সাতক্ষীরা, ২৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ (বাসস): সমাজ ও পরিবারের নানা বাধা কাটিয়ে জীবন সংগ্রামে সাফল্য অর্জন করেছেন সাতক্ষীরা জেলার পাঁচ নারী। নানা প্রতিকূল পরিস্থিতি পেরিয়ে তৃণমূল থেকে উঠে আসা এসব নারীকে খুঁজে বের করেছে জয়ীতা অন্বেষণ বাংলাদেশ।
২০২৪-২৫ সালের জয়ীতা অন্বেষণ বাংলাদেশ শীর্ষক কর্মসূচির আওতায় খুঁজে বের করা হয় প্রিয়াংকা বিশ্বাস, নাহিদাল আরজিন, মমতাজ খাতুন, নুরুন্নাহার বেগম এবং স্বর্ণলতা পালকে। জয়ীতা অন্বেষণের ৫টি ক্যাটাগরীতে এই পাঁচ নারীকে সম্মাননা দিয়েছে জেলা মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর।
এসব নারীর প্রত্যেকের জীবনে রয়েছে ব্যাপক সংগ্রাম, শ্রম আর নিষ্ঠার কাহিনী। রয়েছে অসীম আত্মশক্তি ও সংগ্রামের আলাদা আলাদা জীবন কাহিনী। তাদের সেই সংগ্রামী জীবনের কিছু তথ্য নিম্নে তুলে ধরা হলো।
প্রিয়াংকা বিশ্বাস:
অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জনকারী এক নারী, যিনি জীবন সংগ্রামে দারিদ্র্যকে পেছনে ফেলে সাফল্য অর্জন করেছেন। দশম শ্রেণিতে পড়াকালে তার বিয়ে হয়ে যায়। বিয়ের পর যৌথ পরিবারে সংসার করার পাশাপাশি পড়াশুনা করে অনেক ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে তিনি এম.এ পাশ করেন। বাল্যবিবাহের শিকার হয়ে পরিবারিক কষ্ট থেকে তিনি উপলদ্ধি করেন নারীদের জন্য কিছু করার ।
আত্ম-উপলব্ধি ও আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান হয়ে প্রশিক্ষণ নেন টেইলারিং এর ওপর। প্রশিক্ষণ শেষে বাবার দেওয়া একটা সেলাই মেশিন এবং এনজিও থেকে ৫ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে টেইলার্সের জন্য ছিট কাপড় ক্রয় দিয়ে শুরু করেন উদ্যোক্তা জীবন। একপর্যায়ে দায়দেনা পরিশোধ শেষে লাভের মুখ দেখতে শুরু করেন।
এরপর নারী উদ্যোক্তা হিসাবে ব্যবসার জন্য ব্যাংক থেকে কিছু টাকা ঋণ নেন। সাতক্ষীরা শহরে একটা ছোট খাটো কারখানা ভাড়া নিয়ে কাজ শুরু করেন তিনি। বর্তমানে সেখানে ৫০জন লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে।
এরপর তিনি বিসিক অফিসের সহযোগিতায় সাতক্ষীরা বিসিক শিল্প নগরিতে ২টি প্লট ক্রয় করেন। সেখানে ধীরে ধীরে একটি কারখানা গড়ে তোলেন। বর্তমানে বিসিক শিল্পনগরীর প্রতিষ্ঠানে প্রায় ১০০ জন লোক কাজ করছে। কারখানাটি ‘প্রিয়াংকা নিট গার্মেন্টস’ নামে প্রতিষ্ঠিত হয়। এই গার্মেন্টস-এ বিভিন্ন ধরনের গেঞ্জি, ট্রাউজার এবং ব্যাগ তৈরি হয়। এখানে অনেক বেকার ছেলে মেয়েকে প্রশিক্ষণ দিয়ে কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে।
একসময় যে প্রিয়াংকা বিশ্বাসের উদ্যোক্তা জীবন শুরু হয়েছিল পাঁচ হাজার টাকার বিনিয়োগ দিয়ে, বর্তমানে তার শিল্প প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগ প্রায় ২ কোটি টাকা। তার প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে শতাধিক লোকের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এর মাধ্যমে তিনি দেশের সামাজিক ও অর্থনীতিতে ব্যাপক অবদান রাখতে পেরেছেন। আর এ নিয়ে তিনি গর্বিত।
নাহিদাল আরজিন:
শিক্ষা ও চাকুরি ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জনকারী নারী। শিক্ষা ও চাকুরিক্ষেত্রে সাফল্য অর্জনকারী নারী নাহিদাল আরজিনও হাজারও প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে শিক্ষার আলো ছড়াচ্ছেন আলোকবর্তিকা হয়ে।
অল্প বয়সে পিতাকে হারিয়ে অসহায় হয়ে পড়েন তিনি। দুই বোন ও এক ভাইয়ের মধ্যে নাহিদাল বড়। দারিদ্র্যের সাথে যুদ্ধ ছিল নিয়মিত। প্রত্যন্ত অঞ্চলে প্রতিদিন ছয় কিলোমিটার পথ হেঁটে বিদ্যালয়ে যাতায়াত করতেন। স্নাতক পাশ করার পর নাহিদাল ২০০১ সালে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক পদে যোগদান করেন।
এরপরে তিনি কৃতিত্বের সাথে বিভিন্ন কোর্স সম্পন্ন করেন। তথ্য প্রযুক্তিকে সঙ্গী করে পাঠদানে বিরল দৃষ্টান্ত দেখিয়ে চলেছেন নাহিদাল। ডিজিটাল কনটেন্ট মডেল তৈরি, পাঠদানের পাশাপাশি তিনি শিশুদের ছড়া, নাচ, গান, গল্প, অভিনয়, চারু ও কারুকলা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, পরিবেশ ও নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য, শরীর চর্চায় নিজেকে সম্পৃক্ত করেছেন।
বৈশ্বিক মহামারিতে করোনাকালীন বিদ্যালয় বন্ধ থাকায় ঘরে বসে শিখি অনলাইনে পাঠদানসহ সরকার ঘোষিত গুগলমিট ব্যবহারের মাধ্যমে পাঠদান অব্যাহত রাখেন তিনি। আইসিটি বিভাগে জেলা অ্যাম্বাসেডর হওয়ার কৃতিত্ব অর্জন করেন নাহিদাল আরজিন।
এছাড়া তিনি মাইক্রোসফট ইনোভেশন এডুকেটর, ওয়েকলেট অ্যাম্বাসেডর, কাহুটসহ বিভিন্ন বিশ্বমানের ব্লেন্ডেড লার্নিংয়ে নিজেকে এবং বিদ্যালয়ের শিশুদের সমৃদ্ধ করছেন প্রতিনিয়ত। কাব ইউনিট লিডার হিসেবে নিজের বিদ্যালয়ের শিশুদের কাব স্কাউটে দক্ষ করে গড়ে তুলছেন।
চারু ও কারুকলার মাষ্টার ট্রেনার হিসেবে বিশেষ করে মেয়ে শিশুদের বিভিন্ন হাতের কাজে পারদর্শী করে তুলছেন। বিভিন্ন পত্রিকায় তার লেখা প্রকাশিত হয়। শিশুদের নিয়ে তার প্রথম লেখা বই ‘অংকুশ’। এছাড়া ছোটদের ‘কম্পিউটার শিখি’ নামের বইয়ের প্রকাশনার কাজ চলমান রয়েছে।
শিক্ষাক্ষেত্রে বিশেষ কৃতিত্বের জন্য নাহিদাল আরজিন সাতক্ষীরা সদর উপজেলায় শ্রেষ্ঠ শিক্ষিকা নির্বাচিত হন। সকল প্রতিবন্ধকতা জয় করেছেন এবং নিজেকে সফল-আলোকিত মানুষ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন নাহিদাল আরজিন।
মমতাজ খাতুন :
একজন সফল জননী। সফল জননী হিসেবে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত মমতাজ খাতুন এক ভাই ও দুই বোনের মধ্যে সকলের বড়। অভাব অনটনের মধ্যে বড় হওয়া মমতাজের ছোট বেলা থেকে খেলাধুলার প্রতি বিশেষ আগ্রহ ছিল। নানা প্রতিকূলতার কারণে তার খেলাধুলা স্কুল পর্যন্ত সীমাবদ্ধ ছিল। ১৯৭৪ সালে বিএ পাশ করার পর শুরু হল তার বিবাহিত জীবন। তার দুই মেয়ে আফরা খন্দকার ও আফঈদা খন্দকার।
ছোট বেলা থেকে তার ইচ্ছা ছিল মেয়েদের খেলাধুলায় পরদর্শি করে গড়ে তুলবেন। তখন থেকে তিনি এবং তার স্বামী খন্দকার আরিফ হোসেন প্রিন্স দু’জনে মিলে মেয়েদের লেখাপড়ার পাশাপাশি লেখাধুলা চর্চা শুরু করেন।
একপর্যায়ে ছোট মেয়ে আফঈদা খন্দকারকে ২০১৬ সালে বি.কে.এস.পি তে মেয়েদের ফুটবল বিভাগে ভর্তি করেন। ২০১৬ সাল থেকে ২০১৯ পর্যন্ত ভারতে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক ফুটবল টুর্নামেন্ট সুব্রত মুখার্জী কাপে অংশগ্রহণ করে এবং ২০১৯ সালে শ্রেষ্ঠ খেলোয়াড় নির্বাচিত হয়। একই সালে বাংলাদেশ জাতীয় দলে অনুর্ধ ১৫ ভূটানে অনুষ্ঠিত সাফ চাম্পিয়ন শীপে বাংলাদেশ জাতীয় দলের হয়ে অংশগ্রহণ করে। ২০১৮ সালে বাংলাদেশ যুব গেমসে ফুটবল বিভাগে অংশগ্রহণ করে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করে। ২০২১ সালে সাফ অনুর্ধ ১৯ চ্যাম্পিয়নশীপে অংশগ্রহণ করে শ্রীলংকার বিরুদ্ধে হ্যাট্রিক হওয়ার গৌরব অর্জন করায় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে আর্থিক সহযোগিতাসহ পদক গ্রহণ করে সে।
তার বড় কন্যা আফরা খন্দকার ২০১৬ সালে বিজয় দিবস বক্সিংয়ে ব্রোঞ্জ পদক অর্জন করে। ২০১৭ সালে বিজয় দিবস ও স্বাধীনতা কাপে সিলভার পদক অর্জন করে। ২০১৮ সালে বাংলাদেশ যুব গেমসে ৪৬ কেজি ওজন শ্রেণিতে সাতক্ষীরা জেলার পক্ষ হতে গোল্ড পদক অর্জন করে। ২০১৯ ও ২০২০ সালে জাতীয় জুনিয়র মহিলা বক্সিংয়ে স্বর্ণ পদক অর্জন করে। ২০২১ সালে মহিলা বক্সিং চ্যাম্পিয়ন শীপে সিলভার পদক অর্জন করায় তাকে সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারসহ বিভিন্ন সংগঠন সংবর্ধনা দেয়। সর্বশেষ প্রফেশনাল বক্সিং চ্যাম্পিয়নশীপে অংশগ্রহণ করে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করেছে। সামাজিক প্রতিবন্ধকতা উপেক্ষা করে তার দুই কন্যার জন্য দেশ ও জাতি গৌরবের শ্রেষ্ঠ স্থানে উঠায় তিনি গর্বিত।
এদিকে ২০১৬ সাল থেকে তাদের নিজ বাড়িতে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান ও মুন্ডা ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে ছিন্নমূল ও গরীব অসহায় মেয়েদেরকে বিনা খরচে, বিনা পারিশ্রমিকে ফুটবলসহ বিভিন্ন খেলায় পারদর্শি করে তোলা হচ্ছে। তারা বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বি.কে.এস.পি ও বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা ফুটবল দলে অংশগ্রহণ করে আসছে। এ সকল মেয়েদের খরচ চালানোর জন্য তিনি একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে চাকুরী নিয়ে তার সামান্য বেতনের অর্থ দিয়ে তাদের যাবতীয় খরচ চালিয়ে আসছেন। তাদের এই খেলাধুূলা শেখানোর জন্য বিভিন্ন সমালোচনা উপেক্ষা করে সহযোগিতা করে আসছেন তিনি।
নুরুন্নাহার বেগম :
সমাজ উন্নয়নে অসামান্য অবদান রেখেছেন। একজন নারী হয়েও জীবন সংগ্রামের মাঝে সমাজ উন্নয়নে অসামান্য অবদান রেখে চলেছেন মোছা. নুরুন্নাহার বেগম। তিনি সাতক্ষীরার ব্রহ্মরাজপুর গ্রামের মৃত শেখ এবাদুল্লাহ’র কন্যা এবং মোশাররফ হোসেনের স্ত্রী।
নিম্নবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসা এই নারী ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য। পেশাগতভাবে তিনি একজন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ধাত্রী এবং পল্লী চিকিৎসক। ১৯৮২ সালে বৈবাহিক বন্ধনে আবদ্ধ হন দরিদ্র কৃষক পরিবারের সন্তানের সাথে।
বিয়ের পর থেকে যৌতুকের জন্য পোহাতে হয় নানা বঞ্চনা এবং নির্যাতন। এক পর্যায়ে তিনি পল্লী চিকিৎসক কোর্স করেন। সেখান থেকে প্রাকটিস শুরু করার পাশাপাশি স্বামীর সহযোগিতায় ধাত্রী প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে পাড়া-মহাল্লায় গর্ভবতী নারীদের চিকিৎসা সেবা দিয়ে বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করেন। ধীরে ধীরে তিনি স্বনির্ভর হন এবং কিছু আবাদি জমি ক্রয় করেন।
১৯৯৬ সালে ব্র্যাকের উপ-আনুষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রমে শিক্ষকতা করেন। পাশাপাশি একটি এনজিও’র সহোযোগিতায় নিজ এলাকার বয়স্ক নারীদের অক্ষর জ্ঞান সম্পন্ন করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন তিনি। এলাকায় ব্যাপক পরিচিতি লাভের পর জনগণের সেবাদানের জন্য ২০১১ সালে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে সংরক্ষিত নারী প্রার্থী হিসেবে অংশগ্রহণ করে মাত্র ৩ ভোটের ব্যাবধানে পরাজিত হন তিনি। পরে ২০১৬ এবং ২০২১ সালে পরপর দুইবার বিপুল ভোটে নির্বাচিত হয়ে নিষ্ঠা ও সততার সাথে দায়িত্ব পালন করেন।
স্বর্ণলতা পাল :
নির্যাতিতা থেকে উদ্যমী, কর্মঠ ও স্বাবলম্বী এক নারীর নাম স্বর্ণলতা পাল। নারী নির্যাতনের বিভীষিকা মুছে ফেলে নব উদ্যমে জীবন শুরু করা এক নারী তিনি। স্বর্ণলতা পাল তালা উপজেলার ধানদিয়া ইউনিয়নের মানিকহার গ্রামের কানাই চন্দ্র পালের কন্যা।
হতদরিদ্র পরিবারে বেড়ে ওঠা স্বর্ণলতা পালের কপাল পোড়া শুরু হয় বিয়ের পর থেকেই। যৌতুকের জন্য নির্যাতন শুরু করে পাষণ্ড স্বামী। এর মধ্যে তাদের ঘরে একপুত্র সন্তান জন্ম নেয়। এরপরও কমেনি নির্যাতনের মাত্রা। এক পর্যায়ে তাদেরকে ফেলে স্বামী অন্য জায়গায় বিয়ে করে সেখানে সংসার করতে শুরু করে। তাদের কোন খোঁজ নিতো না সে। নিরুপায় হয়ে সন্তান নিয়ে বাবার বাড়িতে চলে আসে স্বর্ণলতা। মৃৎশিল্পের কাজ দিয়ে শুরু হয় তার নতুন জীবন। হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রমের মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করে নতুন করে স্বপ্ন দেখে উদ্যমী স্বর্ণলতা পাল। বর্তমানে একমাত্র সন্তানকে নিয়ে সেখানে সুখেই আছেন তিনি।