বরগুনা, ২৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ (বাসস): দক্ষিণ উপকূলের সাগর বেষ্টিত জেলা বরগুনার পাথরঘাটা ও তালতলী উপজেলায় বিভিন্ন চরে পরিবেশবান্ধব ও বিষ মুক্ত শুঁটকির উৎপাদন হচ্ছে।
শীত শুরু হওয়ায় পর প্রতিবছরের মতো এবারও জেলার পাথরঘাটার খেয়াঘাট সংলগ্ন উত্তর পাড়, হরিণঘাটা, পদ্মা, রুহিতা ও চরদুয়ানী এবং তালতলী উপজেলার লাউপাড়া, আশারচর, সোনাকাটা, জয়ালভাঙ্গা এলাকায় স্বাস্থ্যকর পরিবেশে শুঁটকির উৎপাদন হচ্ছে। এ চরগুলোতে সাধারণত বছরের নভেম্বর থেকে মে মাস অবধি ৭ মাস শুঁটকি উৎপাদন (তৈরী) করা হয়।
শুঁটকি উৎপাদনের জন্য শীতের শুরুতেই সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, মোংলাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে জেলেরা তালতলীর লাউপাড়া, আশারচর, সোনাকাটা, জয়ালভাঙ্গাচরে এবং পাথরঘাটার খেয়াঘাট সংলগ্ন উত্তর পাড়, হরিণঘাটা, পদ্মা, রুহিতা ও চরদুয়ানীতে আসতে শুরু করেন। চরগুলোতে নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত চলে শুঁটকি প্রক্রিয়াজাতকরণের কাজ। এ সময়টায় শুঁটকিপল্লীর ক্রেতা, বিক্রেতা ও শ্রমিকরা সরব থাকেন। প্রতিটি শুঁটকিপল্লী থেকে সপ্তাহে অন্তত ১শ থেকে ১শ ৫০ মণ শুঁটকি দেশের বিভিন্ন জেলায় পাঠানো হয়। প্রায় ২০ হাজার জেলে দিন-রাত কাজ করেন। শুঁটকি তৈরির সঙ্গে সরাসরি ও পরোক্ষভাবে কমপক্ষে তিন লাখ মানুষের জীবন-জীবিকা জড়িত।
আশারচর শুঁটকিপল্লীতে দেখা গেছে, ছয় শতাধিক জেলে ও মালিক শুঁটকি উৎপাদনের উদ্দেশ্যে ছোট ছোট ঘর তৈরি করে বাঁশের মাঁচায় ও মাদুরে করে রোদে মাছ শুঁকাচ্ছেন। একের পর এক মাছ ধরার ট্রলার সমুদ্র থেকে আসছে। সেই মাছকে প্রস্তুত করা হচ্ছে শুঁটকি উৎপাদনের জন্য। প্রায় ২৫ প্রজাতির মাছের শুঁটকি তৈরি হয় এখানে। এর মধ্যে রূপচাঁদা, ছুরি, কোরাল, সুরমা, লইট্টা ও পোপা অন্যতম। এ ছাড়া চিংড়ি, ভোল, মেদসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছেরও অনেক চাহিদা রয়েছে।
জেলেরা জানান, তিন ধাপে কাজ করেন শুঁটকি পল্লীর শ্রমিকরা। প্রথমে জেলেরা মাছ শিকার করে নদী থেকে কাঁচা মাছ শুঁটকি পল্লীতে নিয়ে আসেন। এরপর নারী শ্রমিকরা সেগুলো পরিষ্কার করেন এবং মাছগুলো পরিষ্কার পানিতে ধুয়ে মাচায় শুঁকাতে দেন। তিন-চার দিনের রোদে মাছগুলো শুকিয়ে শক্ত হয়। শুরু থেকেই প্রস্তুত থাকেন ক্রেতা, পাইকার ও ব্যবসায়ীরা। উৎপাদিত শুঁটকি খুলনা, চট্টগ্রাম, সৈয়দপুর, জামালপুরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে চালান হয়। প্রস্তুত করার সময় কোনো প্রকার কীটনাশক বা অতিরিক্ত লবণ দেওয়া হয় না বলে এখানকার শুঁটকির চাহিদা বেশি।
বেসরকারি উদ্যোগে ২০২১ সালে পাথরঘাটা ও তালতলী উপজেলায় ২৯৩ জন ক্ষুদ্র উদ্যাক্তাকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এ সময় আধুনিক পদ্ধতিতে বিষমুক্ত শুঁটকি তৈরি, সংরক্ষণ, ফিস ড্রয়ার ব্যবহার, প্যাকেটজাতকরণ, বিপণন কেন্দ্র স্থাপন, শুঁটকি বাজারজাতকরণসহ বিভিন্ন বিষয়ে ধারণা দেওয়া হয়। এরই মধ্যে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত উদ্যোক্তরা শুঁটকি উৎপাদন প্রক্রিয়ায় নিজেদের সম্পৃক্ত করেছেন। এছাড়া বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, পরিবেশবান্ধব বিনিয়োগ এবং শুঁটকি উৎপাদনের জন্য পেশাগত স্বাস্থ্য বিবেচনার মাধ্যমে ক্ষুদ্র এ সকল উদ্যাক্তাদের সহায়তা দেওয়া হয়েছে। সাগর থেকে আহরিত সামুদ্রিক মাছ, লইট্টা, ছুরি, চিংড়ি, লাক্ষা, কাঁচকি, গাবের আটি, মধু ফালিসা, কাবিলা, রূপচাঁদা, সাদাপোয়া, কামট, হাঙ্গর, মরমা, বৈরাগী, কোরাল ইত্যাদি তাজা মাছের আঁশ, নাড়ি-ভূড়ি ফেলে আংশিক কেটে ড্রেসিং করে বিশুদ্ধ পানিতে ধূয়ে পানি ঝরানোর পর ঝুলিয়ে রাখা হয়। পানি ঝরে যাবার পরে হলুদ এবং মরিচের গুঁড়া মিশিয়ে পানিতে ডুবিয়ে রাখা হয়। পরে পলিথিনে ভরে শুকানোর জন্য বাঁশ দিয়ে ৩-৪ ফুট মাঁচা তৈরি করে মশারির জাল দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়; -যাতে মাছি বা পোকা পড়তে না পারে। এভাবে সনাতন পদ্ধতিতে সূর্যের আলো ও বাতাসের সাহায্যে মাছ শুকিয়ে শুঁটকি করা হচ্ছে। যারা শুঁটকি তৈরিতে সার্বক্ষণিক কাজ করেন, তাদের হাতে গ্লাভসও ব্যবহৃত হচ্ছে। বিশুদ্ধ পানি, স্বাস্থ্যসম্মত পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা রয়েছে শুঁটকি উৎপাদনে নিয়োজিত শ্রমিকদের জন্য। শুঁটকি সংরক্ষণে কোনো ধরনের রাসায়নিক দ্রব্য বা কীটনাশক ব্যবহৃত হচ্ছে না।
ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, বর্ষার কয়েক মাস ছাড়া বছরের বাকি সময়ে মোটামুটি হলেও সবচেয়ে বেশি শুঁটকি তৈরি হয় শীতকালে। এখানকার শুঁটকি মাছের গুঁড়ো (ডাস্ট) সারা দেশে পোলট্রি ফার্ম ও ফিশ ফিডের জন্য সরবরাহ হয়ে থাকে। বর্তমানে প্রতি কেজি ছুরি মাছের শুঁটকি ৭শ থেকে ৮শ টাকায়, রূপচাঁদা ১ হাজার থেকে দেড় হাজার টাকা, মাইট্যা ৮শ থেকে ১ হাজার, লইট্যা ৬শ থেকে ৭শ, চিংড়ি ৭শ থেকে ৯শ এবং অন্যান্য ছোট মাছের শুঁটকি ৩শ থেকে ৫শ ৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। শুঁটকি ব্যবসায়ী রেজাউল ইসলাম বলেন, ‘শুঁটকি তৈরি করার আগেই এখান থেকে সরকারিভাবে এসব শুঁটকি বিদেশে রপ্তানির উদ্যোগ গ্রহণ করা হোক। কারণ দেশ থেকে সরকারিভাবে শুঁটকি রপ্তানির কোনো ব্যবস্থা নেই।’
বরগুনা ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক, পুষ্টিবিদ ডা. একেএম নজমুল আহসান জানান, খাদ্য তালিকায় শুঁটকি মাছ আমিষের চাহিদা পূরণ করে আসছে। শুঁটকির যথেষ্ট চাহিদা থাকা সত্ত্বেও স্বাস্থ্যসম্মত, বিষমুক্ত শুঁটকি বাজারে খুব বেশি পাওয়া যায় না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই কীটনাশকসহ বিভিন্ন কেমিক্যাল মিশানো হওয়ায় গুণগত মান যেমন থাকে না, তেমনি স্বাস্থ্য ঝুঁকিও থেকে যায়। তবে বরগুনায় উৎপাদিত শুঁটকি বিষ মুক্ত শুনেছি; -এটিতে স্বাস্থ্যঝুঁকি থাকার কথা নয়।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা, মো. মহসীন জানিয়েছেন, শুঁটকি উৎপাদনে বরগুনা সম্ভবনাময় এলাকা। বিষমুক্ত শুঁটকি উৎপাদনে উদ্যোক্তা সৃষ্টিতে মৎস্য বিভাগ থেকে মাঠ পর্যায়ে তদারকি করা হচ্ছে, সার্বিক সহযোগিতাও দেয়া হচ্ছে।