ঢাকা, ২ জুন, ২০২৫ (বাসস) : বিচার ব্যবস্থাকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করতে সক্রিয় মাদকচক্র ও অন্যান্য গোষ্ঠীগুলোর উপস্থিতির মধ্যেই রোববার এক নজিরবিহীন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে মেক্সিকোতে, যেখানে ভোটাররা সরাসরি ভোটের মাধ্যমে বিচারপতি নির্বাচন করেছেন।
মেক্সিকো সিটি থেকে এএফপি জানায়, সরকার জানিয়েছে, এ সংস্কারের মাধ্যমে মেক্সিকো হয়ে উঠেছে বিশ্বের একমাত্র দেশ, যেখানে সব বিচারপতি ও ম্যাজিস্ট্রেট সরাসরি জনগণের ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত হন। এটি দুর্নীতি ও দায়মুক্তির সংস্কৃতি মোকাবেলার প্রয়াস বলেও দাবি করা হয়েছে।
ভোটের আগের দিন এক ভিডিও বার্তায় প্রেসিডেন্ট ক্লাউদিয়া শেইনবাউম বলেন, ‘যারা বিচার বিভাগের দুর্নীতি ও বিশেষাধিকারের পুরনো শাসন বজায় রাখতে চায়, তারাই বলছে এই নির্বাচনে কারচুপির কথা বলছে। কোনো রাজনৈতিক দল যাতে সুপ্রিম কোর্ট দখল করতে পারে সেজন্যও তারা এসব বলছেন।'
তিনি আরও বলেন, ‘এই অভিযোগগুলোর সত্যের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই।’
৫৭ বছর বয়সী অবসরপ্রাপ্ত আর্তুরো গিসেমান বলেন, ‘বর্তমান বিচার বিভাগের দুর্নীতির প্রতি আমার ঘৃণাই আমাকে ভোট দিতে উৎসাহিত করেছে।’
তবে সমালোচক ও বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, এতে বিচার বিভাগ রাজনীতিকরণের শিকার হতে পারে এবং অপরাধীরা আরও সহজে হুমকি ও ঘুষের মাধ্যমে আদালতকে প্রভাবিত করতে সক্ষম হবে।
জাতিসংঘের বিচারপতি ও আইনজীবীদের স্বাধীনতা বিষয়ক বিশেষ দূত মার্গারেট স্যাটারথওয়েট এএফপিকে বলেন, ‘যদিও দুর্নীতি আগে থেকেই আছে, তথাপি নির্বাচনের মাধ্যমে বিচারপতি বাছাইয়ের এই পদ্ধতিতে সংগঠিত অপরাধচক্রের অনুপ্রবেশের আশঙ্কা আরও বেড়ে গেছে।’
এই সংস্কারের বিরোধিতাকারী শত শত মানুষ মেক্সিকো সিটিতে পতাকা ও প্ল্যাকার্ড হাতে মিছিল করেছে। তাদের প্ল্যাকার্ডে লেখা ছিল: ‘আমাদের গণতন্ত্র থেকে হাত সরাও’ ও ‘নির্বাচনি জালিয়াতি চাই না’।
বিতর্কিত প্রার্থীরা
ভোটকে ঘিরে মেক্সিকোয় রাজনীতিকদের বিরুদ্ধে যেভাবে সহিংসতা হয়, এবার তা দেখা যায়নি।
তবে মেক্সিকোর নির্বাচন কমিশনের সাবেক প্রধান এবং বর্তমান পরামর্শক লুইস কার্লোস উগালদে বলেন, ‘এটা স্বাভাবিক যে সংগঠিত অপরাধচক্রগুলো তাদের পছন্দের বিচারপতি ও প্রার্থীদের কাছে আগেই পৌঁছে গেছে।’
শেইনবাউমের কার্যালয়ের আইনজীবী কার্লোটা রামোস বলেন, ‘সংগঠিত অপরাধচক্র যে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে অনুপ্রবেশের চেষ্টা করবে, সেটা বাস্তবতা। তবে নতুন পদ্ধতিতে বিচারপতি হতে চাওয়া প্রার্থীদের ওপর আরও বেশি নজরদারি সম্ভব।’
মানবাধিকার সংস্থা ডেফেনসরক্স এমন ২০ জন প্রার্থীর একটি তালিকা প্রকাশ করেছে, যাদের তারা ‘উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ’ বলে মনে করে। এদের মধ্যে আছেন সিলভিয়া দেলগাদো, যিনি ছিলেন সিনালোয়া কার্টেলের সহ-প্রতিষ্ঠাতা জোয়াকিন ‘এল চাপো’ গুজমানের আইনজীবী।
উত্তরাঞ্চলীয় নুয়েভো লেওন রাজ্যে বিচারপতি পদপ্রার্থী ফের্নান্দো এসকামিয়া ছিলেন লস জেটাস কার্টেলের বর্বর নেতা মিগেল অ্যাঞ্জেল ত্রেভিনোর আইনজীবী।
ডুরাঙ্গো রাজ্যে এক প্রার্থী যুক্তরাষ্ট্রে মাদক সংক্রান্ত অপরাধে প্রায় ছয় বছর কারাভোগ করেছিলেন।
‘সুনাম’ থাকতে হবে
ভোটারদের প্রায় ৮৮০ জন ফেডারেল বিচারক—এর মধ্যে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিরাও ছিলেন—এবং শত শত স্থানীয় বিচারক ও ম্যাজিস্ট্রেট নির্বাচনের দায়িত্ব দেওয়া হয়। অবশিষ্ট পদগুলোর জন্য পরবর্তী নির্বাচন হবে ২০২৭ সালে।
প্রার্থীদের অবশ্যই আইন বিষয়ে ডিগ্রি, সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতা এবং ‘ভালো সুনাম’ থাকতে হবে। সেই সঙ্গে কোনো ফৌজদারি মামলার রেকর্ড থাকা যাবে না।
তবে জটিলতার কারণে অনেক ভোটার ভোট দিতে না-ও যেতে পারেন বলে ইঙ্গিত পাওয়া গেছে।
সান দিয়েগো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডেভিড শার্ক বলেন, ‘সঠিকভাবে ভোট দিতে হলে ভোটারদের শত শত প্রার্থীর পেছনের ইতিহাস ও প্রোফাইল ঘেঁটে দেখার জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা ব্যয় করতে হবে।’
তাঁর মতে, মেক্সিকোর বিচার ব্যবস্থায় অধিকাংশ দুর্নীতি আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও সরকারি কৌঁসুলিদের দপ্তরেই সীমাবদ্ধ।
শার্ক বলেন, ‘আপনি যদি কোনোভাবে অভিযুক্ত না হন, তাহলে বিচারকের কাছে পৌঁছানোর কথাই আসে না।’
এই বিচারিক সংস্কার শেইনবাউমের পূর্বসূরি এবং রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষক আন্দ্রেস ম্যানুয়েল লোপেস ওব্রাদরের দ্বারা প্রবর্তিত। তিনি বিচার বিভাগ নিয়ে প্রায়শই বিরোধে জড়াতেন এবং গত বছর পদত্যাগ করেন।
শার্ক বলেন, ‘এই নির্বাচন আয়োজনের মূল কারণ সম্ভবত লোপেস ওব্রাদরের বিচারকদের প্রতি ক্ষোভ থেকেই এসেছে।’
দীর্ঘদিন পর জনসম্মুখে এসে দক্ষিণ মেক্সিকোর নিজ খামারের কাছে ভোট দেন লোপেস ওব্রাদর। এ সময় তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমাদের দেশের ইতিহাসে আগে কখনও মানুষ সরাসরি বিচারপতি নির্বাচনের অধিকার পায়নি।’
এদিকে মেক্সিকোর নির্বাচন কর্তৃপক্ষ রোববার জানিয়েছে, বিচারপতি নির্বাচনে প্রথমবারের মতো আয়োজিত এ ভোটে মাত্র প্রায় ১৩ শতাংশ ভোটার তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছেন।
প্রায় ১০ কোটি ভোটারের মধ্যে মাত্র ১২ দশমিক ৫৭ থেকে ১৩ দশমিক ৩২ শতাংশ ভোটারই ভোট দিয়েছেন বলে জানান জাতীয় নির্বাচন ইনস্টিটিউটের প্রধান গুয়াদালুপে তাদেই। তিনি এক টেলিভিশন বিবৃতিতে এ তথ্য জানান।