কারাগারের অন্ধকারেই গড়ে ওঠে দেশ রক্ষার অটুট সংকল্প: নাজিফা জান্নাত

বাসস
প্রকাশ: ৩০ জুন ২০২৫, ১৮:১৭ আপডেট: : ৩০ জুন ২০২৫, ১৮:২৬
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক নাজিফা জান্নাত। ছবি: সংগৃহীত

প্রতিবেদন : মহিউদ্দিন মুজাহিদ মাহি

ঢাকা, ৩০ জুন, ২০২৫ (বাসস): নাজিফা জান্নাত ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী। তিনি বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের সহসভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময় তিনি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক ছিলেন এবং ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয় এবং রামপুরা এলাকার আন্দোলনের সামনের সারিতে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন।

একটি রাজনৈতিক পরিবার থেকে উঠে আসায় নাজিফার শৈশব থেকেই রাজনীতির প্রতি আগ্রহ ও দায়বদ্ধতা তৈরি হয়। মুক্তিযুদ্ধের নানা গল্প ও পরিবারের রাজনৈতিক ইতিহাস তার চিন্তাভাবনায় গভীর ছাপ ফেলে। এই রাজনৈতিক বোধ তাকে বামপন্থী ছাত্র সংগঠনে যোগ দিতে উদ্বুদ্ধ করে, যেখানে তিনি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে এক নতুন চেতনার সঞ্চার ঘটান।

নাজিফার সংগ্রাম ছিল কঠোর—রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের কারণে তাকে জেল খাটতে হয়েছে, সহিংসতা ও নিপীড়নের শিকার হতে হয়েছে। রাষ্ট্রীয় রূপান্তরবিরোধী শোষণের বিরুদ্ধে তিনি অসংখ্য চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছেন। তবু তার প্রত্যাবর্তন এবং অটল নেতৃত্বে আন্দোলন বেগবান হয়েছে।

বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার সঙ্গে এক একান্ত সাক্ষাৎকারে নাজিফা জান্নাত তার রাজনৈতিক অভিযাত্রা, নির্যাতনের অভিজ্ঞতা, আন্দোলন সংগঠন ও নেতৃত্বের গল্প বলছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন বাসসের নিজস্ব প্রতিবেদক মহিউদ্দিন মুজাহিদ মাহি।

আপনার রাজনীতিতে আসার গল্পটা কেমন? কেন আসলেন?

নাজিফা জান্নাত: আমার বাবা-মা দুজনেই শিক্ষক, তাই ছোটবেলা থেকে বাসায় নানা বইপত্র ছিল। আমি বড় হয়েছি মফস্বলে, তবে বাবার কাছ থেকে রাজনৈতিক ইনসাইট পেয়েছি। একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলার রক্তাক্ত ছবি বা বিশ্বজিৎ হত্যার দৃশ্য আমার ভেতরে প্রচণ্ড নাড়া দিয়েছিল।

স্কুলে থাকতেই পড়া শুরু করি—সমরেশ মজুমদারের গর্ভধারিণী , মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক বইপত্র। সাথে বাবার রাজনৈতিক ভাবনা—এসব মিলিয়ে আমার চেতনার ভিত গড়ে ওঠে। আমার নানা, জেঠু মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, বাবা-চাচারাও সহযোগিতা করেছিলেন। ফলে দেশের রাজনীতি, গঠনপ্রক্রিয়া নিয়ে আমার মধ্যে একটা আগ্রহ জন্ম নেয়।

কলেজে উঠে স্বেচ্ছাসেবী কাজে যুক্ত হই, এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ে বিতর্কে অংশ নিতে গিয়ে এমন কিছু মানুষের সংস্পর্শে আসি যারা আমাকে রাজনীতিতে যুক্ত হতে উৎসাহিত করেন। তখনই  ২০১৮ সালের কোটা আন্দোলনের কথা জানতে পারি।

আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই ২০১৭ সালে। তখন আমার মনে হলো, একা কিছু করলে হবে না—যে ভাবনা আমি লালন করি, তার সাথে মেলে এমন একটা প্ল্যাটফর্ম দরকার। আমি বলি, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বা সহিংস রাজনীতি করব না। তখন এক সিনিয়র বলেন—তুমি বামপন্থী সংগঠনে যুক্ত হতে পার। যেহেতু আমি আগে থেকেই বামপন্থী টেক্সট পড়েছি, তাই আমি ছাত্র ইউনিয়নে যুক্ত হয়ে যাই। এভাবেই আমার রাজনীতিতে আসা।

আওয়ামী লীগের আমলের প্রায় ১৬ বছরের ভিন্ন মতের ওপর দমন-নিপীড়নের চিত্রগুলো কখনও মনে পড়ে? আর আপনি তো সবসময় মাঠে ছিলেন, আপনি কখনও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন?

নাজিফা জান্নাত: এই অপশাসনের যে স্বৈরাচারী শাসন ব্যবস্থা ছিল সেটার বিরুদ্ধে কথা বলতে গিয়ে রাজনৈতিক জীবনের অল্প সময়ের মধ্যেও আমাকে জেলে যেতে হয়েছিল। আমি ২০২১ সালে জেলে যাই। আপনারা জানেন যে সরকারের বেশ কিছু দুর্নীতি বিষয়ে লেখালেখি করার কারণে মুশতাক আহমেদকে গ্রেপ্তার করা হয়। তিনি অসংখ্যবার আবেদন করার পরেও জামিন পাননি। বরং তাকে রাষ্ট্রীয় মদদে জেলহাজতে প্রচণ্ড অত্যাচার করে খুন করা হয়।

এর পরদিন আমরা বামপন্থী দলগুলো এই খুনের প্রতিবাদে একটা মশাল মিছিল বের করি। সেখান থেকে আমাদের সাতজনকে গ্রেফতার করা হয়। পুলিশ আমাদের ব্যাপক মারধর করে। আমরা প্রায় ১০ দিনের বেশি জেল খাটি।

তো, ওই করোনার ভয়াবহ সময়টাতে রাষ্ট্র দ্বারা আমরা গোষ্ঠীগতভাবে নিপীড়নের শিকার হয়েছি।আমি ব্যক্তিগতভাবেও অনেক নিপীড়নের মধ্য দিয়ে গিয়েছি। যখনই কোথাও কোনো কথাবার্তা বলেছি আওয়ামী লীগের পাণ্ডারা সেটি অনলাইনে ছড়িয়ে দিয়েছে। বিভিন্নভাবে আমাদের সাইবার বুলিং করা থেকে শুরু করে ডেথ থ্রেট দেওয়া- সবকিছুই করেছে তারা।

জেলের অভিজ্ঞতা কেমন ছিল এবং আপনার জীবনে আসলে জেলে যাওয়ার ইমপ্যাক্ট কী রকম ছিল?

নাজিফা জান্নাত: এইটা আসলে লাইফে অনেক ইম্প্যাক্ট ফেলে কারণ, ধরেন, এরকম একটা পরিবেশে ছিলাম যে পরিবেশটা আমি কখনোই চাই না। সবথেকে বেশি যেটা যন্ত্রণা অনুভূত হয়েছে, সেটা হলো রাষ্ট্রযন্ত্র তো আসলে একটা শোষণযন্ত্র। আমরা কোনো ধরনের অন্যায় না করার পরেও আমাদের জেলে পাঠিয়েছে। পুলিশ আমাদের দিকে মশাল ছুড়ে মারল, বেধড়ক মারধর করল এবং সর্বশেষ আমাদের বিরুদ্ধে হত্যাচেষ্টা মামলা দিল। আমাদের রাষ্ট্রদ্রোহী বলা হলো।

তো এই যে রাষ্ট্র বনাম আমাদের মুখোমুখি করিয়ে দেওয়ার যে প্রক্রিয়া এটা আসলে আমার মধ্যে

একটা নতুন ভাবনা উসকে দিয়েছিল যে এই রাষ্ট্র কি আমার? যে রাষ্ট্র আমাকে এরকম শোষণের মধ্য দিয়ে নিয়ে যায়?

অন্যদিকে যাদের অর্থবিত্ত আছে তারা অনেক অপরাধ করেও সমাজে টিকে থাকছে। আর আমরা অন্যায় না করা সত্ত্বেও একটা যৌক্তিক জায়গায় প্রতিবাদ করায় আমাদের ধরে নিয়ে যায়। মানে এই রাষ্ট্র চাইলে আমাদের পিষে মেরে ফেলতে পারে। এ রকম একটা পরিস্থিতির শিকার হয়েছি। তখন আমার কাছে মনে হয় যে এই দেশটাকে গার্ড করার দায়িত্ব আমাদের। যেখানে আমাদের রাষ্ট্রদ্রোহী বানানো হয় সেই জায়গা থেকে আসলে এই দেশের প্রটেক্ট করার যে অনুভূতি সেইটা আমাদের মধ্যে গ্রো করে। আমার মধ্যে সেই অনুভূতিটাই আমার মনে হয় যে ওই ট্রান্সফরমেশন, ওই জায়গা থেকে এখন পর্যন্ত এই এভুলেশনটাই আমার হয়েছে।

আমি ১০ দিন জেলে ছিলাম। ২০২১ এর ফেব্রুয়ারির ২৮ তারিখ মশাল মিছিলের পর আমাদের গ্রেফতার করে শাহবাগ থানায় নেওয়া হয়। এরপর রাতে ধানমন্ডি থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে পরদিন কোর্টে ওঠানো হয় এবং ১০ দিনের রিমান্ড চাওয়া হয়।

যাই হোক, পরে আমাদেরকে জেলে পাঠিয়ে দেয়। বাইরে আমাদের যে সকল কমরেডেরা ছিলেন তাদের আপ্রাণ প্রচেষ্টার ফলেই আমরা বের হতে পেরেছিলাম। না হলে আমাদের এক দেড় মাসেরও বেশি সময় হয়তো জেলে থাকতে হতো। কারণ তখন ঈদের বন্ধ শুরু হয়ে যাচ্ছিল, কোর্ট বন্ধ হয়ে যাওয়ার কথা ছিল।

আর জেলের অভিজ্ঞতা তো ভয়াবহ। আমি জেলের ভেতরে পাপিয়াকে দেখেছিলাম- আওয়ামী লীগের ওই সময়কার অর্থ কেলেঙ্কারির জন্য গ্রেফতার হয়েছিল। এ রকম আরও অনেকের সাথে পরিচয় হয়েছে।

এটা আসলে খুবই ডাইভার্স একটা অভিজ্ঞতা। কারণ জেলে গিয়ে আসলে অনেক রকমের মানুষ দেখেছি। মাদক বিক্রেতা থেকে শুরু করে মার্ডার কেসের আসামি, এরকম অনেক লোকের সংস্পর্শে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। এবং ওখানে তো আসলে কোনো ক্লাসিফিকেশনের সুযোগ নাই। এরকম পরিবেশ ছিল যে আমার পাশেই হয়তো  মার্ডার কেসের একজন আসামি শুয়ে আছে।

আন্দোলনের সঙ্গে প্রথম কীভাবে যুক্ত হলেন?

নাজিফা জান্নাত: আন্দোলনে আসলে শুরুতে ইনভল্ভ হওয়ার জায়গাটা এভাবে ছিল যে, শুরুতে তো এটা তো জুলাই মাসে—জুন মাসেও প্রস্তুতি চলছিল, সেটা আমি পরবর্তীতে জানতে পারি। কিন্তু জুলাই মাসের এক তারিখ থেকেই মোটামুটি এক ধরনের ডেমনস্ট্রেশন শুরু হয়ে যায়।

গণতান্ত্রিক ছাত্রজোটের একটা প্রেস ব্রিফিং হয় ৭ তারিখে, মধুর ক্যান্টিনে। তার আগে মিছিলে টুকটাক হেঁটেছি, এক ধরনের সংশ্লিষ্ট ছিলাম। কিন্তু সংগঠনের সঙ্গে পুরোপুরি যুক্ত হওয়া হয়নি। ওইদিন প্রেস ব্রিফিং শেষে ক্লাস বয়কট আর বাংলা ব্লকেড প্রোগ্রাম ঘোষণা করা হয়।

আমরা ওখান থেকে বের হয়ে নীলক্ষেত মোড়ে, সায়েন্সল্যাব মোড়ে যাই। সেদিন শিক্ষার্থীদের টেম্পারমেন্ট দেখে আমার মনে হয়েছিল এটা হিউজ কিছু হতে যাচ্ছে। ৭, ৮, ৯ তারিখ আমি ধারাবাহিকভাবে অংশ নেই। শাহবাগেও মিছিল নিয়ে যাই।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলন কীভাবে সংগঠিত করলেন—বিশেষ করে রামপুরা ও ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের?

নাজিফা জান্নাত: আসলে, আন্দোলনের শুরুতে আমি নিজেই একটা দ্বিধায় ছিলাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিদিন মিছিল, সমাবেশে অংশ নিচ্ছি, কিন্তু আমার নিজের জায়গা—বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়—সেখানে তো কিছুই হচ্ছে না। এমন সময় বুঝলাম, শুধু অংশগ্রহণ করলেই চলবে না, নিজে উদ্যোগ নিতে হবে।

তখন ঢাকা কলেজের রাকিব ভাই ও রামপুরার আন্দোলনকর্মী হান্নান মাসুদের সঙ্গে যোগাযোগ করি। আমি বলি—‘ভাই, এমন কারো নম্বর দেন, যার মাধ্যমে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টুডেন্টদের এক জায়গায় আনা যায়।’ তারা আমাকে কয়েকটা রেফারেন্স দেয়। এরপর আমি যোগাযোগ শুরু করি—ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বন্ধু, ব্র্যাকের এক ছোট ভাই, ছাত্র অধিকার পরিষদের আসাদ বিন রনি—এদের নিয়ে একটা কোর গ্রুপ তৈরি করি।

প্রথম মিটিংটা ছিল খুব ছোট—মাত্র ৮-১০ জন। ইস্ট ওয়েস্টে তখন প্রতিদিন ১০-১২ জন বাইরে বের হতো, কিন্তু আন্দোলনের মতো সংগঠিত কিছু ছিল না। আমরা ঠিক করলাম, এইভাবে চললে হবে না। প্ল্যান করলাম ১০ জুলাই একটা বড় ডেমো দেব। সেদিন আমরা প্রথম রামপুরা ব্রিজে ইস্ট ওয়েস্টের সামনের রাস্তায় একপাশ ব্লক করি। ইম্পেরিয়াল কলেজের ছাত্ররাও তাতে যোগ দেয়। এরপর দুইপাশেই আমরা রাস্তায় নেমে যাই।

প্রথমে পুলিশ আসে, থামাতে চায়। আমাদের মাথায় তখন একটাই কথা—'এই রাস্তা আমাদের, আমাদের কণ্ঠস্বর এখানেই শোনা যাবে।' পরদিন ১১ তারিখে পুলিশ সকালেই আমাদের ক্যাম্পাসে এসে বলে—'রাস্তায় নামবা না, আজ পারবা না।' আমরা ১১ জন ছিলাম, পুলিশ ৩০ জনের মতো। তবুও বললাম—'ভাই, আমাদের মানববন্ধন করতেই হবে।' পুলিশকে পাশেই রেখে আমরা মানববন্ধন করি। ছাত্ররা আস্তে আস্তে জমতে থাকে। মিডিয়া আসে, ছবি তোলে।

এরপর থেকে প্রতিদিন ছাত্রছাত্রী বাড়তে থাকে। ইস্ট ওয়েস্ট ছাড়াও স্কলাস্টিকা, স্টেট ইউনিভার্সিটি, ইম্পেরিয়াল—এদের শিক্ষার্থীরাও রামপুরা ব্রিজে এসে আমাদের সঙ্গে একাত্মতা জানাতে শুরু করে। কেউ কেউ ক্লাস ছেড়ে আসছে, কেউ বাসা থেকে বের হয়ে যাচ্ছে, কেউ মিডিয়াতে কথা বলছে। রামপুরা আর ইস্ট ওয়েস্টের শিক্ষার্থীরা মিলে একটা চেতনার কেন্দ্র হয়ে ওঠে—যেখানে 'বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা রাজনীতি বোঝে না' এই অপবাদ মিথ্যা প্রমাণিত হয়।

আন্দোলন কীভাবে ছড়িয়ে পড়ল—১৪, ১৫, ১৬ তারিখের ঘটনা কী ছিল?

নাজিফা জান্নাত: ১৪ তারিখে কুমিল্লায় হামলা হলো। সেদিন রাতে শেখ হাসিনা প্রেস ব্রিফিংয়ে আন্দোলকারীদের ‘রাজাকার’ বলে সম্বোধন করে এবং শিক্ষকদের উদ্দেশ্যে বলে,  'তোমরা ক্লান্ত হলে আমাকে বলো'—এই বক্তব্য আসলে সবাইকে ক্ষুব্ধ করে তোলে। এরপর আমাদের প্রোগ্রামে উপস্থিতি বেড়ে যায়। পুলিশ বলল, রাস্তায় উঠতে দেবে না। আমরা বলি, আমাদের কর্মসূচি শেষ না হওয়া পর্যন্ত যাব না। মিডিয়া কাভার করল। তখন এটা ছড়িয়ে গেল।

১৫ তারিখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হামলা হল। ১৬ তারিখে রামপুরা ব্রিজে ২০০০-এর বেশি মানুষ। স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীরাও আসল। ওইদিন চট্টগ্রামে ওয়াসিম, রংপুরে আবু সাঈদ মারা গেলেন—এই খবর পুরো মুভমেন্টকে ট্রান্সফর্ম করে দিল।

১৮ তারিখের দিনটা কেমন ছিল? নেতৃত্বের জায়গায় থেকে আপনার অভিজ্ঞতা কেমন ছিল সেদিন?

নাজিফা জান্নাত: ১৮ তারিখ আমার জীবনের ভয়াবহ দিন। আমি রিকশায় করে শান্তিনগর থেকে রামপুরা ব্রিজে আসতাম। ওইদিন মাইক দিতে রাজি হয় না কেউ। সকাল ১০টার আগেই ৩০০ ছাত্র জমা হয়। হঠাৎ দেখি টিয়ারশেল শুরু হয়ে গেছে। আমি একটা বাইকে উঠে ঘটনাস্থলে যাই। রামপুরা ব্রিজে গিয়ে দেখি, গোলাগুলি চলছে, ১০০ ফিট দূরে। অন্যপথে ঘুরে ব্র্যাকের পেছন দিয়ে গিয়ে স্টুডেন্টদের সামলাতে চেষ্টা করি।

পুলিশ গুলি করছিল, স্টুডেন্টরা দৌড়াচ্ছিল। আমি মাইক ছাড়াই ওদের বলতে থাকি—এই দাঁড়াও, ওইটা করো না। ছাত্ররা গুলি খেয়ে আসছিল। আমার সামনে একজন গুলিবিদ্ধ হয়ে পড়ে যায়। আমার মনে হয়েছে—আমি অর্গানাইজ্ড ফোর্স আর সম্পূর্ণ অ্যানার্কি—দুই চেহারা একসাথে দেখছি।

আন্দোলনে পুলিশি হুমকি বা পারিবারিক চাপ ছিল? ধরপাকড়, রেইড—এসবের অভিজ্ঞতা কেমন?

নাজিফা জান্নাত: হ্যাঁ, পুলিশের চাপ ছিল। আমাদের বাসায় পুলিশ ঢুকত, অনেককে ধরে নিয়ে যেত। বাসায় পুলিশ ও আওয়ামী লীগের লোকজন থেকে চাপ আসত আমার বাবার কাছে, আমাকে ঢাকা থেকে বাড়ি ফিরে যাওয়ার জন্য। বাবাকে আওয়ামী লীগ সংশ্লিষ্টরা থ্রেট করছিল—'মেয়েকে বাড়ি পাঠান।' আমি তখন বলতাম—'আমি বাসায় আছি।'

স্টুডেন্টদের ধরে নিয়ে গেছে, গুলশান, রামপুরা থানায়। আমরা আইনি সহায়তার জন্য আইনজীবীদের সাথে যোগাযোগ করেছিলাম, ফ্রি সহযোগিতা দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিলাম। অনেক শিক্ষার্থী থানায় আটক ছিল। আমি নিজে লিটন নন্দীসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থীদের সাথে গিয়ে তাদের মুক্ত করার চেষ্টা করেছিলাম।

রাতে বাসায় থাকতে পারতাম না, ফোন বন্ধ রাখতাম, কারণ ফোন ট্র্যাক করা হতো। পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল আমার, তারা জানত আমি ছাত্রদের শান্তিপূর্ণ রাখতে চাই। পুলিশি চাপের মধ্যেও আমি সমন্বয় করতাম যাতে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে থাকে।

আন্দোলনের সময় ছাত্রদের মধ্যে ঐক্য ও সংগঠনের জন্য আপনি কী ধরনের কাজ করেছেন?

নাজিফা জান্নাত: আমি নিজে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হওয়ায় সেখানে আন্দোলন গড়ে তোলার দায়িত্ব নিয়েছিলাম। আমার পরিচিত বন্ধুদের ফোন করে ছোট ছোট গ্রুপ তৈরি করেছি, যাদের নিয়ে ডেমনস্ট্রেশন করেছি। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের মধ্যে অনেক অনীহা ছিল, সেটা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করেছি। ছাত্রদল, গণতান্ত্রিক ছাত্রজোটের সাথেও সমন্বয় করেছিলাম। এভাবে ছাত্রদের একত্রিত করে আন্দোলন বড় করেছি।

আন্দোলনের সময় ‘সশস্ত্র পরিকল্পনা'র কথাও এসেছে—আপনি কিছু জানেন? এটা কি বাস্তব ছিল?

নাজিফা জান্নাত: আমি এটাও শুনেছি—নাহিদ ইসলাম বা আতিফ মাহমুদ ভিডিও দিয়েছিল। কিন্তু আমার কাছে এই সময়টায় এটা অপ্রাসঙ্গিক না হলেও, বাস্তবায়নযোগ্য ছিল না। কারণ, আমাদের দিকে তো তখন বন্দুক তাক করা, ধরা, মারধর—এসব হচ্ছিল। তখন তো অপশনগুলো অনেক কম ছিল। কেউ কেউ বলেছে 'সশস্ত্র হতে হবে'—কিন্তু আমার মনে হয় আমরা ব্লেসড যে আমাদের ওই পথে যেতে হয়নি।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরেছেন ফরিদা পারভীন
প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হয়ে হতাহতের ঘটনায় রাষ্ট্রপতির শোক 
উত্তরায় বিমান বিধ্বস্তে হতাহতের ঘটনায় ইউট্যাবের শোক
গুরুতর আহতদের দেখে চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি : মানসুরা আলম
বিমান দুর্ঘটনায় বেগম খালেদা জিয়ার শোক : নেতাকর্মীদের হতাহতদের পরিবারের পাশে থাকার আহ্বান
আহতদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করছি : প্রধান উপদেষ্টা
আওয়ামী ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে জাতীয় ঐক্যের আহ্বান তথ্য উপদেষ্টার
ঢাকায় বিমান বিধ্বস্তে হতাহতের ঘটনায় চীনের শোক
বিমান দুর্ঘটনায় আহতদের বিনামূল্যে চিকিৎসা দেওয়ার নির্দেশ স্বাস্থ্য উপদেষ্টার
২০২৬ সালের হজের প্রাথমিক নিবন্ধন শুরু ২৭ জুলাই
১০