জটিল ও আধুনিক সার্জারির জন্য চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণের পথ সহজ করা জরুরি : ডা. নাদিম আহম্মদ

বাসস
প্রকাশ: ২২ নভেম্বর ২০২৫, ১৯:৩৪
ঢামেকের সার্জারি বিভাগের অধ্যাপক ডা. নাদিম আহম্মদ। ছবি : বাসস

বরুন কুমার দাশ ও আব্দুর রউফ

ঢাকা, ২২ নভেম্বর, ২০২৫ (বাসস) : চিকিৎসা বিজ্ঞানের আধুনিকায়নে বিদেশে প্রশিক্ষণ অপরিহার্য হলেও সরকারি চিকিৎসকদের নিজ খরচে সেখানে যাওয়ার ক্ষেত্রে বিধি-নিষেধ আরোপ করা হচ্ছে, যা দেশের চিকিৎসা খাতের অগ্রগতির অন্যতম অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের সার্জারি বিভাগের অধ্যাপক ডা. নাদিম আহম্মদ বাসসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এ সব কথা বলেন।

চিকিৎসকদের বিদেশে প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে সরকারি বিধি-নিষেধের সমালোচনা করে তিনি বলেন, ‘একজন সরকারি চিকিৎসক যখন নিজ খরচে বিদেশে গিয়ে উচ্চতর প্রশিক্ষণ নিতে চান, তখন তাকে নানা প্রশাসনিক বাধার সম্মুখীন হতে হয়। সরকারি আদেশে বলা হয়, বিদেশি অর্থায়ন ছাড়া বাইরে প্রশিক্ষণে যাওয়া যাবে না। কিন্তু আমেরিকা, ইংল্যান্ড বা সিঙ্গাপুরের মতো দেশগুলো কেন বাংলাদেশের ডাক্তারদের বিনা পয়সায় বা তাদের খরচে প্রশিক্ষণ দেবে?’ 

ডা. নাদিম বলেন, ‘চিকিৎসকরা মূলত নিজ খরচেই বিদেশে গিয়ে নতুন প্রযুক্তি শিখে আসেন এবং দেশে ফিরে তা প্রয়োগ করেন। এতে বরং দেশেরই লাভ হয়। উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, ল্যাপারোস্কপিক সার্জারির মতো অপারেশন যেখানে বিদেশে করতে ৩ থেকে ৪ লাখ টাকা লাগে, সেখানে আমাদের সরকারি হাসপাতালে নামমাত্র খরচে তা করা সম্ভব হচ্ছে। চিকিৎসকরা বিদেশে গিয়ে শিখে আসছেন বলেই রোগীরা এই সেবা পাচ্ছেন এবং এতে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হচ্ছে।’

তাই নিজ খরচে হলেও প্রশিক্ষণে যাওয়ার প্রক্রিয়াটি সহজ করার জন্য সরকারের কাছে আবেদন জানান এই চিকিৎসক। 

তিনি বলেন, ‘বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশ চিকিৎসা ক্ষেত্রে অনেক দূর এগিয়েছে। কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্টসহ নানা জটিল সার্জারি এখন দেশেই নিয়মিত হচ্ছে। তবে রোবটিক সার্জারির মতো কিছু ‘অ্যাডভান্সড’ বা অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ক্ষেত্রে আমরা কিছুটা পিছিয়ে রয়েছি। তবে আশার কথা হলো, বাংলাদেশ মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএমইউ) এবং দেশের কয়েকটি বেসরকারি হাসপাতাল এই রোবটিক সার্জারি চালু করেছে।’ 

ট্রান্সপ্ল্যান্ট সার্জারির ক্ষেত্রে কিছু নীতিগত বা আইনি বাধ্যবাধকতা এবং অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা রয়েছে উল্লেখ করে ডা. নাদিম আহম্মদ বলেন, ‘বর্তমানে আপন আত্মীয় ছাড়া কেউ অঙ্গ দান করতে পারেন না, যেটি আমাদের দেশে কঠোরভাবে মানা হয়। উন্নত বিশ্বে এসব জটিল ও ব্যয়বহুল সার্জারি মূলত বেসরকারি খাতেই হয়, কারণ এর জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো তৈরি ও পরিচালনা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। আমাদের সরকার যেহেতু সাধারণ মানুষের জন্য স্বল্প বা বিনা খরচে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দিতে বদ্ধপরিকর, তাই সরকারের একার পক্ষে এসব অ্যাডভান্স সার্জারির মতো বিশাল ব্যয় বহন করা কঠিন। এ ক্ষেত্রে সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি বেসরকারি পর্যায়ের অংশগ্রহণ জরুরি।’

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল রোগীদের শেষ ভরসাস্থল উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমাদের সার্জারি বিভাগে মাত্র আড়াইশো (২৫০টি) সিট থাকলেও, কখনোই ৪০০’শর নিচে রোগী ভর্তি থাকছে না। আমরাও কোনো রোগীকে ফিরিয়ে দেই না, কারণ সাধারণ মানুষের অনেকের জন্য বাইরে যাওয়ার আর কোনো সুযোগ থাকে না।’

তবে, এই বিপুলসংখ্যক রোগীকে সেবা দিতে গিয়ে মেডিকেল শিক্ষার্থীদের মানসম্মত শিক্ষা ও চিকিৎসকদের গবেষণার সুযোগ সংকুচিত হচ্ছে জানিয়ে একটি সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবনা দেন ঢামেকের এই অধ্যাপক। তিনি বলেন, ‘মেডিকেল কলেজগুলোকে দুটি ভাগে ভাগ করা উচিত। একটি ‘সার্ভিস হসপিটাল’ যা সাধারণ রোগীদের সেবা দেবে এবং অন্যটি ‘একাডেমিক হসপিটাল’ যেখানে জটিল রোগীদের চিকিৎসার পাশাপাশি ছাত্র এবং চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণ ও গবেষণার সুযোগ থাকবে। চিকিৎসা বিজ্ঞান প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হচ্ছে, তাই নতুন প্রযুক্তির সঙ্গে খাপ খাওয়াতে হলে চিকিৎসকদের নিয়মিত প্রশিক্ষণের কোনো বিকল্প নেই।’

দেশীয় চিকিৎসার প্রতি মানুষের আস্থা ফিরছে কি না-এমন প্রশ্নের জবাবে ডা. নাদিম আহম্মদ বলেন, ‘আগে প্রচুর রোগী ভারত বা সিঙ্গাপুরে যেতো। এর পেছনে চিকিৎসার মানের চেয়ে মার্কেটিং কিংবা পর্যটনের বিষয়টি বেশি কাজ করতো। তবে এখন সেই প্রবণতা কমেছে। এমনকি সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, সচিব ও যুগ্ম সচিবরাও এখন দেশে চিকিৎসা নিচ্ছেন, যা দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার ওপর আস্থার প্রতিফলন। তবে লিভার ট্রান্সপ্ল্যান্টের মতো অতি উচ্চতর চিকিৎসার জন্য আরও অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং দক্ষ জনবল তৈরির প্রয়োজন রয়েছে বলেও তিনি স্বীকার করেন।’

দেশে সার্জনের কোনো ঘাটতি আছে কি না-জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘জেলা পর্যায়ে সার্জনের সংখ্যার চেয়ে বড় সমস্যা হলো সুষম বণ্টনের অভাব এবং অ্যানেস্থেসিস্ট ও প্রয়োজনীয় সাপোর্টের অপ্রতুলতা। উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, মানিকগঞ্জ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শয্যা সংখ্যা বাড়ানো হলেও সেখানে অ্যানেস্থেসিস্ট না থাকায় একজন সার্জন ছোটোখাটো অস্ত্রোপচারও করতে পারেন না। ফলে রোগীদের ঢাকায় পাঠাতে হয়। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে কেবল সার্জন নিয়োগ দিলেই হবে না, তার সঙ্গে অ্যানেস্থেসিস্ট, প্রশিক্ষিত নার্স এবং আধুনিক ওটি সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে।’

চিকিৎসকদের নিরাপত্তা ও কর্মপরিবেশ সম্পর্কে জানতে চাইলে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে অধ্যাপক ডা. নাদিম আহম্মদ বলেন, ‘সব মুমূর্ষু রোগীকে বাঁচানো চিকিৎসকের পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু চিকিৎসার সময় রোগী মারা গেলে হাসপাতাল ভাঙচুর এবং চিকিৎসকদের ওপর হামলার ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটছে। মাঝে মাঝে তদন্ত বা বিচার ছাড়াই চিকিৎসকদের জেলে পাঠানো হচ্ছে, যা তাদের মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করছে, ভেঙে দিচ্ছে। এই নিরাপত্তাহীনতা এবং বেসরকারি চাকরিতে বেতনের কোনো কাঠামো না থাকায় অনেক মেধাবী চিকিৎসক দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছেন, যা জাতির জন্য বড় ক্ষতির কারণ।’ 

অস্ত্রোপচারের সময় পেটে গজ বা যন্ত্র থেকে যাওয়ার মতো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ডা. নাদিম বলেন, ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) চেকলিস্ট বা গাইডলাইন যথাযথভাবে অনুসরণ করলে এ ধরনের ভুলের সম্ভাবনা শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনা সম্ভব। মূলত অপারেশনের আগে, চলাকালীন এবং পরে, এই ৩ ধাপে সার্জন, অ্যানেস্থেসিস্ট এবং নার্সদের সমন্বয়ে চেকলিস্ট মিলিয়ে কাজ করতে হয়। বিশেষ করে নার্সদের দায়িত্ব থাকে গজ ও যন্ত্রের হিসাব রাখা। এই প্রটোকল না মানাটা গুরুতর অপরাধ। উন্নত দেশগুলোর হাসপাতালে সাধারণত রেডিও-ওপ্যাক গজ বা সার্জিক্যাল স্পঞ্জ ব্যবহার করা হয় এবং অপারেশনের পর এক্স-রে করে নিশ্চিত করা হয় যে, রোগীর শরীরে কিছুই রয়েছে কি-না। আমাদের দেশে যথাযথ সচেতনতা ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন হলে এসব সমস্যা থেকে মুক্তি সম্ভব।’ 

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
দ্বীনের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত আলেম-ওলামাদের পক্ষ থেকে আসা প্রয়োজন : ধর্ম উপদেষ্টা
আমাদের একমাত্র এজেন্ডা অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করা : সিইসি
ভারত আইনগতভাবে হাসিনাকে প্রত্যর্পণে বাধ্য : এ এন এম মুনিরুজ্জামান
বিএনপি উন্নয়ন ও শান্তিতে বিশ্বাস করে : আমান উল্লাহ আমান
ভূমিকম্পে নিহত মেডিকেল শিক্ষার্থী রাফির দাফন বগুড়ায় সম্পন্ন
সেঞ্চুরি না পাওয়ায় মোমিনুল-সাদমানদের মন খারাপ : আশরাফুল
রাজধানীতে ফের ভূমিকম্প অনুভূত
কাবাডিতে উজ্জ্বল সম্ভাবনা দেখছেন এস এম নেওয়াজ সোহাগ
জটিল ও আধুনিক সার্জারির জন্য চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণের পথ সহজ করা জরুরি : ডা. নাদিম আহম্মদ
হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় সমাবর্তন অনুষ্ঠিত
১০