষেপগুলো প্রতীকী, তবে কেউ কেউ আশঙ্কা করছেন, নয়াদিল্লির কূটনৈতিক পদক্ষেপ কেবল শুরু — যা পারমাণবিক শক্তিধর প্রতিবেশী দুই দেশের মধ্যে সামরিক উত্তেজনার ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।
২০১৯ সালে কাশ্মীরে আত্মঘাতী হামলায় ৪১ জন ভারতীয় সেনা নিহত হলে ভারত পাকিস্তানের অভ্যন্তরে বিমান হামলা চালিয়েছিল।
অটারি-ওয়াঘা সীমান্তে পাকিস্তানি নাগরিকরা দেশ ছাড়তে শুরু করেছেন।
'আমরা কেবল বাড়ি ফিরতে চাই,' ক্লান্ত চেহারার করাচির মেহনাজ বেগম বলেন।
- ‘মেরুদণ্ড ভেঙে দেব’ -
ভারতীয় পুলিশের দাবি, তিন বন্দুকধারী পাকিস্তানভিত্তিক লস্কর-ই-তাইয়বা (খবঞ) গোষ্ঠীর সদস্য, যাকে জাতিসংঘ সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত করেছে। প্রত্যেক হামলাকারীর তথ্যদাতাকে ২০ লাখ রুপি (২৩,৫০০ ডলার) পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে।
মোদি নিহতদের স্মরণে দুই মিনিট নীরবতা পালন করেন, যাদের মধ্যে কেবল একজন ছাড়া বাকি সবাই ছিলেন ভারতীয়।
'আমি স্পষ্ট করে বলছি: যারা এই হামলা করেছে এবং যারা পরিকল্পনা করেছে, তাদের এমন শাস্তি দেওয়া হবে যা কল্পনারও বাইরে,' বিহার সফরে দেওয়া হিন্দি ভাষণের এক পর্যায়ে বলেন মোদি।
'এই সন্ত্রাসীদের হাতে যেটুকু জমি আছে, তা মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়ার সময় এসেছে। ১৪০ কোটি ভারতীয়র ইচ্ছাশক্তি তাদের মেরুদণ্ড ভেঙে দেবে।'
হামলার পর থেকে মোদির সঙ্গে একাধিক বিশ্বনেতা শোক প্রকাশ করেছেন, যাদের মধ্যে আছেন ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু, ইতালির প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনি এবং ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁ, বৃহস্পতিবার জানিয়েছে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
কাশ্মীর অঞ্চলটি ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার পর থেকেই ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে বিভক্ত, তবে দুই দেশই সম্পূর্ণ অঞ্চলটির মালিকানা দাবি করে।
১৯৮৯ সাল থেকে ভারত-শাসিত কাশ্মীরে বিচ্ছিন্নতাবাদীরা স্বাধীনতা অথবা পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার দাবিতে বিদ্রোহ চালিয়ে আসছে।
হামলাকারীদের ধরতে ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনী ব্যাপক অভিযান চালাচ্ছে এবং অনেককে আটক করা হয়েছে।
কাশ্মীরের বাসন্তগড়ে বৃহস্পতিবার বন্দুকধারীদের সঙ্গে সংঘর্ষে একজন ভারতীয় সেনা নিহত হয়েছে বলে জানায় ভারতীয় সেনাবাহিনী।
- ‘ভেঙে পড়েছি, হতবাক’-
কাশ্মীরের প্রধান শহর শ্রীনগরে বৃহস্পতিবার পরিস্থিতি শান্ত থাকলেও পাহালগামের ঘটনায় মানুষ আতঙ্কিত ও পর্যটনখাত মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
'যাদের সঙ্গেই কথা বলেছি, সবাই ভেঙে পড়েছে, হতবাক,' বলেন কাশ্মীরি ইতিহাসবিদ ও রাজনৈতিক ভাষ্যকার সিদ্বি ওয়াহিদ।
মঙ্গলবারের হামলাটি ঘটে যখন পাহাড়ঘেরা মনোরম এলাকায় পর্যটকরা প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করছিলেন, তখন হঠাৎ জঙ্গলে থেকে বেরিয়ে এসে হামলাকারীরা স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র দিয়ে গুলিবর্ষণ করে।
ভারতীয় গণমাধ্যমকে দেওয়া বর্ণনায় বেঁচে যাওয়া ব্যক্তিরা জানান, বন্দুকধারীরা পুরুষদের লক্ষ্য করেছিল এবং যারা ইসলামি শাহাদাহ উচ্চারণ করতে পারছিল, তাদের রেহাই দিয়েছিল।
পাকিস্তানে বৃহস্পতিবার বিভিন্ন ধর্মীয় সংগঠন ও কর্মীরা ভারতবিরোধী বিক্ষোভ করেছে।
এই হামলায় ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠীগুলো এবং ভারতের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কাশ্মীরি শিক্ষার্থীরা হয়রানি ও ভয়ভীতির শিকার হওয়ার অভিযোগ করেছেন।
'এটি একটি পরিকল্পিত বিদ্বেষমূলক প্রচার অভিযান, যা একটি নির্দিষ্ট অঞ্চল ও পরিচয়ের শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করে চালানো হচ্ছে,' মন্তব্য করেন জম্মু ও কাশ্মীর স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের আহ্বায়ক নাসির খুইহামি।