প্রতিবেদন: এনামুল হক এনা
পটুয়াখালী, ২৪ এপ্রিল, ২০২৫ (বাসস): বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সম্মুখসারির যোদ্ধা মো. আলী আজগর সুজন রাজধানীর বংশালে আন্দোলনের সময় গুলিবিদ্ধ হন। উন্নত চিকিৎসার অভাবে এখনও মাথায় বুলেট নিয়ে দিন কাটছে তার। যন্ত্রণার তীব্রতায় রাতে ঘুম হয় না। কোনো রাজনৈতিক দল বা সংগঠন এগিয়ে আসেনি তার পাশে। সরকারি বা বেসরকারিভাবে কোনো সহায়তাও পাননি তিনি।
মো. আলী আজগর সুজন (৩০) পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলার বাউফল সদর ইউনিয়নের গোসিনগা গ্রামের শাহ আলম মৃধা ও শাহানুর হেগমের ছেলে।
সরেজমিনে রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা (বাসস)-এর ভ্রাম্যমাণ প্রতিবেদক তার বাড়িতে গেলে আহত হওয়ার ঘটনা বর্ণনা দিয়ে জুলাইযোদ্ধা আলী আজগর সুজন বলেন, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশে আমরা ২৪ জুলাই গ্রাম থেকে ঢাকায় রওনা দিয়েছিলাম।
২৫ জুলাই ঢাকায় অবস্থান করি। সেদিন থেকে প্রতিদিন রাজপথে আন্দোলনে যুক্ত হই। একেকদিন একেক স্পটে আন্দোলন করেছি। ৫ আগস্ট দুপুরের দিকে আমি বংশাল থানার কাছে গুলিবিদ্ধ হই। গুলি খেয়ে স্পটেই তিন ঘণ্টা পড়ে ছিলাম।
পরে সেখান থেকে আমার বন্ধুরা আমাকে মিটফোর্ড হাসপাতালে নিয়ে আসে। পরে ওই হাসপাতালে ভর্তি ছিলাম। তিনদিন কোনো কথা বলতে পারিনি। ওখানকার ডাক্তাররা বলছিল আমার উন্নত চিকিৎসা লাগবে।
কিন্তু আমার বাবা কৃষক আর আমি ছোট দোকান করি। টাকা পয়সা ম্যানেজ করতে পারিনি বলে সেই উন্নত চিকিৎসা করানোও সম্ভব হয়নি। আমার পরিবারের খাওয়ার খরচ জোগাড় করতেই দিন যায়। সেখানে কিভাবে ভালো চিকিৎসা করাব আমি।
ঘটনার বর্ণনা
সুজন বলেন, ৫ আগস্ট আমরা যখন বিজয় মিছিল নিয়ে যাচ্ছিলাম থানার সামনে দিয়ে, ঠিক তখনই আমাদের ওপর গুলি বর্ষণ করে পুলিশ। আমার সাথে দুটো ছেলে ছিল। একটার পিঠে প্রায় ৩০০ বুলেট লেগেছে। আরেকটার পেছনে গুলি লেগে স্পটেই মারা গেছে। তারপর থেকে আমার মাথায় আর কাজ করেনি।
পরে কাকতালীয়ভাবে একটা ময়লার ডাস্টবিন পেলাম। গুলির তীব্রতায় আমি ময়লার ডাস্টবিনকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেছি, যার ফুটেজও ভাইরাল হয়েছে। ওই সময় আমাদেরকে অতর্কিত গুলি করা হয়েছিল।
যখন আমার গায়ে গুলি লাগে তখন পুলিশ বলছিল—ওর গায়ে গুলি লেগেছে। ও শেষ। মানে এতটা কাছ থেকে তারা গুলি করেছে আমাকে। বিজয় মিছিলে অংশ নেওয়া আমার বন্ধুরা আমাকে তখন ডাকাডাকি করছিল—সুজন, তুই ফিরে আয়। কিন্তু আমি ওদের বলেছি, আমার ভাইদের রাজপথে একা রেখে আমি ফিরব না।
সুজন বলেন—আমার চোখে সানগ্লাস ছিল। সানগ্লাসে একটি বুলেট ঢুকে বের হয়ে গেছে। যার ছবিও আছে। আমার সারা শরীরে ছররা গুলি লেগেছে। গুলি লেগে দাঁত পড়ে গেছে। আর মাথায় লেগেছে ১১টি। এরমধ্যে মাথা থেকে কয়েকটি বুলেট বের করা হয়েছে। আর কয়েকটি এখনও আছে। বের করা সম্ভব হয়নি।
আমার মাথায় এখনও তিনটা বুলেট আছে। খুব যন্ত্রণা দেয় আমাকে। আমি রোদে যেতে পারি না। রোদে গেলেই আমার ব্যথা করে। আমি জোরে কথা বলতে পারি না। দাঁড়াতে গেলে মেরুদণ্ডে ব্যথা পাই। রাতে আমি ঘুমাতে পারি না। অসহনীয় যন্ত্রণায় ছটফট করি। আমার উন্নত চিকিৎসা দরকার।
জুলাইযোদ্ধা সুজনের চাওয়া
দেশের মানুষের মুক্তির জন্য আমরা রাজপথে লড়েছি। তাই বর্তমান সরকারের কাছে আমার চাওয়া—আহত জুলাইযোদ্ধাদের যেন উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়। আর আহতদের পরিবারের আর্থিক সহায়তার দিক বিবেচনা করা হয়।
যারা হত্যাকারী আর হত্যার নির্দেশদাতা তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই। আমি ইউনূস সরকারের কাছে প্রথমত, আমার সুস্থতা চাই। কেননা আমি সুস্থ থাকলে আমার স্ত্রী ও সন্তানদের দেখতে পারব। দ্বিতীয়ত, সরকার যদি আমাকে একটা কর্মসংস্থানের জায়গা করে দেয় তাহলে আমার জন্য সবচেয়ে ভালো হয়।
সুজনের মায়ের কথা
কান্নাজড়িত কণ্ঠে সুজনের মা শাহানুর বেগম (৫৫) বলেন, যারা আমার ছেলেকে গুলি করেছে তাদের বিচার চাই। আমার ছেলে যখন যন্ত্রণায় রাতে ঘুমাতে পারে না তখন মা হিসেবে আমার কলিজাটা ফেটে যায়।
শাহানুর বেগম বলেন, সরকার যেন আমার ছেলের উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করে দেন। আর একটা সরকারি চাকরির ব্যবস্থা করে দেন। তাহলে আমার ছেলেটা বাকি জীবন ভালোভাবে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে কাটিয়ে দিতে পারবে। এটাই একজন মায়ের অনুরোধ সরকারের কাছে।
বাবা শাহ আলম মৃধার দাবি
মো. শাহ আলম মৃধা (৬২) বলেন, আমার ছেলে যখন মাথায় গুলি থাকার কারণে রাতে ঘুমাতে পারে না তখন আমার খুব খারাপ লাগে। যারা আমার ছেলেকে গুলি করেছে আমি তাদের দৃষ্টান্তমূলক বিচার চাই।
তিনি বলেন, আমার সামর্থ্য দিয়ে আমি ছেলের চিকিৎসা করছি। এখন সরকার যেন আমার ছেলেকে ভালো চিকিৎসার ব্যবস্থা করে দেন। আর তার পরিবার নিয়ে চলার জন্য একটি সরকারি চাকরি দেওয়ার ব্যবস্থা করে দেন। এটাই আমার সরকারের কাছে চাওয়া।