শিরোনাম
ঢাক, ৭ জানুয়ারি, ২০২৫(বাসস): একুশ শতকের বাংলাদেশ। তথ্য-প্রযুক্তি, শিক্ষা-দীক্ষা, জ্ঞান বিজ্ঞানে পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও এখন সমানে সমান। তবে কিছু কিছু জায়গায় এখনও বৈষম্য দৃশ্যমান। বিশেষ করে নারী শ্রমিকদের মজুরি বৈষম্য প্রকট আকার ধারণ করছে। কৃষি কাজে নারী শ্রমিকদের কদর বাড়লেও দূর হয়নি মজুরি বৈষম্য। বোরো মৌসুমে পুরুষ শ্রমিকদের সংকট দেখা দেয়ায়, অনেক কৃষক নারী শ্রমিকদের প্রতি নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। এতে নারী শ্রমিকদের ব্যস্ততা ও আয় দুটোই বেড়েছে।
বোরোর চারা উত্তোলন,রোপন,জমি থেকে আলু তোলা ও বিভিন্ন ফসলের আগাছা পরিষ্কারের ক্ষেত্রে নারী শ্রমিকরা পুরুষ শ্রমিকদের পাশাপাশি সমান কাজ করছেন। তবে এই সব কাজে নারী শ্রমিকরা পুরুষ শ্রমিকদের তুলনায় মজুরি প্রাপ্তির ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার।
নারী কৃষি শ্রমিকদের নিয়ে কাজ করা সংগঠন ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী উন্নয়ন কেন্দ্রের হিসাব মতে চলতি বোরো মৌসুমে শুধু নওগা জেলার বিভিন্ন মাঠে প্রায় ২০ থেকে ২৫ হাজার নারী শ্রমিক বোরো রোপন ও জমি থেকে আলু তোলার কাজ করছে।
একজন নারী শ্রমিক দিনে কাজ করে তিনশ-চারশ টাকা মজুরি পাচ্ছেন। যেখানে পুরুষ শ্রমিক পাচ্ছেন সাতশ-আটশ টাকা। তবে বিগত বছরগুলোতে এই সময় নারী শ্রমিকদের মজুরি ছিল অনেক কম। এখন তুলনামূলকভাবে মজুরি বেশি পাওয়ায় খুশি নারী শ্রমিকরা। তুলনামূলকভাবে মজুররি বেশি পাওয়ায় ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী পরিবারের অনেক স্কুল ছাত্রীও মৌসুমি শ্রমিক হিসাবে বোরো মাঠে কাজ করছে।
পুরুষ শাসিত এ সমাজে নারী শ্রমিকদের বৈষম্যের অন্ত নেই। যে কোনো কাজেই তারা বৈষম্যের শিকার। যেহেতু শিক্ষা কম,সেহেতু পুরুষ শ্রমিকদের তুলনায় নারী শ্রমিকরাই প্রতিনিয়ত বঞ্চনা আর শোষণের শিকার। সমাজ কাঠামোর পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বদলে যাচ্ছে মানুষের জীবনাচারণ, পারস্পরিক সম্পর্ক ও মূল্যবোধ। সমাজ বদলে যাওয়ায় প্রতিনিয়তই বদলে যাচ্ছে সামাজিক সম্পর্কের মাত্রা ও তার ব্যঞ্জনা। বাংলাদেশে বেশিরভাগ অঞ্চলে নারী শিক্ষার হার আনুপাতিক হারে কম। তাই কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ অধিক মাত্রায় বাড়ায় মূলত নারীরাও শ্রমিক হিসেবে স্বীকৃত। আর শ্রম দেয়ার ক্ষেত্রগুলোর মধ্যে নির্মাণকাজেও নারীর অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্য।
ভোর থেকে শুরু করে সন্ধ্যা পর্যন্ত দরিদ্র পরিবারের গৃহবধূ থেকে শুরু করে ঘরের কিশোরী মেয়েরাও নারী শ্রমিক হিসেবে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে মাঠে-ঘাটে,ঘরে-বাহিরে,নির্মাণ-বিনির্মাণের কাজে নিজেকে যুক্ত রাখছেন। কাজের এই ক্ষেত্রগুলোতে দেখা যায়, নারীরা অধিকতর শ্রম দেয়ার পরও বৈষম্যের শিকার হয়ে পুরুষের তুলনায় কম মজুরি পাচ্ছেন। উচ্চস্বরে প্রতিবাদ করার সাহসও নেই। প্রতিবাদ করলে অনেক সময় প্রাপ্য মজুরি থেকে বঞ্চিত করা হয়। এসব শ্রমজীবী নারীরা কিছু বলতে পারে না বলেই তাদের অন্যায়ভাবে শোষণ ও অত্যাচার করা হচ্ছে। অথচ তারাই সারাদিন খাটুনির পর বাসায় গিয়ে আবারো সাংসারিক কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ছেন। কিন্তু শ্রমিক হিসেবে নারীর শ্রমকে খাটো করে দেখার প্রবণতা আজও রয়ে গেছে। সর্বোপরি সামাজিক এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নে নারীর শ্রম বিশেষ অবদান রাখছে।
প্রাচীনকাল থেকে বাংলাদেশে কৃষি প্রধান দেশ হিসেবে খ্যাত। কৃষিপ্রধান দেশ হলেও বর্তমান পরিস্থিতি এবং সামাজিক অবস্থানের কারণে জীবিকার তাগিদে গ্রামের মানুষ ছুটছে শহরের দিকে। প্রতিদিন নগরীতে আসা মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। যেহেতু জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে সেহেতু পেটের তাগিদে নারীদেরও কর্মসংস্থানের খোঁজে ছুটতে হচ্ছে। যারা প্রাইমারি শিক্ষায় শিক্ষিত তারা কোনো রকমে বিভিন্ন পোশাক প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানে কাজ করছে। আর যারা একেবারেই অক্ষরজ্ঞানহীন তারাও বিভিন্নভাবে কাজ করে সংসারের হাল ধরে রেখেছেন।
বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকেই এরা আসছে,যেহেতু গ্রামাঞ্চলে পর্যাপ্ত কর্মসংস্থানের অভাব। স্বামী পরিত্যক্তা হওয়ার কারণে কিংবা বিয়ে না হওয়ার কারণে শহরে আসা নারী শ্রমিকের সংখ্যা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ ছাড়া গ্রামে শুধু ভিটে আছে, চাষাবাদের কোনো জমি নেই এবং মজুরি বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহই তাদের বেঁচে থাকার একমাত্র উপায়। অথচ সারাবছর তারা কাজ পায় না। বছরের যে ক’দিন কাজ পায় তার পারিশ্রমিকও খুবই সামান্য।এই টাকা দিয়ে পারিবারিক চাহিদা মেটানো সম্ভব নয় বলে শহরে আসতে হচ্ছে নারী শ্রমিকদের। মানবেতর জীবনযাপন করতে হতো গ্রামে। আমরা আধুনিকতার বড়াই করি বটে কিন্তু আমাদের মন-মানসিকতায় আমরা এখনো সেই পশ্চাদপদ সমাজের মানসিকতা লালন করছি। যার জন্য আমাদের উন্নতির পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায় এই অনগ্রসর মানসিকতা। আমরা নিজেরাই নিজেদের বড় করে দেখার জন্য কাজকে কাজ হিসেবে না দেখে কাজের মধ্যে শ্রেণী বিভাগ করি। একটি ভবন নির্মাণকাজ শুরু হলে দেখা যায়, নারীরা বাচ্চা কোলে নিয়ে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে ইট ভাঙছে, মাটি কাটছে।
নারীদের অধঃস্তন করে রাখার পাশাপাশি সর্বত্রই নারীকে ঠকানোর এক প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। কর্মক্ষেত্রে তার জ্বলন্ত উদাহরণ রয়েছে। নির্মাণকাজ পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, কর্মঘণ্টা একই থাকলেও নারীর প্রতি বেতনের বৈষম্য রয়েছে। পুরুষ শ্রমিকরা বসে বিশ্রাম করে,বিড়ি বা পান খায়,গল্প-গুজব করে। এভাবে পুরুষ শ্রমিকরা দিনের মোট কর্মঘণ্টা থেকে দেড় থেকে দুই ঘণ্টা কাজ কম করে। অথচ নারী শ্রমিকরা শুধু ২০-২৫ মিনিট খাওয়ার সময়টুকু বাদে কোনো বিশ্রাম গ্রহণ করে না। এভাবে হিসেব করে দেখা যায়, পুরুষ শ্রমিক থেকে নারী শ্রমিক দেড় ঘণ্টা কাজ বেশি করছে। অথচ নারী শ্রমিককে মজুরি দেয়ার সময় বৈষম্যমূলক আচরণ করা হচ্ছে।
নির্মাণকাজে নিয়োজিত নারী শ্রমিককে পুরুষ শ্রমিকের তুলনায় কম পারিশ্রমিক দেয়া হয়। যদিও প্রায়ই নারী শ্রমিককে নির্ধারিত সময়ের বাইরে আরো অধিক সময় কাজ করতে হয়। কিন্তু কোনো অতিরিক্ত পারিশ্রমিক দেওয়া হয় না।
বাংলাদেশের পোশাকশিল্প টিকে আছে নারী শ্রমিকদের কারণে। নারী শ্রমিকদের কর্মদক্ষতা, সততা, আন্তরিকতা এবং নিষ্ঠার কারণে পোশাক শিল্প আজ বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। একজন নারী শ্রমিক যে পরিমাণ শ্রম দেয়,পাশাপাশি একজন পুরুষ শ্রমিক কিন্তু ততটা শ্রম দেয় না। নারী শ্রমিকরা ফাঁকি দেয় কম, কাজ করে বেশি। যখন নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পোশাক সরবরাহ করতে হয়,তখন নারী শ্রমিকরা দিন-রাত পরিশ্রম করেন। নারীদের একদিকে থাকে সংসার,সন্তান, পারিবারিক কাজকর্ম,অপরদিকে থাকে অফিস। শত ঝড়-ঝঞ্ঝা মাথায় নিয়ে নির্বিকার চিত্তে কাজ করে নারী শ্রমিকরা। তারপরও তারা এত বেশি অবহেলিত কেন? কেউবা অল্প শিক্ষায় শিক্ষিত, কেউবা নিরক্ষর কিন্তু শ্রম দেয়ার বেলায় শিক্ষিত শ্রমিকের চেয়ে কোনো অংশে কম শ্রম দিচ্ছেন না। তাদের শ্রমকে পুঁজি করে মালিকরা হচ্ছে কোটিপতি। অথচ এসব নারী শ্রমিকদের ন্যূনতম মূল্যায়ন করা হয় না। কেন দিনের পর দিন তাদের এভাবে অবমূল্যায়ন করা হবে? তারা লেখাপড়া কম জানে বলে, কিংবা হিসাব কম বোঝে বলে, তাদের ওভারটাইমের বেতন কর্তন করে রাখা হয় নানা উছিলায়। বেশিরভাগ পোশাক শিল্পে দেখা যায়, দুপুরের লাঞ্চ করার জন্য ছাদ বরাদ্দ করা হয়ে থাকে। এই ছাদে নারী শ্রমিকদের দুপুরের প্রখর রোদে বসে লাঞ্চ করতে হয়। যাদের মাধ্যমে মালিক এত আয় উন্নতি করছে,তাদের খাওয়ার জন্য একটা লাঞ্চ রুমও কি করা যায় না? হতে পারে একসঙ্গে এত কর্মীর জন্য একটি লাঞ্চ রুম মোটেও যথেষ্ট নয়। তাহলে দুই কিংবা তিন দলে বিভক্ত হয়ে লাঞ্চ করবে। তারপরও তো তারা একটু শারীরিক এবং মানসিক শান্তি নিয়ে লাঞ্চ করতে পারে।
সকাল থেকে একটানা পরিশ্রমের ফলে শান্তিপূর্ণভাবে একটু খেতে বসার অধিকারও তাদের নেই। কারণ ওরা অল্প আয়ের শ্রমিক। এমন অনেক গার্মেন্টস কর্মীকে দেখেছি পরিবারের মুখে অন্ন তুলে দেয়ার জন্য নিজে দিনের পর দিন অভুক্ত থাকে। দুপুরে লাঞ্চ করে না। মালিক পক্ষ কি কোনো দিন এসব অসহায় কর্মীদের খবর রাখে। মানুষ হয়ে জন্মালেই মানুষ বলে পরিচিত হয় না। মানবতাবোধ বিবর্জিত মানুষকে কখনো মানুষ হিসেবে গণ্য করা হয় না। মনে রাখা দরকার,আজ ওদের শ্রম পুঁজি করেই এত বড় বড় দালানকোঠা, গাড়ি-বাড়ি হয়েছে। নিজে না বদলালে,বদলাবে না কিছুই।
শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের দিবস মহান মে দিবস। বিশ্বের শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায়ে ১৩৮ বছর আগে শ্রমিকদের ঐতিহাসিক আন্দোলনের পর থেকে এই দিনটি বিশ্বব্যাপী শ্রমিকের দিন হিসেবে পরিচিত হয়ে আসছে। ১৮৮৬ সালের ১ মে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের হে মার্কেটে শ্রমের উপযুক্ত মূল্য এবং দৈনিক আট ঘণ্টা কাজের দাবিতে আন্দোলনরত শ্রমিকদের ওপর পুলিশ গুলি চালালে বহু শ্রমিক হতাহত হন। ১৮৮৯ সালে প্যারিসে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক সম্মেলনে দিবসটিকে ‘মে দিবস’ হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত হয়। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ পেরিয়ে যাচ্ছে কিন্তু আজো নারী শ্রমিকের উপযুক্ত মূল্যায়ন হচ্ছে না। এভাবে আর কতকাল এ অবলা নারীদের বৈষ্যমের শিকার হতে হবে?