
বিপুল ইসলাম
লালমনিরহাট, ২৭ অক্টোবর, ২০২৫ (বাসস) : প্রকৃতিতে এখনও পুরোপুরি শীতের আমেজ না এলেও লালমনিরহাটে শুরু হয়েছে খেজুর রস সংগ্রহের প্রস্তুতি। জেলার বিভিন্ন এলাকায় গাছিদের ব্যস্ততা এখন তুঙ্গে।
গাছ থেকে রস সংগ্রহ ও গুড় বিক্রি করে প্রায় পাঁচ মাস চলে তাদের সংসার।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, খেজুর রস আহরণের মধ্য দিয়েই গ্রামীণ জনপদে শীতের আগমনী বার্তা ধ্বনিত হয়।
বর্তমানে চলছে গাছ ঝাড়া, পরিষ্কার এবং নল বসানোর কাজ। কয়েকদিন পর শীতের তীব্রতা বাড়লে শুরু হবে খেজুর গাছের বুক চিরে সুস্বাদু রস আহরণের মৌসুম। যেসব এলাকায় বেশি খেজুর গাছ রয়েছে, সেখানে ইতোমধ্যে গাছিদের অস্থায়ী ঘাঁটি স্থাপন করা হয়েছে। রস থেকে গুড় তৈরির জন্য আগেভাগেই সংগ্রহ করা হচ্ছে বিকল্প জ্বালানি।
এ দিকে জেলা কৃষি বিভাগ জানিয়েছে, লালমনিরহাটের বিভিন্ন এলাকায় বিচ্ছিন্নভাবে প্রায় পাঁচ হেক্টর জমিতে খেজুর গাছ রয়েছে। গ্রামের বাড়ির উঠান, রাস্তার ধারে কিংবা ফসলের মাঠের পাশে মাঝেমধ্যেই দু-একটি করে খেজুর গাছ চোখে পড়ে, যা এখনো গ্রামীণ জীবনের ঐতিহ্য বহন করে চলছে।
জেলা সদরের বড়বাড়ী ইউনিয়নের বলিরাম গ্রামের বাসিন্দা বিপ্লব চন্দ্র রায়, রেজাউল করিম ও আমিনুল হোসেন জানান, তাদের বাড়িতে দুই থেকে তিনটি করে খেজুর গাছ রয়েছে। কিন্তু গাছি না থাকায় অধিকাংশ গাছই অব্যবহৃত পড়ে আছে। তাদের দাবি, অভিজ্ঞ গাছিদের সহযোগিতায় তরুণ প্রজন্মকে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে গাছি হিসেবে গড়ে তোলার উদ্যোগ নিলে রস আহরণ ও গুড় উৎপাদনের পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়বে।
এজন্য তারা এ খাতে কার্যকর সরকারি পদক্ষেপের আহ্বান জানান।
তিস্তাপাড়ের অভিজ্ঞ গাছি তরেজামাল উদ্দিন বলেন, লালমনিরহাটসহ কুড়িগ্রামের রাজারহাট ও আশপাশের এলাকায় যেখানে খেজুর গাছ বেশি, মৌসুমে সেখানে যাই। মালিকদের কাছ থেকে মৌসুমের জন্য গাছ কিনে নিই। পরে আমার লোকজন দিয়ে রস সংগ্রহ ও বিক্রি করি।
তিনি আরও বলেন, প্রথমে দা দিয়ে গাছের মাথার সোনালি অংশ কাটা হয়। ৮ থেকে ১০ দিন পর সেখানে নল বসানো হয়। এরপর প্রায় এক সপ্তাহের মধ্যে মিষ্টি রস নামানো শুরু হয়। এখন সেই প্রস্তুতি নিয়েই আমরা ব্যস্ত সময় পার করছি।
তরেজামাল উদ্দিনের মতে, গাছের সংখ্যা কমে যাওয়া এবং তরুণ প্রজন্মের কৃষি কাজে অনাগ্রহের কারণে গাছির সংখ্যা দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। ফলে অনেক গাছই অব্যবহৃত থেকে যাচ্ছে।
একই এলাকার গাছি জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, বর্তমান প্রজন্ম খেজুর রস সংগ্রহের কৌশল শিখতে চায় না।
তারা সবাই শহরমুখী, পড়াশোনা ও চাকরিতে ব্যস্ত। সরকার যদি প্রশিক্ষণ ও প্রণোদনা দিত, তাহলে নতুন গাছি তৈরি হতো এবং গ্রামীণ অর্থনীতি আরও শক্তিশালী হয়ে উঠত।
আরেক গাছি রমজান আলী বলেন, আমি সহ তিনজন মিলে এবারের মৌসুমে ২০০-র বেশি গাছ কাটতে পারব। এলাকায় গাছি কম থাকায় অনেকে বাইরের জেলা থেকে লোক এনে কাজ করাচ্ছেন। গাছির সংখ্যা বাড়লে রস ও গুড় উৎপাদন করে আরও লাভবান হওয়া যেত।
লালমনিরহাট জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক ড. মো. সাইখুল আরিফিন বলেন, প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষায় খেজুর গাছের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
খেজুরের রস ও গুড় আমাদের গ্রামীণ ঐতিহ্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
তিনি আরও বলেন, বর্তমানে লালমনিরহাটে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক খেজুর গাছ চোখে পড়ে না। তবে এখন যে গাছগুলো রয়েছে, সেগুলোর যথাযথ পরিচর্যা ও নতুন করে বীজ বপনের উদ্যোগ নেওয়া হলে রস আহরণ ও গুড় উৎপাদনের পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়ানো সম্ভব। এই লক্ষ্যে আগামীতে আমরা তাল গাছের পাশাপাশি খেজুর গাছের বিষয়টিকেও গুরুত্ব দিয়ে দেখব।