১৯৭১ এর ২৮ মার্চ সেনানিবাস ঘেরাও রংপুরের মানুষের এক অসীম বীরত্বগাঁথা

বাসস
প্রকাশ: ২৮ মার্চ ২০২৫, ১৪:২৭
ছবি: সংগৃহীত

\ মো. মামুন ইসলাম \

রংপুর, ২৮ মার্চ, ২০২৫, (বাসস) : ১৯৭১ সালের ২৮ মার্চ রংপুরের হাজারো মুক্তিকামী মানুষ বীরত্বের সাথে দখলের উদ্দেশ্যে সেনানিবাস ঘেরাও করেন। এই অসম এক অভিযানে অংশগ্রহণের সময় শত শত মানুষ শাহাদতবরণ করে বীরত্বগাঁথার এক অনন্য নজির স্থাপন করেছেন।

আজ ২৮ মার্চ, রংপুরের মানুষের জন্য স্মরণীয় সেই বীরত্বগাঁথার দিন। মহান মুক্তিযুদ্ধ শুরুর মাত্র তিন দিনের মাথায় এই দিনে বাঁশের লাঠি, তীর-ধনুক, দা-কুড়াল, বল্লম নিয়ে রংপুর সেনানিবাস ঘেরাও করে ইতিহাসে এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল অকুতোভয় বীর মানুষরা।

যথাযথ মর্যাদায় আজ পালন করা হচ্ছে রংপুরের ঐতিহাসিক সেনানিবাস ঘেরাও দিবস। তবে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার ৫৪ বছর পরও এখনো জাতীয়ভাবে দিনটির স্বীকৃতি মেলেনি। অথচ বাঁশের লাঠি, তীর-ধনুক, দা-কুড়াল, বল্লম নিয়ে সেনানিবাস ঘেরাও করার নজির বিশ্বে আর কোনো দেশে নেই। এটি ছিল মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে সাহসিকতার এক বিরল ঘটনা।

প্রত্যক্ষদর্শী ও বীর মুক্তিযোদ্ধারা জানিয়েছেন, একাত্তরের শুরুতে ৩ মার্চ শহীদ হন রংপুরের কিশোর শংকু সমজদার। এরইমধ্যে ২৪ মার্চ নিসবেতগঞ্জ এলাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর একটি জিপ গাড়িতে হামলা করে অস্ত্র ছিনিয়ে নিয়ে আব্বাসী নামের পাকিস্তানি এক সেনাসদস্যকে দা দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করেন স্থানীয় শাহেদ আলী নামের একজন মাংস বিক্রেতা। এই নিয়ে গোটা শহরে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ক্রোধে ফেটে পড়ে। রংপুরের স্বাধীনতাকামী মানুষও সেনানিবাস ঘেরাওয়ের প্রস্তুতি নিতে থাকেন।

২৮ মার্চ সেনানিবাস ঘেরাওয়ের জন্য বিভিন্ন হাট-বাজার, এলাকায় ঢোল পিটিয়ে জানিয়ে দেওয়া হয় দিনক্ষণ। বাঙালির মুক্তি আন্দোলনের প্রচারে মেলে অভূতপূর্ব সাড়া।

১৯৭১ সালের ২৮ মার্চ দিনটি ছিল রোববার। সেদিন সকাল থেকে রংপুরের বিভিন্ন এলাকার মানুষ সেনানিবাস দখলের জন্য সংগঠিত হতে থাকেন। রংপুর সদর, গংগাচড়া, বদরগঞ্জ, মিঠাপুকুর উপজেলাসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে ছাত্র, কৃষক, দিনমজুরসহ বিভিন্ন ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব পেশার মানুষ দা, কোদাল, কুড়াল, বর্শা, বল্লম হাতে নিসবেতগঞ্জ এলাকায় একত্রিত হন। বিশেষ করে আদিবাসী সাঁওতালরা তীর-ধনুক হাতে সেনানিবাস ঘেরাও করতে আসেন। বেলা ১১টার দিকে হাজার হাজার মানুষ সেনানিবাসের দিকে এগিয়ে যেতে থাকলে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী মেশিনগান দিয়ে গুলি ছুড়ে। এতে মাত্র ৫ মিনিটে এলাকাটি স্তব্ধ হয়ে যায়। শত শত মরদেহ পড়ে থাকে সেখানকার ঘাঘট নদীর তীর এলাকায়। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা মরদেহগুলো একখানে জড়ো করে পুড়িয়ে ফেলা হয়। তখনও যেসব মানুষ বেঁচে ছিলেন তাদের বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করা হয়। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী এবং সে সময় রংপুর সেনানিবাসে কর্মরত ২৯ ক্যাভেলরী রেজিমেন্টের মেজর নাসির উদ্দিন তার ‘যুদ্ধে যুদ্ধে স্বাধীনতা’ গ্রন্থে সে দিনের বর্ণনায় এসব তথ্য তুলে ধরেছেন।

তিনি বর্ণনা করেছেন, ‘আহতদের আর্তনাদে গোটা এলাকার আকাশ-বাতাস যেন ভারি হয়ে উঠল। সেদিন সন্ধ্যার আগেই নির্দেশমতো ৫ থেকে ৬শ মরদেহ পেট্রল ঢেলে জ্বালিয়ে দেওয়া হলো। দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল আগুন। এ আগুন অন্য যে কোনো আগুনের চেয়ে অনেক বেশি লাল। অনেক বেশি দহন করে এই বহ্নিশিখা। খুব কাছ থেকেই সেই আগুন আমি দেখছি। দেখছি কেমন করে জ্বলছে স্বাধীনতাকামী অসহায় মানব সন্তান।’

সেদিনের সেনানিবাস আক্রমণে অংশ নেওয়া বীর মুক্তিযোদ্ধা মাহবুবর রহমান জানান, মুক্তির নেশায় পাগল এসব মানুষদের সংগঠিত করেন তৎকালীন মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক সিদ্দিক হোসেন এমপি, আব্দুল গণি, তৈয়বুর রহমান, মুখতার এলাহি, আবুল মনছুর, ইছহাক চৌধুরী, ন্যাপ নেতা সামছুজ্জামান ও কমিউনিস্ট নেতা ছয়ের উদ্দিনসহ আরো অনেকে। সেদিন বিভিন্ন জায়গা থেকে আসা গ্রামের হাজার হাজার বিক্ষুব্ধ মানুষ তীর-ধনুক, দা-কুড়াল, বল্লম ও বাঁশের লাঠি হাতে নিয়ে সেনানিবাসের আশপাশের এলাকাসহ ঘাঘট নদীর তীরে জমায়েত হয়। শুরু হয় পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে সম্মুখ লড়াই।

তিনি আরো বলেন, ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী ওঁরাও সম্প্রদায়ের তীরন্দাজ সাঁওতালরা এই আক্রমণে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। কয়েকটি দলে বিভক্ত হয়ে তারা রংপুর সেনানিবাসে প্রবেশের চেষ্টা করে। এ সময় সেনানিবাস থেকে আসতে থাকে বৃষ্টির মতো গুলি। গুলিবিদ্ধ হয়ে সেখানেই শহীদ হন হাজারেরও বেশি মানুষ। সেদিন এই সম্মুখ যুদ্ধে নাম জানা-অজানা অনেক নিরস্ত্র মানুষ পাকিস্তানি হানাদারদের গুলিতে শহীদ হন। আহত হন অগুণিত। এখন এসব শহীদ পরিবার ও আহত ব্যক্তিদের খোঁজ রাখে না কেউ।

অনেক আহত ব্যক্তি পঙ্গুত্ববরণ করে মানবেতর জীবনযাপন করছেন।

এদিকে প্রতিবছরের ন্যায় এবারো রংপুর জেলা প্রশাসন, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও স্থানীয় এলাকাবাসীর উদ্যোগে নানা অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে পালিত হচ্ছে সোননিবাস ঘেরাও দিবস। আজ সকালে সেনানিবাসের নিকটে ঘাঘট নদীর তীরে নিসবেতগঞ্জে ‘রক্ত গৌরব’ স্মৃতিস্তম্ভে ফুল দিয়ে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয়।

২৮ মার্চ মুক্তিযুদ্ধ তথা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে এটাই ছিল মুখোমুখি প্রথম যুদ্ধ। কিন্তু সেদিনের হাজার হাজার দেশপ্রেমী জনতার আত্মত্যাগের স্বীকৃতি আজও মিলেনি। প্রতিবছর ২৮ মার্চ এলে কিছু অনুষ্ঠানের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকছে এসব বীর শহীদদের আত্মত্যাগ। তাই রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতির দাবি জানিয়েছেন শহীদ পরিবারগুলো।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে: নৌপরিবহন উপদেষ্টা
স্বাধীনতা কাপ ভলিবলের ফাইনালে বিমান ও বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড
গুমসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার সরকারের অগ্রাধিকার তালিকায় রয়েছে: আইন উপদেষ্টা
র‌্যাংকিংয়ে উন্নতি বাংলাদেশের নাহিদা-শারমিন-রিতুর
উইজডেনের বর্ষসেরা বুমরাহ ও মান্ধানা
স্থানীয়ভাবে গুজব ও অপতথ্য মোকাবিলায় জেলা তথ্য অফিসসমূহকে কাজ করতে হবে: তথ্য উপদেষ্টা 
পোপ ফ্রান্সিসের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় যোগ দেবেন প্রধান উপদেষ্টা
১ মে ঢাকায় ‘বিশাল জনসভা’ করবে বিএনপি
গিলের ব্যাটিংয়ে শীর্ষ স্থান ধরে রেখেছে গুজরাট
গুলশানে ডিএনসিসির রাস্তা ও ফুটপাতের ২০০টি অবৈধ দোকান উচ্ছেদ
১০