।। বিপুল আশরাফ।।
চুয়াডাঙ্গা, ২ আগস্ট ২০২৫ (বাসস): সারাদেশে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ছড়িয়ে পড়লে চুয়াডাঙ্গার শিক্ষার্থীরাও আন্দোলনে শরিক হন। প্রথম অবস্থায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হাতে গোনা কয়েকজন শিক্ষার্থী এ আন্দোলনে যোগ দেন। ঢাকায় আন্দোলন বেগবান হওয়ার সাথে সাথে চুয়াডাঙ্গার আন্দোলনেও সাধারণ শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ বাড়তে থাকে।
তবে পুলিশ প্রশাসনের ব্যাপক নজরদারি ও ধর পাকড়ের কারণে জেলায় কোটা আন্দোলন চালিয়ে নেয়া কঠিন হয়ে পড়ে। ছাত্রলীগ-যুবলীগের নেতারা বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে এবং মোবাইলে হুমকি দিয়ে আন্দোলনে যেতে নিষেধ করে। এতে জেলা শহর ও গ্রামের মানুষের মধ্যে ভীতি তৈরি হয়। এছাড়াও গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন সাদা পোশাকে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের নানান প্রশ্নবাণে জর্জরিত করে রাখত।
২০২৪ সালের জুলাই আন্দোলনের শুরু থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত চুয়াডাঙ্গা জেলার ৪ উপজেলার মানুষের মধ্যে এক অজানা আতঙ্ক বিরাজ করতো। অনেকেই কোটা বিরোধী আন্দোলন ও সরকার পতনের এক দফা আন্দোলনকে সমর্থন দিলেও প্রকাশ্যে রাস্তায় নামতে ভয় পেত।
চুয়াডাঙ্গাতে কোটা বিরোধী আন্দোলনের সূচনা হয় ৬ জুলাই। এরপর ১১ জুলাই, ১৪ জুলাই, ১৮ জুলাই ও ৪ আগস্ট জেলায় আন্দোলনের প্রভাব দৃশ্যমান হয়।
১৮ জুলাই চুয়াডাঙ্গা শহর ও সরোজগঞ্জ বাজারে বড় ধরনের শোডাউন করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মী ও সাধারণ ছাত্ররা। সেসময় ছাত্রলীগ ও যুবলীগের সন্ত্রাসী বাহিনীর আগ্নেয়াস্ত্র ও দেশীয় অস্ত্রের হামলায় ১০ থেকে ১২ জন শিক্ষার্থী আহত হয়। আর সর্বশেষ আন্দোলন জমে ওঠে ৪ আগস্ট। সেদিন চুয়াডাঙ্গা শহর, জীবননগর, আলমডাঙ্গা, মুন্সিগঞ্জ ও সরোজগঞ্জে মিছিল এবং অবস্থান কর্মসূচি পালন করা হয়।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চুয়াডাঙ্গা জেলা শাখার সাবেক যুগ্ম সদস্য সচিব রনি বিশ্বাস বলেন, গত বছরের জুলাইয়ের সেইসব দুঃসহ স্মৃতি ভুলবার নয়। সবসময় এক অজানা আতঙ্কের মধ্যে সময় পার হতো। তারপরেও মনে হতো দেশের জন্য কিছু একটা করতে হবে। সেই ধারণা থেকে শত বাধা উপেক্ষা করেই আন্দোলন চালিয়ে গেছি।
তিনি বলেন, ‘প্রথম কর্মসূচি পালন করার সিদ্ধান্ত নিই ৬ জুলাই। সেদিন আমি ও অর্ক ভাই মুঠোফোনে মানববন্ধন বাস্তবায়নের পরিকল্পনা করি। ৬ জুলাই বেলা ১১ টায় চুয়াডাঙ্গা প্রেসক্লাবের সামনে আমরা মাত্র ৭ জন ব্যানার নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ি। আমার নেতৃত্বে মানববন্ধনে উপস্থিত ছিল ইমরান, আসিফ আরাফাত, তাজওয়ার, আহিন, তাহমিদ ও সুজন। মানববন্ধন শেষে বাড়ি পৌঁছানোর আগেই গোয়েন্দা সংস্থা ও পুলিশের লোকজন বাড়ি গিয়ে হাজির হয়। এরপর মানববন্ধনের ছবি ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়লে আমরা ৭ জন গোয়েন্দা নজরদারিতে পড়ে যাই।’
রনি বিশ্বাস বলেন, ‘১১ জুলাই পুনরায় চুয়াডাঙ্গা প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধনের ডাক দিই। ওই দিন আমরা বেলা সাড়ে ১১টার দিকে প্রেসক্লাবের সামনে জড়ো হই।
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার নাজিম উদ্দিনের নেতৃত্বে একদল পুলিশ মানববন্ধনে বাধা দেয়। এমনকি গ্রেফতারের হুমকি দেয়। আমরা ছোট ছোট দলে বিভক্ত ছিলাম। বাধ্য হয়ে যে যার মত এলাকা ত্যাগ করি। তবে আমরা পুলিশকে বলেছিলাম, হাইকোর্টের আদেশের কারণে আমরা মানববন্ধন করছিনা। কিন্তু আমাদের দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত আমরা বিক্ষোভ মিছিল করব।’
তিনি বলেন, ১৪ জুলাই আমরা জেলা প্রশাসক বরাবর স্মারকলিপি প্রদানের সিদ্ধান্ত নিই। এ অবস্থায় নেতৃত্বের পরিবর্তন করা হয়। সজিবুল ইসলামের নেতৃত্বে ডিসি অফিসে স্মারকলিপি প্রদান করা হয়। ১৬ জুলাই সকাল ১০টায় আবারো চুয়াডাঙ্গা প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধনের সিদ্ধান্ত নিই। আমি ও তামান্না সকাল ৯টার দিকে প্রেসক্লাবের সামনে চলে আসি। জানতে পারি পুলিশ আমাদের কর্মসূচি পালন করতে দেবে না। তবে আমরা মানববন্ধন করার সিদ্ধান্তে অটল ছিলাম। আমরা মোবাইলে সবাইকে সকাল সাড়ে ৯ টার কর্মসূচিতে যোগদানের আহ্বান জানাই। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পৌনে ১০টার মধ্যে আমরা অনুষ্ঠান শেষ করে এলাকা ত্যাগ করি। এদিন ৭০/৮০ জন শিক্ষার্থী উপস্থিত ছিল। তখন অনুষ্ঠানের ব্যানার প্রিন্ট করা খুব রিস্ক ছিল। হ্যান্ড মাইক কেউ দিতে চাইতো না।
চুয়াডাঙ্গা জেলা শাখার সাবেক যুগ্ম সদস্য সচিব রনি জানান, ৮ জুলাইয়ের অনুষ্ঠান বাস্তবায়নের জন্য ১৭ জুলাই মিটিং আহ্বান করা হয়। তামান্না, আসলাম হোসেন অর্ক, শাওন, সাফফাতুলসহ তারা কয়েকজন মিলে সরকারি কলেজের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালনের সিদ্ধান্ত নেন। পরে যোগাযোগ করতে না পারায় কয়েকজন সরকারি কলেজের সামনে এবং কয়েকজন কাঠপট্টির মধ্যে অবস্থান নেন। এই দ্বিধাদ্বন্দ্বের কারণে ছাত্রলীগ ছেলে-মেয়েদের উপর হামলা চালায়। এর মধ্যে ইমমদাদুল হক শাওনসহ ৫ জন গুরুতর আহত হন।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন আলমডাঙ্গা উপজেলা শাখার সাবেক সদস্য সচিব আরাফাত বলেন, ছাত্রলীগ ও যুবলীগের আক্রমণের কারণে আমরা মাঠে নামতে পারি নাই।
তবে ৩১ জুলাই আলমডাঙ্গার মুন্সিগঞ্জ মদনবাবুর মোড়ে ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ কর্মসূচি পালন করি। বেলা ১২ টার দিকে আমরা ১৭-১৮ জন ১০ মিনিট অবস্থান কর্মসূচি পালন করতে পেরেছিলাম। এরপর পুলিশ এসে লাঠিচার্জ করে আমাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। এতে আমরা ৩ জন আহত হই।
তিনি বলেন, ৪ আগস্ট বেলা ১১ টায় আলমডাঙ্গা স্টেডিয়াম মাঠে এক দফা দাবিতে বিক্ষোভ সমাবেশের ডাক দিই। কিন্তু ছাত্রলীগের গুন্ডা বাহিনী আমাদের সেদিন মাঠে ঢুকতে দেয়নি। ধারালো অস্ত্র দিয়ে আমাদের ১৫ থেকে ১৬ জন শিক্ষার্থীকে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে জখম করে। হাসপাতালে ভর্তি হতে বাধা প্রদান করে। আমরা নিরুপায় হয়ে পালিয়ে অন্য হাসপাতালে চলে যাই।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে চুয়াডাঙ্গার পরিস্থিতি নিয়ে আলাপ হয় সদর শাখার সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক রিমন মণ্ডল, তামিম হোসেন ও সদস্য সাব্বির হুসাইন এর সাথে।
তারা জানান, জেলার মধ্যে সবচেয়ে বড় আন্দোলন দানা বেধে ওঠে সরোজগঞ্জ বাজারে। স্থানীয় ছাত্র সমাজ আওয়ামী লীগের মারমুখী ভূমিকার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। ১৮ জুলাই সকাল ১০টায় সরোজগঞ্জ বাজারে অবস্থান কর্মসূচি পালন করার জন্য জড়ো হয় ছাত্ররা। এ সময় আন্দোলনকারীরা পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙ্গে এগিয়ে যায়। ৩০ মিনিট প্রধান সড়ক ব্লক করে রাখে। আওয়ামী লীগের গুন্ডা বাহিনী আগ্নেয়াস্ত্র ও ধারালো অস্ত্র নিয়ে আন্দোলনকারীদের উপর আক্রমণ করে। ছাত্ররা আশেপাশের দোকানে সেল্টার নেয়। এতে আপন, দিগন্ত ও ফিমা নামে ৩ জন জখম হয়।
রিমন মন্ডল বাসসকে বলেন, ‘৪ আগস্ট চুয়াডাঙ্গায় আন্দোলন নতুন গতি পায়। এক দফার সমর্থনে আমাদের সাথে যোগ দেয় জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ ও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)। শিক্ষার্থীরা সরোজগঞ্জ বাজারে ‘পুলিশ তুমি পোশাক ছাড়ো, মুজিব কোট গায়ে পড়ো’, ‘পুলিশ তুমি ভুয়া, প্রশাসন ভুয়া’, স্লোগান দিয়ে পুলিশের ভূমিকার প্রতি আমাদের ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়।
তিনি বলেন, ‘তবে সেদিন অনুষ্ঠান শেষে গ্রেফতার আতঙ্কে আমরা রাতে বাড়িতে থাকতে পারি নাই।’
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চুয়াডাঙ্গা জেলা শাখার সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক সিরাজুম মুনিরা বলেন, আমাদের কষ্ট লাগে, আমাদের যারা লাঠিপেটা করেছে, তারাই আবার আমাদের সামনে ঘুরে বেড়ায়। ৪ আগস্ট খুশবু, অনিমাসহ ২০ জন মেয়ে ও ৮ থেকে ১০ জন ছেলেসহ আমরা চুয়াডাঙ্গা শহরের কোর্ট মোড়ে জড়ো হই। ছাত্রলীগের ছেলেরা আমাদের ব্যানার কেড়ে নিয়ে পুড়িয়ে দেয়। আমরা ভয়ে আইনজীবী সমিতির কার্যালয়ে আশ্রয় নিতে চাইলে, আমাদের সেখান থেকে চলে যেতে বলে। আমরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ি। পরে মোবাইলে যোগাযোগ করে আমরা আবার হাসপাতাল রোডে জড়ো হই। সেখানে ছাত্রলীগের ছেলেরা লোহার রড দিয়ে মেরে আমাদের ৪ জনকে গুরুতর আহত করে। আমরা হাসপাতালে গেলে আমাদের হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে বাধা দেয়। এরপর বাড়ি এসে দেখি ছাত্রলীগের গুন্ডারা আমার বাড়িসহ আরো ২টি বাড়িতে ব্যাপক ভাঙচুর করেছে। প্রশাসনের কাছে বিচার চেয়েও আমি এখনও বিচার পাইনি। যুবলীগ ও ছাত্রলীগের ছেলেরা আজও প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ায়।