নকশি কাঁথায় আয় বাড়ছে রাজশাহীর নারীদের

বাসস
প্রকাশ: ২১ জুন ২০২৫, ১৬:২৭
আয় বাড়ছে রাজশাহীর নারীদের। ছবি : বাসস

মো. আয়নাল হক

রাজশাহী, ২১ জুন, ২০২৫ (বাসস) : ঐতিহ্যবাহী ‘নকশি কাঁথা’ সাম্প্রতিক বছরগুলোতে শহুরে মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তের ঘরে স্থান করে নিয়েছে। 

এক সময় গ্রামের মানুষ নিজেদের ব্যবহারের জন্য পুরনো কাপড় সুইয়ের সাহায্য সেলাই করে নকশি কাঁথা তৈরি করতো। সেটা এখন সমৃদ্ধ কুটির শিল্পে পরিণত হয়েছে। নকশি কাঁথা তৈরির মধ্য দিয়ে নারীদের ক্ষমতায়ন হচ্ছে এবং এটি দেশীয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে আরো সমৃদ্ধ করছে।

দিন দিন নকশি কাঁথার চাহিদা বাড়ছে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ও যথোপযুক্ত সুযোগ-সুবিধা প্রদান করা হলে, এই খাতে নারীদের আরো উন্নতির সম্ভবনা রয়েছে। 

নকশি কাঁথা রাজশাহী অঞ্চলের নারী উদ্যোক্তাদের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।

রাজশাহী অঞ্চলের নারীদের অনেকের আয়ের উল্লেখযোগ্য উৎস নকশি কাঁথা। নকশি কাঁথা তাদেরকে উদ্যোক্তায় রূপান্তরিত হওয়ার সুযোগও দিচ্ছে।

বংশ পরম্পরায় রাজশাহী অঞ্চলের নারীরা নকশি কাঁথা সেলাই করে আসছেন। এটি কেবল কাপড়ের ওপর সুই-সুতার কাজ নয়, এর সঙ্গে মিশে আছে কারিগরের আবেগ ও স্মৃতি। বর্তমানে এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে স্বপ্ন।

বেশ কয়েক বছর ধরে নকশি কাঁথা তৈরির সঙ্গে যুক্ত থাকার পর ৫৪ বছর বয়সী শাহনাজ খাতুনের জীবনে নতুন সম্ভবনার দুয়ার খুলেছে। 

সুই-সুতার মাধ্যমে দীর্ঘ সময় ধরে কাঁথা তৈরির পরিবর্তে কম সময়ে আধুনিক সেলাই প্রযুক্তির সহায়তায় নকশি কাঁথা তৈরি করছেন তিনি। নাটোর জেলার বাগাতিপাড়া উপজেলার যোগিপাড়া গ্রামের শাহনাজ খাতুন ২০১৯ সালে মাত্র ১৭০০ টাকা পুঁজি নিয়ে কাঁথা সেলাইয়ের কাজ শুরু করেছিলেন। 

রাজশাহী শহরের আরডিএ মার্কেটের একটি বুটিক দোকানে মেশিনে সেলাই করা কাঁথা তৈরির প্রক্রিয়া দেখে তিনি অনুপ্রাণিত হন। 

তারপর গ্রামে ফিরে গিয়ে নিজেও মেশিনে কাঁথা সেলাই শুরু করেন শাহনাজ। 

বর্তমানে বাড়িতে বসেই কাঁথা সেলাইয়ের কাজ পান শাহনাজ। এ কাজ করে তিনি মাসে ৭০০০-৮০০০ টাকা আয় করছেন।

শাহনাজ বলেন, ‘একটি কাঁথা ডিজাইন ও সেলাই করতে আমার এক সপ্তাহ সময় লাগে।’ 

তার এই উদ্যোগ ওই এলাকায় অনেক নারীর কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করেছে বলেও জানান তিনি।

শাহনাজের উদ্যোগের মতো নকশি কাঁথা এখানকার অনেক গ্রামীণ দরিদ্র নারীদের জন্য আশীর্বাদস্বরূপ। অনেকেই এখন ঐতিহ্যবাহী কাঁথা বাণিজ্যিকভাবে সেলাই করে দীর্ঘদিনের দারিদ্র্য বিমোচন করে তাদের স্বপ্ন পূরণ করছেন।
রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার কাকনহাটের বাসিন্দা দীনেশ হাসদা ২০১৩ সালে ‘আদিবাসী শান্তা কাঁথা’ নামে একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান চালু করেছেন। 

তিনি বলেন, ‘আমি প্রায় ২৫০ জন নারীকে কাঁথা সেলাইয়ের জন্য নিয়োগ করেছি।’

তিনি আরো বলেন, ‘আমি তাদের কাপড় ও সুতা সরবরাহ করি। আকারের ওপর নির্ভর করে একেকটি কাঁথা সেলাইয়ের জন্য নারীদের ১০০০-১৫০০ টাকা পারিশ্রমিক প্রদান করি।’

প্রতি মাসে দীনেশের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান অন্তত ১ হাজার নকশি কাঁথা তৈরি করে। দীনেশ নিজেই কাপড়ের ওপর কাঁথার ডিজাইন করে কারিগরদের কাছে সেলাইয়ের জন্য পৌঁছে দেন।

দীনেশ হাসদা বলেন, ‘আমাদের তৈরি কাঁথা এখন ঢাকায় অবস্থিত একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা (প্রকৃতি বাংলাদেশ)-এর মাধ্যমে প্রায় ১৫ দেশে রপ্তানি হচ্ছে।’

তিনি বাসস’কে বলেন, ব্যবসার পরিমাণ এখন উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং গড়ে বছরে প্রায় ২৫ লক্ষ টাকা নকশি কাঁথা বিক্রি হচ্ছে, যেখানে তার প্রাথমিক বিনিয়োগ ছিল এক লক্ষ টাকা।

গোদাগাড়ী উপজেলার সোরসোনিপাড়া গ্রামের গৃহিণী ও নকশি কাঁথার কারিগর ৪৮ বছর বয়সী শিউলি বাসকো বলেন, ‘এই এলাকার মানুষ তাদের নকশি কাঁথার দক্ষতার জন্য পরিচিত।’

একই এলাকার ৪৬ বছর বয়সী মনোয়ারা বেগম বলেন, ‘আমাদের সমৃদ্ধ শৈল্পিক ঐতিহ্য থেকে আমরা প্রচুর আয় করতে পারি।’

তিনি আরো বলেন, ‘আমার এলাকার অন্যান্য নারীরা আমাকে নকশি কাঁথা সেলাই করতে অনুপ্রাণিত করেছিলেন।’

তিনি কেবল নিজে সেলাই করেন না, বরং আরও বেশ কয়েকজনের প্রচেষ্টার সমন্বয়ও করেন। 
তিনি বলেন, ‘আমি প্রতি মাসে ৩ হাজার ৮০০ টাকা পর্যন্ত আয় করি।’ 

কাকনহাট এলাকার ৩৫ বছর বয়সী আদিবা খাতুন বলেন, ‘নকশার ওপর নির্ভর করে নকশি কাঁথা তৈরি করতে এক থেকে দুই সপ্তাহ সময় লাগে।’ তিনি প্রায় দশ বছর ধরে এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত।

তিনি আরো বলেন, ‘নকশি কাঁথা তৈরির খরচ কম। তবে এর মূল্য ও সময় সাপেক্ষ সূচিকর্ম এটিকে বিলাসবহুল ও মূল্যবান করে তুলেছে।’

একটি মাঝারি আকারের নকশি কাঁথা তৈরি করতে ২-৩ মাস সময় লাগে এবং এর মূল্য প্রায় ১ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা। 

তিনি আরও বলেন, পুরনো কাপড়ের সহজ লভ্যতার কারণে লাভের পরিমাণ যথেষ্ট।

তাহারিমা বেগম লাকি একজন সফল মহিলা উদ্যোক্তা যিনি ঐতিহ্যবাহী নকশি কাঁথার বাণিজ্যিকীকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। 

তিনি নূর নকশি নামে একটি সংস্থার স্বত্বাধিকারী, যেখানে তারা বিভিন্ন ডিজাইনের নকশি কাঁথা তৈরিতে পুরানো কাপড় ব্যবহার করেন।

এগুলো দেশে ও বিদেশে বিক্রি করা হয়। তাহারিমা এক হাজারেরও বেশি নারীকে এই কাজে নিযুক্ত করে এবং এই উদ্যোগকে সফল করতে সহায়তা করে।

বর্তমানে, প্রায় ২ হাজার ২০০ নারী নূর নকশিতে কাজ করেন। এই নারীদের বেশিরভাগই প্রান্তিক সম্প্রদায়ের।

এই কর্মীরা অর্ডার অনুসারে চূড়ান্ত পণ্য সরবরাহ করার জন্য কাজ করে, যা পরে সারা দেশের শোরুমে সরবরাহ করা হয় এবং এমনকি এগুলো বিদেশেও রপ্তানি করা হয়।

কোম্পানির কর্মীরা চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহর, আমানুরা, শিবগঞ্জ, রানীহাটি, মহিষালবাড়ি, রহনপুর ও গোদাগাড়ীসহ বিভিন্ন স্থানে কর্মরত।

বাসস-এর সঙ্গে আলাপকালে তাহারিমা বলেন, কর্মীদের সুই-সুতো, পোশাক ও ডিজাইন থেকে শুরু করে সব কিছুই দেওয়া হয়। কোম্পানির ২০ জন কমিশনপ্রাপ্ত এজেন্ট এগুলো তাদের কাছে সরবরাহ করে। এরপর নারীরা চাহিদা অনুযায়ী কাজ করে এবং কাজ শেষে তাদের সেই অনুযায়ী বেতন দেওয়া হয়।

তিনি বলেন, এটা নারীদের আর্থিকভাবে স্বাধীন করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।


 

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
সুপ্রিম কোর্ট রিপোর্টার্স ফোরামের সভাপতি মাসউদ, সাধারণ সম্পাদক ডালিম
চতুর্থ বর্ষে বিএনপি মিডিয়া সেল 
১৪, ১৮, ২৪ সালে নির্বাচনে দায়িত্বপ্রাপ্ত কমিশনারদের বিরুদ্ধে মামলা করবে বিএনপি
গল টেস্টে সব ক্ষেত্রেই পারফরমেন্স করেছে দল : শান্ত
রাবি’র সঙ্গে নেপালের ত্রিভুবন বিশ্ববিদ্যালয়ের সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর
নানা আয়োজনে শিল্পকলায় বিশ্ব সংগীত দিবস উদযাপন
গাজীপুরে পলিথিন উৎপাদনের বিরুদ্ধে টাস্কফোর্সের অভিযান : পলিথিন জব্দ, কারাদণ্ড
ফটিকছড়িতে গৃহবধূর ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার
এআই গবেষণায় বিল গেটসের আস্থা অর্জন করেছেন বাংলাদেশের আরিফ
উত্তর ইসরাইলে আবাসিক ভবনে ড্রোন হামলার অভিযোগ
১০