
বরুন কুমার দাশ
ঢাকা, ২৫ নভেম্বর, ২০২৫ (বাসস): শুধু বাংলাদেশ নয়, বরং সারা বিশ্বেই ক্যান্সার রোগীর সংখ্যা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। তাই ক্যান্সার রোগীদের যথাযথ সেবা প্রদানের লক্ষ্যে বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএমইউ) অধীনে একটি স্বতন্ত্র ক্যান্সার ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করা হবে।
বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএমইউ) ক্লিনিক্যাল অনকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান ও স্বাস্থ্য সংস্কার কমিশনের সদস্য অধ্যাপক ডা. সৈয়দ আকরাম হোসেন বাসসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এ তথ্য জানান।
তিনি বলেন, ‘সিঙ্গাপুরে ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির অধীনে তাদের ন্যাশনাল ক্যান্সার ইনস্টিটিউট রয়েছে। এছাড়াও পৃথিবীর যেসব দেশে মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় আছে, প্রায় সবখানেই সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ক্যান্সার ইনস্টিটিউট রয়েছে। ফলে উন্নত চিকিৎসার স্বার্থে আমরাও বিএমইউ’র অধীনে ক্যান্সার ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করছি।’
ক্যান্সার রোগীদের সংখ্যা দিন দিন কেন বাড়ছে? এমন প্রশ্নের জবাবে ডা. সৈয়দ আকরাম হোসেন বলেন, ‘বর্তমানে সারা পৃথিবীতেই ক্যান্সারের প্রকোপ বাড়ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাবেক মহাপরিচালক মার্গারেট চ্যান সতর্ক করে বলেছিলেন, এমন একটা সময় আসবে যখন প্রতিটি পরিবারে অন্তত একজন ক্যান্সার রোগী থাকবে। বিষয়টি অনেকের কাছে বিস্ময়কর মনে হলেও সেই শঙ্কা এখন বাস্তবে পরিণত হচ্ছে। অর্থাৎ সে সময় আর বেশি দূরে নয়।’
বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় ২০ লাখ ক্যান্সার রোগী রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘প্রতি বছর আড়াই থেকে তিন লাখ নতুন রোগী শনাক্ত হচ্ছেন এবং তাদের মধ্যে অর্ধেকের বেশিই মারা যাচ্ছেন। ক্যান্সারের এই ভয়াবহ বিস্তারের পেছনে প্রধান কারণ তামাক ও ভেজাল খাদ্য দায়ী।’
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে এক-তৃতীয়াংশ ক্যান্সারের সঙ্গে ধূমপান ও তামাক সেবনের সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে। তবে এর চেয়েও ভয়ের বিষয় হলো আমাদের খাদ্যচক্রে মিশে থাকা বিষাক্ত রাসায়নিক। সকালের নাস্তা থেকে শুরু করে রাতের খাবার, কোথাও যেন নিরাপত্তা নেই। দুধ ফরমালিন, মাছে ফরমালিন, পানিতে আর্সেনিক এবং ফসলে কীটনাশকের যথেচ্ছ ব্যবহার জনস্বাস্থ্যকে মারাত্মক হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে।’
খাদ্যে ভেজালের ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরে ডা. সৈয়দ আকরাম হোসেন আরো বলেন, ‘জামালপুরের বেগুন ক্ষেতের মাটিতে গ্রহণযোগ্য মাত্রার চেয়ে অনেক বেশি সিসা, নিকেল, ক্যাডমিয়াম, তামা ও দস্তার মতো ভারী ধাতু পাওয়া গেছে। মূলত সার ও বালাইনাশকের মাধ্যমে এসব ক্ষতিকর উপাদান ফসলে প্রবেশ করছে, যা রান্নার পরও নষ্ট হয় না। এছাড়া রাস্তার ধারের মুখরোচক খাবার, যেমন বেগুনি বা জিলাপি ভাজতে দিনের পর দিন একই পোড়া তেল (ব্রেক অয়েল) ব্যবহার করা হচ্ছে। মুড়িকে ধবধবে সাদা করতে মেশানো হচ্ছে ইউরিয়া। ফল পাকানোর জন্য ইথিলিন ও অন্যান্য টক্সিক সাবস্ট্যান্স (বিষাক্ত পদার্থ) ব্যবহার করা হচ্ছে। এমনকি আমরা চা বা গরম পানীয় খাওয়ার জন্য যেসব ওয়ান-টাইম প্লাস্টিকের কাপ ব্যবহার করি, তাতে গরম চা বা পানি ঢাললে প্লাস্টিক থেকে ক্যান্সার সৃষ্টিকারী রাসায়নিক উপাদান নির্গত হয়, যা অজান্তেই আমাদের শরীরে প্রবেশ করে।’
তিনি আরও বলেন, ‘পৃথিবীর মধ্যে অন্যতম দূষিত বাতাস হলো ঢাকা শহরের বাতাস। বলা হয়ে থাকে, একজন মানুষ ধূমপান করলে যতটা ক্ষতি হয়, ঢাকার দূষিত বাতাস তার চেয়েও বেশি ক্ষতি করতে পারে। কেননা গাড়ির কালো ধোঁয়া থেকে নির্গত কার্বন ডাই-অক্সাইড ও সালফার ডাই-অক্সাইড বাতাসের মান নষ্ট করছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ট্যানারি শিল্পের বর্জ্য। ট্যানারির বর্জ্য বা ঝুট পুড়িয়ে অবৈধভাবে পোল্ট্রি ফিড তৈরি করা হচ্ছে, যার মধ্যে ক্রোমিয়ামের মতো মারাত্মক ভারী ধাতু থাকে। এই খাবার খেয়ে বেড়ে ওঠা হাঁস-মুরগি, মাছ কিংবা গবাদি পশুর মাংস যখন আমরা খাচ্ছি, তখন পরোক্ষভাবে সেই বিষ আমাদের শরীরেই ঢুকছে। বিশেষ করে যাদের ফাস্টফুড পছন্দ, তারা এই বিষক্রিয়ার সবচেয়ে বড় শিকার হচ্ছেন।’
তরুণদের মধ্যে ধূমপানের প্রবণতা বেড়েছে উল্লেখ করে ডা. আকরাম বলেন, ‘সাধারণত ৭০ বছরের বেশি বয়সে ক্যান্সারের ঝুঁকি বেশি থাকে, কিন্তু বাংলাদেশে এখন ৫০ বছরের কম বয়সিদের মধ্যেও ক্যান্সার আক্রান্ত হারের সংখ্যা বাড়ছে।’
তিনি বলেন, ‘দেশে খাদ্যে ভেজাল যেমন বড় সমস্যা, তেমনি পেশাগত ঝুঁকিও ক্যান্সারের অন্যতম কারণ। উদাহরণ হিসেবে তিনি চট্টগ্রামের শিপ ব্রেকিং ইন্ডাস্ট্রির কথা উল্লেখ করেন। সেখানে ভাঙা জাহাজের ভেতরের নানা সামগ্রীতে প্রচুর পরিমাণে অ্যাসবেস্টস থাকে। এই জাহাজগুলো কাটার সময় অ্যাসবেস্টসের সূক্ষ্ম কণা বাতাসে ওড়ে এবং শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে শ্রমিকদের ফুসফুসে প্রবেশ করে, যা ফুসফুসের ক্যান্সারের নিশ্চিত কারণ। সরকারি আইন অনুযায়ী অ্যাসবেস্টসযুক্ত জাহাজ দেশে প্রবেশের অনুমতি নেই। কিন্তু সেই আইন যথাযথভাবে মানা হচ্ছে না বিধায় হাজার হাজার শ্রমিক মৃত্যুর মুখে পতিত হচ্ছেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘বর্তমানে সংক্রমণজনিত কারণেও ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ছে। যেমন, হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস (এইচপিভি), হেপাটাইটিস-বি ও সি ভাইরাস। আমাদের দেশে হেপাটাইটিস-বি এর কারণে লিভার ক্যান্সার উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। এদিকে ক্যান্সার নিয়ে মানুষের মধ্যে অনেক ভুল ধারণা বা মিথ রয়েছে। কেউ কেউ মনে করেন এটি ছোঁয়াচে রোগ বা বংশগত অভিশাপ। সচেতনতার অভাবে মানুষ বুঝতেই পারে না যে তাদের শরীরে ক্যান্সার বাসা বেঁধেছে। আমাদের দেশে ৫০ শতাংশ ক্যান্সারাক্রান্ত শুরুতেই ধরা না পড়ার কারণে মারা যান। স্তন ক্যান্সার ছাড়া অন্যান্য ক্যান্সার রোগীরা যখন চিকিৎসকের কাছে আসেন, তখন তাদের রোগ স্টেজ থ্রি বা ফোরে পৌঁছে যায়। তখন আর চিকিৎসকদের খুব বেশি কিছু করার সুযোগ থাকে না। মূলত ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা, সচেতনতা এবং যথাযথ নিয়ম মেনে চললে এসব সংক্রমণজনিত ক্যান্সার অনেকাংশেই প্রতিরোধ করা সম্ভব।’
দেশে চিকিৎসা সংকটের বিষয়ে জানতে চাইলে বিএমইউ’র এই অধ্যাপক বলেন, ‘বাংলাদেশে অন্তত ৩০০টি রেডিওথেরাপি মেশিন প্রয়োজন, কিন্তু সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে সচল মেশিন আছে মাত্র ২০টি। আমাদের মেডিকেল ইউনিভার্সিটিতে মাত্র একটি মেশিন আছে। এটিও মাঝে মাঝে ডিস্টার্ব করে। ফলে রেডিওথেরাপির জন্য রোগীদের সিরিয়াল পেতে চার মাস পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। কিন্তু ক্যান্সার রোগীদের জন্য এক-দেড় মাসের বেশি অপেক্ষা করা মানে রোগটি পুরো শরীরে ছড়িয়ে পড়া।’
ডা. সৈয়দ আকরাম বলেন, ‘শুধু সরকারি উদ্যোগে এই বিশাল সংকট মোকাবিলা সম্ভব নয়। এজন্য সরকারি ও বেসরকারি খাতের যৌথ উদ্যোগ বা পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) প্রয়োজন। বেসরকারি হাসপাতালগুলোকে ক্যান্সার চিকিৎসার যন্ত্রপাতি আমদানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধা এবং সহজ শর্তে ঋণ দিলে তারা এগিয়ে আসবে।’
তিনি বলেন, ‘প্রতিবছর চিকিৎসার জন্য দেশ থেকে প্রায় ছয় বিলিয়ন ডলার বিদেশে চলে যায়। এই অর্থ যদি দেশেই স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগ করা যায়, তাহলে অধিকাংশ রোগীর চিকিৎসা বাংলাদেশেই সম্ভব হবে। একইসাথে বিশাল অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হবে। কোভিডের সময় আমরা দেখেছি, রোগীরা দেশেই সেবা নিয়েছেন এবং চিকিৎসকরাও সফলভাবে তাদেরকে সেবা দিতে সক্ষম হয়েছেন।’
এ সময় স্বাস্থ্য সংস্কার কমিশনের সদস্য হিসেবে তিনি ক্যান্সার নিয়ন্ত্রণে বেশ কিছু সুপারিশের কথা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, ‘ক্যান্সার নিয়ন্ত্রণে কমিশনের ৩২টি সুপারিশের মধ্যে ২৮ নম্বর সুপারিশটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সেখানে জরায়ু মুখ, স্তন, ফুসফুস, হেড-নেকসহ বড় ধরনের ক্যান্সারের স্ক্রিনিং কার্যক্রম চালুর প্রস্তাব করা হয়েছে। ওরাল ক্যান্সারসহ এসব রোগ স্ক্রিনিংয়ের আওতায় আনা গেলে প্রাথমিক পর্যায়েই তা শনাক্ত করা সম্ভব হবে। এতে অনেক রোগী চিকিৎসার জটিলতা ছাড়াই বা সামান্য চিকিৎসায় সুস্থ হয়ে উঠতে পারবেন।’
তিনি প্রস্তাব করেন, দেশের প্রতিটি ১০০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালে ‘আর্লি ডিটেকশন ক্যান্সার সেন্টার’ চালু করা উচিত। সেখানে কোলোনোস্কপি, এন্ডোস্কপি, বায়োপসি, সিটি স্ক্যান ও এমআরআই সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। সরকারি হাসপাতালগুলোর পাশাপাশি বেসরকারি হাসপাতালগুলোর সঙ্গেও সরকার চুক্তি করতে পারে, যাতে রোগীরা বিনামূল্যে বা স্বল্পমূল্যে রোগ নির্ণয়ের সুযোগ পান। এতে নতুন করে অবকাঠামো তৈরির সময় ও অর্থ দুটোই বাঁচবে। তবে প্রত্যেক জেলা হাসপাতালে অন্তত একজন ক্যান্সার কনসালটেন্ট নিয়োগ দেওয়া উচিত। তাছাড়া আমাদের ৮টি বিভাগীয় মেডিকেল কলেজে নতুন ক্যান্সার সেন্টার তৈরির কাজ চলছে। এগুলো দ্রুত চালু করা গেলে ঢাকার ওপর রোগীর চাপ কমবে এবং প্রান্তিক মানুষেরা নিজ এলাকায় সেবা পাবেন।’
ক্যান্সার চিকিৎসায় ডাক্তারদের বিশেষ প্রশিক্ষণের প্রয়োজন আছে কিনা? এমন প্রশ্নের জবাবে ডা. সৈয়দ আকরাম হোসেন বলেন, ‘বিএমইউতে ইতোমধ্যে ক্যান্সার চিকিৎসায় আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার শুরু হয়েছে। রেডিওথেরাপিতে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) প্রয়োগ, টার্গেট থেরাপির জন্য নেক্সট জেনারেশন সিকোয়েন্সিং, এসব বিষয়ে গবেষণা চলছে। এছাড়া দেশ-বিদেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বিএমইউ সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষর করেছে। হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুল ও কলেজের সঙ্গেও যৌথ সহযোগিতার পরিকল্পনা রয়েছে। এর ফলে দেশের চিকিৎসকরা প্রশিক্ষণ ও গবেষণার সুযোগ পাবেন, যা রোগীদের সেবায় বড় ভূমিকা রাখবে।’
ক্যান্সারের প্রাথমিক লক্ষণগুলো সম্পর্কে জানতে চাইলে বিএমইউ’র এই চিকিৎসক বলেন, ‘দীর্ঘস্থায়ী কাশি, কাশির সঙ্গে রক্ত যাওয়া, নারীদের মাসিক ছাড়া অন্য সময়ে রক্তপাত, প্রস্রাব বা পায়খানার সঙ্গে রক্ত যাওয়া, হঠাৎ করে কোষ্ঠকাঠিন্য বা পাতলা পায়খানা হওয়া, কারণ ছাড়াই দ্রুত ওজন কমে যাওয়া এবং দীর্ঘদিনের জ্বর, এগুলো ক্যান্সারের লক্ষণ হতে পারে। এমন লক্ষণ দেখা দিলে কালক্ষেপণ না করে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।’
এ সময় তিনি নিয়মিত স্ক্রিনিংয়ের ওপর জোর দিয়ে বলেন, ‘৫০ বছরের বেশি বয়সিদের প্রোস্টেট, কোলোনোস্কপি ও ম্যামোগ্রাম করানো উচিত। নারীদের প্রতি মাসে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেই স্তন পরীক্ষা করা এবং জরায়ু মুখের ক্যান্সার প্রতিরোধে ভায়া টেস্ট বা প্যাপস স্মিয়ার টেস্ট করাতে হবে। যারা ধূমপান করেন, তাদেরকে বছরে অন্তত একবার বুকের এক্স-রে বা লো-ডোজ সিটি স্ক্যান করানো জরুরি।’
সবশেষে ডা. সৈয়দ আকরাম হোসেন বলেন, ক্যান্সার মানেই মৃত্যু নয়, যদি তা প্রাথমিক পর্যায়ে ধরা পড়ে। সচেতনতা, সঠিক খাদ্যাভ্যাস, দূষণমুক্ত পরিবেশ এবং সময়মতো চিকিৎসা গ্রহণের মাধ্যমে এই মরণঘাতী রোগকে জয় করা সম্ভব। সরকার ও সমাজের বিত্তবানরা এগিয়ে এলে বাংলাদেশেই ক্যান্সারের বিশ্বমানের চিকিৎসা নিশ্চিত করা যাবে বলে তিনি দৃঢ় আশাবাদ ব্যক্ত করেন।