জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম কুমিল্লারই একজন 

বাসস
প্রকাশ: ২৬ আগস্ট ২০২৫, ১৪:১৯
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

দেলোয়ার হোসাইন আকাইদ

কুমিল্লা (দক্ষিণ), ২৬ আগস্ট, ২০২৫ (বাসস) : জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম খুব অল্প সময়ই কুমিল্লায় অবস্থান করেছিলেন। কিন্তু কুমিল্লাবাসীর হৃদয়ে রেখে গেছেন তার অগণন স্মৃতি। তাঁর প্রেম, বিয়ে, সংগ্রাম আর সৃষ্টির শহর কুমিল্লার মানুষের কাছে তিনি কুমিল্লারই মানুষ। তাদেরই একজন। তাইতো কবির রচিত ‘আমি চিরতরে দূরে চলে যাবো, তবু আমারে দেবো না ভুলিতে...গানটি কুমিল্লাবাসীর হৃদয়ে চিরভাস্বর হয়ে আছে। কবি দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করলেও কুমিল্লাবাসী তাঁকে বুকে করে রেখেছে যুগ যুগ ধরে। 

আগামীকাল ১২ ভাদ্র। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের ৪৯তম প্রয়াণ দিবস। এই দিনটিকে সামনে রেখে কথা হয় কুমিল্লার গবেষক, কবি, সাহিত্যিক ও সংস্কৃতিজনের সাথে। কথা হয় স্থানীয় সাধারণ মানুষের সাথেও। তারা জানান কাজী নজরুল ইসলামের প্রতি তাদের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার কথা। কবিকে নিয়ে তাদের একান্ত অনুভবের কথা।  

স্থানীয় বাসিন্দারা মনে করেন, কবি নজরুল ইসলামের জন্ম চুরুলিয়ায় হলেও কুমিল্লার মাটি ও মানুষ তাঁকে দিয়েছে নতুন নতুন সৃষ্টির অনুপ্রেরণা। তাঁর অনেক অমর সৃষ্টি এই কুমিল্লাতেই রচিত হয়েছে। তাঁর প্রেম, বিপ্লব, সংগ্রাম ও সাহিত্যচর্চার গল্প আজও কুমিল্লাবাসীর অন্তরে গেঁথে আছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের দৈনন্দিন জীবনাচারণেও নজরুল কোনো না কোনোভাবে উপস্থিত। তাই নজরুল তাদের কাছে কুমিল্লারই একজন।    

কুমিল্লা শহরের কান্দিরপাড়ের ইন্দ্রকুমার সেনের বাড়ি, ধর্মসাগর পাড়, রাণীর দীঘি, মহেশাঙ্গন, দারোগাবাড়ি, টাউন হল ময়দান, সংগীতজ্ঞ শচীনদেব বর্মনের চর্থার রাজবাড়ি, নবাব বাড়িসহ কুমিল্লার আনাচে-কানাচে কবির বিচরণের অসংখ্য স্মৃতিতে ভরা। তাঁর স্মৃতিবিজড়িত এসব স্থান এখন মানুষের কাছে কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। 

নজরুল গবেষক ড. আলী হোসেন চৌধুরী বাসসের সাথে আলাপকালে বলেন, কবি কাজী নজরুল ইসলামের জীবন ও সাহিত্যকর্মের গুরুত্বপূর্ণ অংশ জুড়ে রয়েছে কুমিল্লা। কুমিল্লায় বিচরণের  মধ্যে দিয়েই নজরুল হয়ে উঠেছিলেন দ্রোহ ও প্রেমের কবি। কবির প্রেম, বিয়ে, সুরকার, গায়ক ও অভিনয়শিল্পী হয়ে ওঠার অনেক ঘটনার সূচনাও কুমিল্লাতেই।

তিনি বলেন, ১৯২১ সালের এপ্রিল থেকে ১৯২৪ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত পাঁচ দফায় প্রায় ১১ মাস নজরুল কুমিল্লায় অবস্থান করেছিলেন। এই এগারো মাসের অবস্থানই কবির জীবনের মোড় ঘোরানো সময়। 

নজরুল বিষয়ক বিভিন্ন গবেষণার উল্লেখ থেকে জানা যায়, ১৯২১ সালের ২১ নভেম্বর প্রিন্স অব ওয়েলসের কলকাতা আগমন উপলক্ষে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস হরতাল ডাকে। ওই হরতালে নজরুল কুমিল্লার রাজগঞ্জে গলায় হারমোনিয়াম ঝুলিয়ে প্রতিবাদী গান গেয়ে মিছিলে অংশ নেন। এই অপরাধে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। গবেষকদের মতে, এ ঘটনাই নজরুলের ‘বিদ্রোহী কবিতার পেছনে গুরুত্বপূর্ণ প্রেক্ষাপট তৈরি করে।

কবির প্রেম ও ব্যক্তিজীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় রচিত হয় কুমিল্লায়। জেলার মুরাদনগরের দৌলতপুরে খাঁ বাড়ির নার্গিস আসার খানম ও শহরের পশ্চিম কান্দিরপাড়ের আশালতা সেন গুপ্তা ওরফে প্রমীলা এই দুই নারী এসেছিলেন নজরুলের জীবনে জীবনসঙ্গিনী হয়ে। নার্গিস ও প্রমীলা কবির জীবনে গভীর প্রভাব বিস্তার করেছিলেন। কুমিল্লায় অবস্থানকালে তিনি অসংখ্য কবিতা ও গান রচনা করেন। 

নজরুলের স্মৃতিকে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে পৌঁছে দেওয়ার জন্য কুমিল্লায় নানা সময়ে নেওয়া হয়েছে বিভিন্ন উদ্যোগ। ১৯৬০ সালে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজে প্রতিষ্ঠিত হয় কবি নজরুল ছাত্রাবাস। ১৯৬২ সালে কান্দিরপাড় থেকে ফরিদা বিদ্যায়তন পর্যন্ত সড়কের নামকরণ করা হয় ‘নজরুল এভিনিউ’। ১৯৭০ সালে কুমিল্লায় গড়ে ওঠে ‘নজরুল ললিতকলা পরিষদ’। যা পরবর্তীতে ‘নজরুল পরিষদ’ নামে পরিচিত হয়।

১৯৮৩ সালে শহরের যেসব স্থানে নজরুল অবস্থান করেছিলেন সেখানে টিনের স্মৃতিফলক স্থাপন করা হয়। ১৯৯২ সালে এসব স্থানে কবির স্মৃতিবিজড়িত ঘটনার বর্ণনা সংবলিত পাকা ফলক স্থাপন করা হয়। কুমিল্লা শিল্পকলা একাডেমির সামনে নির্মিত হয়েছে ‘চেতনায় নজরুল’ স্মৃতিস্তম্ভ। এছাড়া মুরাদনগরের দৌলতপুরে খাঁ-বাড়ির কিছু স্মৃতিচিহ্ন সংরক্ষণ করা হয়েছে। কুমিল্লায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ইনস্টিটিউট।

স্থানীয় সাংস্কৃতিক কর্মীরা মনে করেন, নজরুলের স্মৃতিচিহ্নগুলোর সঠিক সংরক্ষণের জন্য কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা জরুরি। তারা জানান, কবির বেশ কিছু স্মৃতি চিহ্ন বিলীন হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। 

সাংস্কৃতিক কর্মী হোসেন মাহমুদ বাসসকে বলেন, কবি নজরুলের জন্মবার্ষিকী বা মৃত্যুবার্ষিকী এলেই জাঁকজমকপূর্ণ আয়োজন করা হয়। স্মৃতিচিহ্নগুলো সাময়িকভাবে ঝকঝকে করা হয়। কিন্তু বছরের বাকি সময় এগুলো অবহেলায় পড়ে থাকে। আমরা চাই, কবির স্মৃতিচিহ্নগুলো স্থায়ীভাবে সংরক্ষণ করা হোক এবং সারা বছর ধরে পরিচর্যার ব্যবস্থা করা হোক।

আবৃত্তি সংসদ কুমিল্লার সভাপতি সুমনা সুমন বাসসের সাথে আলাপকালে বলেন, বাংলাদেশের মধ্যে কুমিল্লায় নজরুলের সৃষ্টিকর্মের পরিমাণ অনেক বেশি। এখানেই তিনি অসংখ্য গান ও কবিতা রচনা করেছেন। এ কারণে নজরুল চর্চায় স্থানীয় শিক্ষার্থী ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের আগ্রহ দিন দিন বাড়ছে।

জাতীয়তাবাদী সামাজিক সাংস্কৃতিক সংস্থা (জাসাস) কুমিল্লা মহানগর শাখার আহ্বায়ক মুনজুরুল আলম ভূইয়া বলেন, নজরুলের প্রেম, বিয়ে, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, গ্রেফতার, সমাবেশ এবং সাহিত্যচর্চাসহ বহু ঘটনার নীরব সাক্ষী কুমিল্লা। তাই কবি আমাদের হৃদয়ে চির অমর হয়ে আছেন।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
পাঠ্যপুস্তক ক্রয় প্রক্রিয়ার সময়সীমা হ্রাসের প্রস্তাব অনুমোদন দিয়েছে সরকার
নারায়ণগঞ্জে কোকো আন্তর্জাতিক দাবা কাল শুরু
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে বিনামূল্যে চক্ষু শিবিরের উদ্বোধন
নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে সারা দেশে কুইক রেসপন্স টিম কাজ করছে: সমাজকল্যাণ উপদেষ্টা
নেইমার-ভিনিসিয়াসকে ছাড়া ব্রাজিল দল ঘোষণা
দিনাজপুরে পুষ্টি কর্ম পরিকল্পনা বিষয়ক কর্মশালা 
অভিনেত্রী হিমুকে আত্মহত্যায় প্ররোচনা : রাফির বিচার শুরু
ডিজিটাল ব্যাংকের জন্য আবেদনপত্র আহ্বান বাংলাদেশ ব্যাংকের
সুনামগঞ্জে শিশু-কিশোরদের মধ্যে খাদ্য সামগ্রী বিতরণ
নেত্রকোণায় খালে পড়ে শিশুর মৃত্যু
১০