বাসস
  ০৯ জানুয়ারি ২০২৫, ১৮:০৭
আপডেট : ০৯ জানুয়ারি ২০২৫, ১৮:২৩

পিয়ের পলিয়েভ : কানাডার প্রধানমন্ত্রিত্বের হাতছানি?

কনজারভেটিভ পার্টির নেতা পিয়ের পলিয়েভ। ছবি: ফেসবুক

\ হারুন আল নাসিফ \

ঢাকা, ৯ জানুয়ারি, ২০২৫ (বাসস) : কানাডার টানা দুই মেয়াদের প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো সম্প্রতি পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছেন। তবে তিনি লিবারেল পার্টির নতুন নেতা নির্বাচিত না হওয়া পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করবেন। এই পরিস্থিতিতে বিরোধী কনজারভেটিভ পার্টির নেতা পিয়ের পলিয়েভের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে।

পিয়ের পলিয়েভ কানাডার হাউস অব কমন্সে বিরোধী দলের নেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। সাম্প্রতিক জরিপগুলোতে দেখা গেছে, তিনি জনপ্রিয়তায় জাস্টিন ট্রুডোর থেকে এগিয়ে আছেন। এমনকি, কিছু সমীক্ষায় তাকে ভাবী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে প্রথম সারির প্রার্থী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, কানাডার প্রধানমন্ত্রিত্ব তাকে হাতছানি দিচেছ।

তবে কানাডার রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় প্রধানমন্ত্রী নির্বাচন একটি জটিল প্রক্রিয়া। লিবারেল পার্টি নতুন নেতা নির্বাচন করবে এবং সেই নেতা পরবর্তী সাধারণ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। পলিয়েভের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সম্ভাবনা নির্ভর করবে কনজারভেটিভ পার্টির নির্বাচনী সাফল্যের ওপর। কিন্তু তার সমর্থকরা বিশ্বাস করেন, তিনি দেশের জন্য সঠিক নেতা হতে পারেন।

কানাডার রাজনৈতিক পরিস্থিতি দ্রুত পরিবর্তনশীল। ফলে প্রকৃত পরস্থিতি বুঝতে পরবর্তী সাধারণ নির্বাচন এবং লিবারেল পার্টির নতুন নেতা নির্বাচন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।

আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে

কানাডার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে পিয়ের পলিয়েভের নাম বর্তমানে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে। সাম্প্রতিক একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, পলিয়েভ কনজারভেটিভ পার্টির নেতা হিসেবে দেশের অর্থনীতি এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণির সমস্যাগুলো সমাধানে কার্যকর নীতিমালা প্রণয়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, কানাডার বর্তমান রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের পরিপ্রেক্ষিতে অনেক নাগরিক তার নেতৃত্বকে একটি সম্ভাব্য সমাধান হিসেবে দেখছেন। বিশেষ করে উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি এবং জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির মতো বিষয়গুলোতে তার খোলামেলা দৃষ্টিভঙ্গি তাকে আরও জনপ্রিয় করে তুলছে।

তবে তার কিছু নীতির সমালোচনা রয়েছে। বিশেষ করে জলবায়ু পরিবর্তন এবং অভিবাসন নীতির ক্ষেত্রে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ভবিষ্যতে তার সাফল্য নির্ভর করবে এই বিষয়গুলোতে তার অবস্থানের ওপর এবং জনগণ কতটা তাকে সমর্থন করবে তার ওপর।

সামনের দিনগুলোতে, তার নেতৃত্ব এবং কৌশলগত পদক্ষেপ কানাডার রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

মর্নিং শোজ দ্য ডে

পিয়ের পলিয়েভ মাত্র ২০ বছর বয়সেই  কানাডার জন্য একটি রোডম্যাপ তৈরি করেছিলেন। বর্তমানে ৪৫ বছর বয়সী এই নেতা সেই সময় একটি প্রবন্ধ প্রতিযোগিতায় তার দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেছিলেন। প্রবন্ধটি ছিল, প্রধানমন্ত্রী হলে কী করবেন- এ বিষয়ে। সেখানে তিনি একটি কম করের এবং ছোট সরকারের ধারণা উপস্থাপন করেন।

তিনি বলেছিলেন, 'ভোক্তা ও বিনিয়োগকারীদের হাতে থাকা এক ডলার একজন রাজনীতিবিদের খরচ করা এক ডলারের চেয়ে অনেক বেশি কার্যকর।' আজ পলিয়েভ তার সেই দৃষ্টিভঙ্গি বাস্তবায়নের আরও কাছাকাছি পৌঁছে গেছেন। সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে তিনি তার সেই প্রবন্ধের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন।

গত কয়েক মাস ধরে জাতীয় জরিপগুলোতে পলিয়েভের কনজারভেটিভ পার্টি দুর্বল লিবারেলদের থেকে অনেক এগিয়ে রয়েছে। এখন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে তার দল সংখ্যাগরিষ্ঠ সরকার গঠন করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর পদত্যাগের ঘোষণার প্রেক্ষাপটে সম্ভাব্য আগাম নির্বাচন সামনে রেখে পলিয়েভ 'কাণ্ডজ্ঞানের রাজনীতি'-তে ফিরে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। অর্থনৈতিক স্থবিরতা এবং বাড়ি ভাড়া ও ক্রয়ক্ষমতার সংকটে ভুগতে থাকা কানাডিয়ানদের জন্য তিনি একটি বিকল্প উপস্থাপন করেছেন। তিনি ট্রুডোর নীতিকে ‘স্বৈরতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র’ বলে অভিহিত করেছেন।

পলিয়েভের জয় তাকে পশ্চিমা বিশ্বের সেই ডানপন্থী জনপ্রিয় নেতাদের কাতারে নিয়ে যাবে, যারা ক্ষমতাসীন সরকারগুলোকে পরাজিত করেছেন। যদিও তাকে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে তুলনা করা হয়, এবং এলন মাস্কসহ বেশ কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি তার সমর্থক, তবুও পলিয়েভের গল্প একান্তই কানাডিয়ান।

আলবার্টা থেকে অটোয়া

পলিয়েভের জন্ম কানাডার পশ্চিমাঞ্চলীয় প্রদেশ আলবার্টায়। তার জন্ম হয়েছিল ১৬ বছর বয়সী এক মায়ের ঘরে, যিনি তাকে দত্তক দিয়ে দেন। এক স্কুল শিক্ষক দম্পতি তাকে দত্তক নেন এবং ক্যালগারির উপশহরে তাকে বড় করে তোলেন।

তিনি তার ছোটবেলা সম্পর্কে বলেন, ‘আমি সবসময় বিশ্বাস করি পরিবার এবং সমাজের মধ্যকার স্বেচ্ছা উদারতা আমাদের জন্য সবচেয়ে বড় সামাজিক সুরক্ষাবেষ্টনী।’

তরুণ বয়স থেকেই তিনি রাজনীতির প্রতি আগ্রহ দেখান। ক্যালগারি বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক অধ্যয়নকালে তিনি স্টকওয়েল ডে-এর সঙ্গে কাজ শুরু করেন, যিনি পরে কনজারভেটিভ প্রধানমন্ত্রী স্টিফেন হার্পারের মন্ত্রিসভার একজন মন্ত্রী হন।

ডে-এর নেতৃত্বে পলিয়েভ অটোয়া যান এবং পরে নিজেই সংসদ সদস্য পদে নির্বাচন করেন। মাত্র ২৫ বছর বয়সে তিনি ২০০৪ সালে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। সেই থেকে তিনি এই আসনটি ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছেন।

‘স্কিপি’ থেকে নেতা

অটোয়ায় পলিয়েভ তার তারুণ্যদীপ্ত উদ্যম এবং  ধারালো যুক্তি ও বাকচাতুর্যের জন্য 'স্কিপি' নামে পরিচিতি লাভ করেন। তবে দলের অভ্যন্তরে তিনি ছিলেন কৌশলী এবং সবার মতামত শুনতে আগ্রহী। তিনি বিতর্কে অংশ নিতে পছন্দ করতেন।

২০২২ সালে কনজারভেটিভ দলের নেতা হওয়ার পর তিনি প্রধানমন্ত্রী ট্রুডোকে তীব্র ভাষায় আক্রমণ করেন এবং সাধারণ মানুষের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনে সচেষ্ট হন।

পলিয়েভের নীতিমালা

পলিয়েভকে একজন 'নরমপন্থী জনপ্রিয়তাবাদী' নেতা হিসেবে বর্ণনা করা হয়। তিনি সাধারণ মানুষের সমস্যাগুলো তুলে ধরেন এবং প্রতিষ্ঠিত ধনিক সম্প্রদায়ের সমালোচনা করেন।

টিকা ম্যান্ডেটের বিরুদ্ধে তিনি 'ফ্রিডম কনভয়' আন্দোলন সমর্থন করেছিলেন। অপরাধ দমনে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন সামাজিক বিষয়ে তার ভূমিকা তুলনামূলকভাবে নিরপেক্ষ।

তবে পরিবেশ সংরক্ষণে তার নীতিমালা নিয়ে সমালোচনা রয়েছে। পরিবেশ সংরক্ষণে কার্বন কর বাতিল করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তিনি সমালোচনার মুখে পড়েছেন। তবে তার লক্ষ্য 'কানাডিয়ান স্বপ্ন' ফিরিয়ে আনা।

ভবিষ্যৎ লক্ষ্য

পলিয়েভ প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে তিনি অতিরিক্ত বড় নীতিমালা বা আদর্শিক পরিকল্পনার পরিবর্তে সাধারণ মানুষের কল্যাণকে অগ্রাধিকার দেবেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের সাধারণ মানুষের মহত্ত্বই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।’

পরিশেষে বলতে হয়, কানাডার রাজনৈতিক অঙ্গনে পলিয়েভ কতটা সফল হবেন, তা সময়ই বলে দেবে।