
জীতেন বড়ুয়া
খাগড়াছড়ি, ৭ নভেম্বর ২০২৫ (বাসস) : আজকের গুণী শিক্ষক রুপা মল্লিক তো কেবল এক, দুই বা পাঁচ বছরের পরিশ্রমে এই সাফল্য অর্জন করেননি। তার জীবনের প্রতিটি চলার মুহূর্ত ছিল পরিশ্রম, সততা আর ভালোবাসায় পূর্ণ।
তিনি নিজে পরিশ্রম করে যা অর্জন করেছেন তাকে সততার সাথে কাজে লাগিয়েছেন। আর মানুষকে ভালোবেসে সেই সাফল্যের ভাগ দিয়েছেন ছাত্র ও সহকর্মীদের। তিনি অনেক সম্মাননা অর্জন করেছেন। কিন্তু অন্যের মর্যাদাকে তিনি ছোট করে দেখেননি কখনও। আর তারই পুরস্কার অর্জন করে চলেছেন জীবন ভর।
রুপা মল্লিক খাগড়াছড়ি টি অ্যান্ড টি গেইট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক। পাহাড়ের মতো দৃঢ়, নদীর মতো শান্ত, আর আলোর মতো উদ্ভাসিত এক গল্পে গাথা তার পেশা জীবন। শিক্ষকতা তার কাছে শুধু একটি পেশা নয়, এটি এক অবিরাম যাত্রার নাম। শ্রম আর ভালোবাসায় বোনা এক অনন্য পথচলা।
তিনি ২০২৪ ও ২০২৫ সালে খাগড়াছড়ি সদর উপজেলায় ‘গুণী শিক্ষক’ উপাধি পেয়েছেন। এই অর্জন তার দীর্ঘদিনের পরিশ্রম, সততা এবং শিক্ষার প্রতি ভালোবাসারই প্রতিদান।
বাসসের সাথে আলাপকালে রুপা মল্লিক বলেন, শিক্ষকতা মানে দায়িত্ব, ভালোবাসা আর আত্মত্যাগের এক অদৃশ্য বন্ধন। আমার ডিপার্টমেন্ট আমাকে মূল্যায়িত করেছে। শিক্ষক বাতায়ন আমাকে দিয়েছে প্রেরণা। আর আমার পরিবার দিয়েছে শক্তি। সহকর্মীরা দিয়েছেন সাহস। আমি কৃতজ্ঞ প্রতিটি মানুষ ও প্রতিটি শিক্ষার্থীর কাছে। তারা সবাই আমার কাজের অনুপ্রেরণা হয়ে সবসময় পাশে থেকেছে।’
টি অ্যান্ড টি গেইট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বলেন, রুপা ম্যাডাম আমাদের কাছে শুধু একজন শিক্ষক নন। তিনি আমাদের মায়ের অভাব পূরণ করেন। বন্ধু হয়ে পাশে থাকেন। আর জীবন চলার প্রেরণা দেন।
জীবনের চাকরি অনুসন্ধানের প্রথম পরীক্ষায় সফলভাবে উত্তীর্ণ হয়ে ২০১১ সালের ২৮ জুন তিনি যোগ দেন খাগড়াছড়ি সদর উপজেলার কমলছড়ি মুখ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। সেদিনের সেই তরুণী শিক্ষক জানতেন না যে, সামনে তার জন্য অপেক্ষা করছে এক আলোকময় পথচলা। দীর্ঘ ৮ বছর সেখানে সফলতার সাথে চাকরি করে পরবর্তীতে বদলি হয়ে আসেন জেলা সদরের টি অ্যান্ড টি গেইট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। বর্তমানে তিনি এই বিদ্যালয়ে কর্মরত আছেন।
২০১৯ সালে তিনি অংশ নেন আইসিটি ইন এডুকেশন প্রশিক্ষণে, যা তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। এখানেই পরিচয় ঘটে শিক্ষক বাতায়ন নামের এক বিশাল ডিজিটাল মঞ্চের সাথে। শিক্ষক বাতায়নের সাথে যুক্ত হয়ে তার সামনে খুলে যায় আলোর এক নতুন দিগন্ত। শিক্ষক বাতায়ন হলো বাংলাদেশ সরকারের এটুআই কর্মসূচির একটি ওয়েব পোর্টাল। শিক্ষকদের দক্ষতা বৃদ্ধি ও শিক্ষার মানোন্নয়নে নির্মিত এই ওয়েব পোর্টালের মাধ্যমে ঘরে বসেই যে-কোনো জায়গার শিক্ষার্থীদের পাঠদান করা যায়। আবার এই পোর্টালে শিক্ষাবিষয়ক কনটেন্ট শেয়ার করেও শিক্ষার্থীদের শিক্ষার মান সমৃদ্ধ করা যায়।
সরকারের আইসিটি বিভাগের শিক্ষা বিষয়ক এই বাতায়নই হয়ে ওঠে তার প্রেরণার উৎস। রুপা মল্লিক তখন দেখতে পান, দেশের নানা প্রান্তের অসংখ্য মেধাবী শিক্ষক কনটেন্ট তৈরি করে ছড়িয়ে দিচ্ছেন শিক্ষার আলো। তাদের দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি নিজেও এই ডিজিটাল যাত্রায় অংশ নেন। সারাদিনের কর্মব্যস্ততা শেষে গভীর রাতে কনটেন্ট তৈরি, ভিডিও সম্পাদনা আর আপলোড করতে থাকেন। সেই পরিশ্রমই একদিন তাকে পৌঁছে দেয় সাফল্যের চূড়ায়।
২০১৯ সালে তিনি শিক্ষক বাতায়নের সেরা কনটেন্ট নির্মাতার স্বীকৃতি অর্জন করেন। পরপর দুইবার ‘সেরা কনটেন্ট নির্মাতা’ হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার পরই অর্জন করেন উপজেলার ‘শ্রেষ্ঠ শিক্ষক’ এর মুকুট।
২০২০ সালে সারা বিশ্বে যখন স্থবির, শিক্ষার্থীরা ঘরে বন্দি, ঠিক তখনই তিনি হয়ে ওঠেন শিক্ষার্থীদের জন্য এক আলোকবর্তিকা। এক বছরে ৫০০ এর বেশি অনলাইন ক্লাস তৈরি করেন তিনি। যার মধ্যে প্রায় ৩০০টি কনটেন্ট ছিল তার নিজস্ব সৃষ্টি। এসব কনটেন্ট তিনি নিজের বিদ্যালয় ছাড়াও জেলার বিভিন্ন শিক্ষককেও পেনড্রাইভে সরবরাহ করেছেন নিঃস্বার্থভাবে। একই বছর এটুআই-এর শিক্ষক বাতায়ন তাকে জেলা অ্যাম্বাসেডর শিক্ষক হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। সেই স্বীকৃতি শুধু তার কাজ নয়, বরং তার অদম্য নিষ্ঠা ও ভালোবাসারও প্রতিফলন।
২০২২ সালে রুপা মল্লিক খাগড়াছড়ি জেলার শ্রেষ্ঠ সহকারী শিক্ষক হিসেবে স্বীকৃতি পান। একইসাথে অর্জন করেন শিক্ষক বাতায়নের ‘সেরা উদ্ভাবক সম্মাননা’। এ বছর তিনি দেশের অসংখ্য মেধাবী শিক্ষকের সঙ্গে কন্টেস্টে জয়ী হয়ে খাগড়াছড়ি জেলার একমাত্র শিক্ষক হিসেবে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর, ইউনিসেফ, এটুআই ও বিশ্বব্যাংকের অধীনে পরিচালিত ‘বাংলাদেশ কোভিড ১৯ স্কুল সেক্টর রেসপন্স (সিএসএস আর)’ প্রকল্পে কাজ করার সুযোগ পান।
এই প্রকল্পে কাজ করার সময় তিনি তৈরি করেন টেলিভিশন ও বেতারে প্রচারের জন্য বিভিন্ন শ্রেণি পাঠ। যার অসংখ্য স্ক্রিপ্ট পরবর্তীতে ভিডিও শ্যুটিং ও বাংলাদেশ বেতারে রেকর্ড করা হয়। এরপর তার বেশ কিছু ভিডিও ক্লাস প্রচারিত হয় সংসদ, বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বাংলাদেশ বেতারে। তার এসব কর্মকাণ্ড দেশের হাজারো শিক্ষার্থী ও অভিভাবকের কাছে তাকে পরিচিত করে তোলে।
তিনি কেবল একজন ভালো শিক্ষকই নন। একজন লেখকও। ২০২২ সালে প্রকাশিত হয় তার প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘অব্যক্ত আলাপন’ এবং 'সূবর্ণ বিজয় কাব্য' নামে একটি কবিতার সংকলন।
২০২৩ সালে শিক্ষক বাতায়ন তার জীবনের এই অনন্য যাত্রাকে স্বীকৃতি দেয় ‘সফলতার গল্প’ হিসেবে। এবছরই তিনি তৃতীয়বারের মতো উপজেলার শ্রেষ্ঠ শিক্ষক নির্বাচিত হন।
দুই সন্তানের জননী, রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর মেধাবী ও বিনয়ী এই শিক্ষক পরিবার-বিদ্যালয় সব সামলিয়ে- আজও নিরলসভাবে কাজ করে চলেছেন শিশুদের জন্য। প্রাথমিক শিক্ষার আলো ছড়াচ্ছেন পাহাড়ি জনপদে। পাহাড়ের ছোট ছোট মুখে হাসি ফোটানোই যেন তার জীবনের সবচেয়ে বড় আনন্দ।