
রুমানা জামান
ঢাকা, ৬ নভেম্বর, ২০২৫ (বাসস) : ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর। কাকডাকা ভোর থেকেই সারাদেশের শহরে-বন্দরে, গ্রামে-গঞ্জের পথ ঘাটে নেমে এলো হাজারো মানুষ। রেডিওতে ফের শোনা গেল শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের কণ্ঠস্বর, ‘আমি জিয়া বলছি।’ ফিরে এলো ২৬ মার্চের স্মৃতি। জনগণ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। বুকের ওপর থেকে সরে গেল জগদ্দল পাথর। পথে পথে শুরু হল বিপ্লব আর বিজয় উল্লাসের মিছিল।
জনতার করতালিতে মুখরিত চারপাশ। বুকে বুক মিশিয়ে সিপাহী- জনতার আলিঙ্গন। কাঁধে কাঁধ - হাতে হাত, এক কণ্ঠে এক আওয়াজ- ‘সিপাহী-জনতা ভাই ভাই; জওয়ান জওয়ান ভাই ভাই; বাংলাদেশ জিন্দাবাদ; মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান জিন্দাবাদ; হাতের সঙ্গে হাত মেলাও- সিপাহী-জনতা এক হও।’ এত আনন্দ, এত উল্লাস- সিপাহী ও জনতার হৃদয়ের সঙ্গে হৃদয়ের কোরাস- এ এক অনবদ্য ইতিহাস।
আজ শুক্রবার সেই ঐতিহাসিক ৭ নভেম্বর। বাংলাদেশের ইতিহাসের মোড় ঘোরানো দিন। সিপাহী- জনতার বিপ্লবের দিন। এই বিপ্লবের মাধ্যমে চরম বিশৃঙ্খল ও অনিশ্চিত এক দুঃখজনক অবস্থা থেকে ধীরে ধীরে নতুন পথে যাত্রা শুরু করেছিল বাংলাদেশ। ১৯৭৫ সালের এই দিনে এই অঞ্চলের ভূ-রাজনৈতিক আধিপত্যবাদী, সম্প্রসারণবাদী ও নয়া উপনিবেশবাদী সব ষড়যন্ত্রের জাল ছিঁড়ে বেরিয়ে এসেছিলেন বাংলাদেশের তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল জিয়াউর রহমান। জাতির বিশাল সংকটের মুহূর্তে দেশপ্রেমিক বিপ্লবী সিপাহী-জনতা চক্রান্তকারীদের হটিয়ে দিয়ে, গণ-অভ্যুত্থান ঘটিয়ে জেনারেল জিয়াকে দায়িত্বে বসিয়েছিল এই দিনে।
১৯৭৫- এর ৭ নভেম্বরের পরে শুরু হয় আত্মমর্যাদাশীল স্বকীয় ‘বাংলাদেশী সংস্কৃতির বিকাশ ও স্বাধীন বাংলাদেশী জাতিসত্তা’র নতুন যাত্রা। উদিত হয় নতুন আশার নতুন সূর্য। আর এই নতুন সূর্যোদয়ের নতুন নায়ক ইতিহাসের বরপুত্র শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। পরে জিয়াউর রহমানের স্মৃতি মুছে ফেলতে চলেছে নানা ষড়যন্ত্র। ষড়যন্ত্রের জাল ছিঁড়ে জিয়াউর রহমান জায়গা করে নিয়েছিলেন সাধারণের অন্তরে।
১৯৭৫ এর ৭ নভেম্বরের ঘটনা প্রবাহের সাক্ষী জিয়াউর রহমানের সেই সময়ের সহকর্মী, এলডিপি চেয়ারম্যান, কর্নেল (অব.) অলি আহমেদ, বীর বিক্রম। বাসসের সঙ্গে ৭ নভেম্বরের ঘটনা প্রবাহের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ রাতে তৎকালীন মেজর জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে আর্মি সর্বপ্রথম পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল। ওইদিন রাত্রে তিনি সবাইকে একত্রিত করে বললেন, অতঃপর আমরা সবাই মুক্তি সংগ্রমে ঝাঁপিয়ে পড়লাম। অন্যদিকে, শেখ মুজিব পাকিস্তানিদের কাছে আত্মসমর্পণ করলেন। যুদ্ধ চলাকলে তিনি তো বাংলাদেশে আসেননি। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করলো দেশের সাধারণ জনতা। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি লন্ডন হয়ে দিল্লি গেলেন। এরপর দিল্লি থেকে দেশে ফিরলেন। দেশে ফিরে তিনি সশস্ত্র বাহিনীর ওপর ভরসা না রেখে গড়ে তুললেন রক্ষীবাহিনী। জনগণকে দমনে গঠন করেন মুজিব বাহিনী। ফলে ক্রমেই সেনাবাহিনীতে তার প্রতি ক্ষোভ তৈরি হতে থাকে।’
তিনি বলেন, ‘এই প্রেক্ষাপটে ১৫ আগস্ট একদল সেনা অফিসার তাকে হত্যা করে। তার এই মৃত্যুর পিছনে অন্যতম কারণ ছিল, তিনি ওয়াদা থেকে সরে গিয়েছিলেন। গড়ে তুলেছিলেন একদলীয় বাকশাল শাসন।
তাকে যারা হত্যা করলেন সেই সেনা অফিসাররা তার ঘনিষ্ঠ সহচর খন্দকার মোশতাককে নতুন রাষ্ট্রপতি করলেন। ওই অফিসারদের বিরুদ্ধে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ ক্যু করলেন। নিজেকে মেজর জেনারেল ঘোষণা করে নিজেই সেনাপ্রধান হয়ে গেলেন। গৃহবন্দি করা হলো তৎকালীন সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে। কিন্তু খালেদের এই অভ্যুত্থান সাধারণ সেনা সদস্যরা মেনে নেননি। ফলে আরেকটি পল্টা ক্যু সংগঠিত হলো। এই ক্যু’তে যারা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তারা জিয়াউর রহমানকে পুনরায় তার সম্মান ফিরিয়ে দিয়ে তাকে সেনা প্রধান হওয়ার প্রস্তাব দিল। ওই পরিস্থিতিতে তিনি আবারো সেনা প্রধানের দায়িত্ব গ্রহণ করলেন।’
তিনি বলেন, ৭ নভেম্বরের অভ্যুত্থানটা হয়েছিল আওয়ামী লীগের হাত থেকে দেশকে মুক্ত করার জন্য।
তৎকালীন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল খালেদ মোশারফ আওয়ামী লীগের স্বার্থে ও বিদেশী শক্তির সহায়তায় ৩ নভেম্বর ক্যু করেছিলেন। আর্মিতে তখন শৃঙ্খলা খুবই ভালো ছিল। জিয়াউর রহমান অত্যন্ত যোগ্য ব্যক্তি ছিলেন। তিনি দক্ষ সেনা কর্মকর্তা ছিলেন। তিনি শেখ মুজিবের সময় উপ-সেনাপ্রধান হয়েছিলেন। মূলত তারই সেনাবাহিনী প্রধান হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমান সিনিয়রিটি ব্রেক করে শফিউল্লাহ সাহেবকে সেনাপ্রধান বানালেন। ১৫ আগস্টের পর সেনাবাহিনীতে সবকিছুই ঠিকঠাকই চলছিল। কিন্তু খালেদ মোশারফ আওয়ামী লীগকে ফিরিয়ে আনার জন্য ৩ তারিখ ক্যু করেছিলেন। ক্যুর পরে খালেদের মা ও তার ভাই ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে আওয়ামী লীগের পক্ষে মিছিলও করেছিল। খালেদ মোশাররফ দায়িত্ব নেওয়ার পরে ওই তিন দিন আর্মিতে কোনো শান্তিশৃঙ্খলা ছিল না। বিশৃঙ্খল অবস্থার জন্য তাকে মৃত্যৃবরণ করতে হয়েছে।
বরং শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার জন্য ৭ নভেম্বর সিপাহী জনতা আরেকটি অভ্যুত্থান সংগঠিত করেছিল।
সৈনিকদের মাঝে জিয়াউর রহমানের জনপ্রিয়তা ছিল তুঙ্গে উল্লেখ করে অলি আহমেদ বলেন, ‘জিয়াউর রহমান ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন। তিনি ছিলেন বাংলাদেশের প্রথম অফিসিয়ালি অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি। জাতির দুর্দিনে তিনি দিকনির্দেশনা দিয়েছিলেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর যখন আমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো, বহু লোক নিহত হলো। সমগ্র জাতি তখন হতাশাজনক অবস্থায় ছিল। ওই সময় তৎকালীন মেজর জিয়ার স্বাধীনতার ঘোষণার মাধ্যমে সমগ্র জাতি আবার একত্রিত হলো। তারা একটি দিক নির্দেশনা পেল। ফলে বাঙালি সেনাদের সঙ্গে যোগ দিল সাধারণ জনগণ। তিনি ছিলেন সম্মুখসারির যোদ্ধা। ফলে সেনাবাহিনীসহ সারাদেশের মানুষের কাছে তার একটা জনপ্রিয়তা ছিল।
জিয়াউর রহমান রাজনীতি করতে চাননি জানিয়ে তিনি বলেন, ‘জিয়ার নেতৃত্বে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী পাঁচ ব্রিগেড থেকে পাঁচ ডিভিশনে উন্নিত হয়। সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীকে নতুনভাবে সাজিয়েছিলেন তিনি।
দেশের কৃষি বিপ্লব, শিল্প বিপ্লব, খাল খনন এবং দেশের আইন-শৃঙ্খলা ফিরে আনার জন্য তার একটি বিরাট ভূমিকা ছিল। তিনি ধীরে-ধীরে রাষ্ট্র পরিচালনার মাধ্যমে সরাসরি রাজনীতির সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়েছিলেন।
ওই জায়গা থেকে সামরিক বাহিনীতে ফিরে আসা সম্ভব ছিল না। একমাত্র পথ ছিল সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়া, পিছনের দিকে ফিরে আসা নয়।
১৯৭৫ এর ৭ নভেম্বরের আরেক প্রত্যক্ষদর্শী বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমদ। সেই সময়কার স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, ‘১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বরের ঘটনার সঙ্গে ১৫ আগস্ট এবং ৩ নভেম্বরের ঘটনার যোগসূত্র রয়েছে। ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের পর পরই এ ঘটনার সঙ্গে জড়িতরা বঙ্গভবনে অবস্থান নিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনার চেষ্টা করেন। সেনাবাহিনীর চেইন অব কমান্ডকে বাইপাস করে পরবর্তীকালে জেনারেল জিয়াউর রহমানের কাছে তারা কতগুলো চিরকুট ধরিয়ে দেয়। তার ওপর চাপ সৃষ্টি করে। সমস্ত চেইন অব কমান্ড ভঙ্গ করে সেনাবাহিনীকে তারা পরিচালনা করতে চায়। এই চেইন অব কমান্ডে ভঙ্গ করার কারণে সেনাবাহিনীর বেশির ভাগ অফিসাররা নাখোশ হন। ফলে সেনা বাহিনীর মধ্যে দুটি অংশে ভাগ হয়ে যায়। একাংশ ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডে অংশগ্রহণকারী ও তাদের সহযোগীরা। অপর অংশ বাহিনীর চেইন অব কমান্ডের প্রতি যারা অনুগত। এদের মধ্যে যখন রেশারেশি তুঙ্গে ওঠে তখন এই পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে সেনা বাহিনীর চীফ অফ খালেদ মোশাররফ ৩ নভেম্বরে একটি অভ্যূত্থান ঘটান।’
মেজর হাফিজ বলেন, ‘১৫ আগস্ট এবং ৩ নভেম্বরের ঘটনাকালীন সময়ে আমি ঢাকা সেনা নিবাসে বিগ্রেড মেজর রূপে কর্মরত ছিলাম। সেখানে ডেস্ক অফিসারের দায়িত্ব পালনকালে এসব ঘটনাবলী লক্ষ্য করেছি।
তিনি বলেন, খালেদ মোশাররফ কর্নেল সাফায়ত জামিলের সহায়তায় অভ্যুত্থানের আগে জেনারেল জিয়াউর রহমানকে গৃহবন্দী করেন। এই ঘটনা সেনাবাহিনীর সদস্যরা ভালোভাবে গ্রহণ করেননি। কারণ, জিয়াউর রহমান ছিলেন স্বাধীনতার ঘোষক এবং সেনাবাহিনীর একজন জনপ্রিয় ও দক্ষ অফিসার। এই পেক্ষোপটে মঞ্চে প্রবেশ করেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল আবু তাহের নামের একজন অবসর প্রাপ্ত কর্মকর্তা। তিনি জাসদের সহ সভাপতি হিসেবে ৩ বছর আগে অবসর গ্রহণ করেন। কর্নেল তাহের এবং মেজর জলিল জাসদের নেতৃবৃন্দ মিলে সেনাবাহিনীর মধ্যে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা নামে একটি ইউনিট গঠন করে। যার লক্ষ্য ছিলো সিপাহীদের দিয়ে অভ্যুত্থান ঘটিয়ে রাষ্ট্র ক্ষমতা কুক্ষিগত করা।
মেজর হাফিজের ভাষ্যমতে, ৭ নভেম্বরের আগে কর্নেল তাহেরের মনোভাব এমনই ছিলো যে, ১৫ আগস্টে তার সৈনিক সংস্থা কিছুই করতে পারেনি। ৩ নভেম্বর ব্রিগেডিয়ার জেনারেল খালেদ মোশাররফ সেনাবাহিনীতে একটি অভ্যুত্থান করে খন্দকার মোশতাককে সারিয়ে বিচারপতি সায়েমকে রাষ্ট্রপতি পদে নিয়োগ দেয়। কর্নেল তাহের দেখলেন যে উদ্দেশ্যে নিয়ে ১৯৭৪ সালে থেকে তিনি বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা পরিচালনা করছেন, সেই সংস্থা তো তার কোনো কাজে লাগছে না। তারও রাষ্ট্র ক্ষমতায় যাওয়ার খায়েশ ছিলো; তখন তিনি সংস্থার সিপাহীদের ব্যবহার করে খালেদ মোশাররফের অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে একটি লিফলেট ছড়ান এবং সৈনিকদের ভুল বোঝান যে, ৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থান ছিলো ভারতের পক্ষে অথাৎ আওয়ামীলীগের পক্ষে একটি অভ্যুত্থান।
অন্যদিকে লিফলেট ছড়িয়ে দেয়ার ফলে সারা দেশের প্রত্যেকটি ক্যান্টনমেন্টে সামিরক বাহিনীর সদস্যরা অনেক বেশি উত্তেজিত ছিলো। পরিস্থিতি এতোটাই ভয়াবহ পর্যায়ে চলে যাচ্ছিলো যে, অবস্থা বেগতিক আঁচ করতে পেরে ৩ নভেম্বরের প্রথম প্রহরেই ১৫ আগস্টের অভ্যুত্থানের সঙ্গে জড়িতরা পরাজয় স্বীকার করে আত্মসমর্পণ করেন। এবং তারা দাবি তোলেন- তাদেরকে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দিতে হবে। পরে খালেদ মোশাররফ সন্ধ্যার পরে তাদেরকে একটি বিমানে করে ব্যাংকক পাঠিয়ে দেন। কর্নেল রশিদ এবং কর্নেল ফারুক যাওয়ার পরে টু ফিল্ড রেজিমেন্ট এবং আর্মড কোরের সৈনিকেরা অসহায় বোধ করেন। কারন তাদের নেতারা দেশ ছেড়ে চলে গিয়েছেন। তারাও দ্রুত একটি অভ্যুত্থান করে আগের অবস্থানে ফিরে গিয়ে নিজেদেরকে রক্ষা করার জন্য উদগ্রীব হয়ে পড়েন।
এই পেক্ষাপটেই আসে ৭ নভেম্বর। কর্নেল তাহেরের যে সৈনিক সংস্থা তারা সেনাবাহিনীর যুদ্ধ ইউনিটের কেউ ছিলো না। তারা ছিলেন, যুদ্ধের সময়ে পেছনের সারির সৈনিক। কিন্তু জিয়াউর রহমান বন্দী থাকার সুযোগে তারা ৭ নভেম্বর রাতের প্রথম প্রহরে বিদ্রোহ করে এবং কর্নেল রশিদের সৈনিকেরা গিয়ে জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করে টু ফিল্ড রেজিমেন্টে নিয়ে আসেন। সেখানে বসেই জিয়াউর রহমান সেনাবাহিনীর দায়িত্বভার পুনরায় গ্রহণ করেন। সেনাপ্রধান রূপে সেনাবাহিনীতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার জন্য আত্ন-নিয়োগ করেন।
মেজর হাফিজ বলেন, ‘৭ নভেম্বর খুব ভোরে কর্নেল তাহের এসে জিয়াকে বলেন, জাসদের কর্মীরা অপেক্ষা করছে আপনি শহীদ মিনারে আসেন এবং একটি ভাষণ দেন। জিয়াউর রহমান তাকে বললেন, ‘আমি সেনাপ্রধান, রাজনীতি করবো না। সুতারাং আমার পক্ষে কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে গিয়ে যোগ দেয়া সম্ভব নয়।’ ‘এতে কর্নেল তাহের অত্যন্ত ক্ষুদ্ধ হয়ে ক্যান্টনমেন্ট থেকে ফিরে যান। তবে ক্যান্টনমেন্টে কোনো একটা ইউনিটে অবস্থান নিয়ে তিনি যে জিয়াউর রহমানের বিরোধিতা করবেন, সে ধরনের শক্তিমত্তাও তার ছিলোনা। এ কারণে তিনি ক্যান্টনমেন্ট থেকে বের হয়ে এস এম হলের হাউস টিউটরের বাসায় যান, সেখানে ষড়যন্ত্র করেন কিভাবে জিয়াকে উৎঘাত করা যায়। ৭ নভেম্বর প্রথম প্রহরে সিপাহীরা বিদ্রোহ করে ১২ দফা দাবি দেন। এ দাবির মধ্যে অন্যতম ছিল- অফিসার কোর হতে হলে সিপাহীদের মধ্যে থেকেই হতে হবে বাইরে থেকে নেয়া যাবে না। এ বিদ্রোহের জের ধরে ১৩ জন নিরীহ অফিসার যারা কোনো ধরেনর অভ্যুত্থানে জড়িত না তাদেরকে দুজন লেডি ডাক্তার সহ হত্যা করা হয়। এমন পরিস্থিতিতে জিয়াউর রহমান মনে করেন, এই বিদ্রোহ সেনাবাহিনীকেই সামলাতে হবে, চেইন অব কমান্ড রিস্টোর করতে হবে। সেজন্য তিনি কর্নেল তাহের এবং তার সহযোগীদের গ্রেফতার করে বিচারের মাধ্যমে শাস্তি দেন।’
১৯৭৫ এর ৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থানের পর দেশের পরিস্থিতি যখন জটিল হয়ে উঠে, তখন ৭ নভেম্বর অবধারিত হয়ে পড়ে। পরবর্তীতে সিপাহী বিপ্লবের চরম অস্থিরতা আর অনিশ্চয়তার মধ্যে জিয়াউর রহমান শক্ত হাতে হাল ধরে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন বলে মনে করেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বরের পেক্ষাপটে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান কতটা প্রাসঙ্গিক এ বিষয়ে বাসসকে তিনি বলেন, দেখুন যখন আপনি পিচফুল ট্রান্সফার অব পাওয়ার দেবেন না, একটা শান্তিপূর্ণ উপায়ে ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন না; যখনই জানালা দরজা বন্ধ করে দেবেন তখনতো আরেকটা জানালা খুলবেই।
১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বরে জিয়াউর রহমানকে হাউজ এরেস্ট করে রেখে দেয়া হয়। দেশপ্রেমিক কিছু সেনা সদস্য ৭ নভেম্বর ক্যু করে জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করে। এর মাধ্যমে দেশে বহুদলীয় শাসনব্যাবস্থা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পথ সুগম হয়। সেই হিসেবে ৭ নভেম্বর একটা টানিং পয়েন্ট। এ টানিং পয়েন্টটা ছিলো টু‘ওয়ার্ড ইন্ডিটেন্ডেন্ট এন্ড সোভরেন্টে অব বাংলাদেশ।
বিএনপির মহাসচিব বলেন, ‘৭ নভেম্বর জিয়াউর রহমানের সমর্থনে সামরিক বাহিনীর সদস্যদের পাশাপাশি রাজপথে নেমে আসেন সাধারণ মানুষ। শুধু স্বাধীনতার ঘোষণাই নয় স্বাধীনতাযুদ্ধের শুরুতে জিয়াউর রহমান বিদ্রোহ করে রণাঙ্গনে লড়াই করেন মুক্তিযুদ্ধে। ভাগ্য সাহসীদের সঙ্গে থাকে। ১৯৭৫-এর নভেম্বরে তার বন্দীদশা থেকে মুক্তি রাষ্ট্রক্ষমতার চূড়ান্ত ধাপে এগিয়ে দেয়।’
১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর ছিল বাংলাদেশের জন্য ‘টার্নিং পয়েন্ট’ উল্লেখ করে বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা গণতন্ত্রকে ফিরিয়ে আনতেই ৭ নভেম্বর তাৎপর্যপূর্ণ। এ দিনটি মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে।
৭ নভেম্বরের ঘটনার কিছু স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে ১৫ আগস্ট থেকে ৭ নভেম্বরের মধ্যে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে। ৩ নভেম্বর ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে একটি সামরিক অভ্যুত্থান হয়। এতে খন্দকার মোশতাক সরকারের পতন ঘটে। মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে বন্দি করা হয়। পাঁচ দিনের মাথায় আরেকটি সামরিক অভ্যুত্থান ঘটে। যাকে দেশবাসী সিপাই-জনতার অভ্যুত্থান হিসেবে গ্রহণ করে। এই অভ্যুত্থানের পর শহীদ জিয়া জাতির উদ্দেশ্যে ঐতিহাসিক ভাষণ দেন।
দেশবাসীকে তিনি শান্ত থাকতে বলেন এবং বাংলাদেশকে রক্ষার আহ্বান জানান। পরে সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে রাষ্ট্রপতি তাকে নিয়োগ দেন। এর মাধ্যমে দেশ একদলীয় শাসনব্যবস্থা থেকে পুনর্বার বহুদলীয় শাসনব্যবস্থায় ফিরে আসে।’
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, ৭ নভেম্বরের পটপরিবর্তনের পর প্রেসিডেন্ট জিয়ার নেতৃত্বে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব শক্তিশালী সত্তা হিসেবে রূপ লাভ করে। গণতন্ত্র অর্গলমুক্ত হয়ে অগ্রগতির পথে এগিয়ে যায়। মানুষের মনে স্বস্তি ফিরে আসে।
প্রতি বছর ৭ নভেম্বর এলেই জিয়াউর রহমানকে হৃদয়ের গভীর থেকে অনুভব করেন জানিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. মাহবুব উল্লাহ বলেন, ‘৩ নভেম্বর ১৯৭৫ ব্রিগেডিয়ার খালেদ মাশাররফের নেতৃত্বে সেনা অভ্যুত্থান হলে জিয়াউর রহমান নিজ বাসগৃহে বন্দি হন। তাকে বন্দি করা হয়েছে শুনে মানুষজন খুব উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিল। সাধারণ মানুষ জাতির এই মহান সন্তানকে কোনোক্রমেই হারাতে চাইছিল না। পরে যখন ঐতিহাসিক ৭ নভেম্বরের সিপাহী-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে শহীদ জিয়া মুক্ত হলেন। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ওপর যে কালো ছায়া নেমে এসেছিল, তা বিদূরিত হলো। জিয়াউর রহমান কার্যত রাষ্ট্রের কর্ণধারে পরিণত হলেন।’
এই রাজনৈতিক বিশ্লেষকের ভাষ্য- ‘১৯৭৫-এর ৭ নভেম্বরের পর থেকে জাতি এই দিবসটি পালন করে আসছে জাতীয় স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় শপথ গ্রহণ এবং সামরিক বাহিনী ও জনগণের ঐক্যের প্রতীক হিসেবে।
দিবসটিকে দলীয় রাজনীতির বিবেচনা থেকে দেখার কোনো সুযোগ নেই। যে দিবস স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব সুদৃঢ়করণের প্রতীকস্বরূপ জাতীয় জীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত এবং সৈনিক-জনতার ঐক্য ও সংহতির পরিচয় বহন করে।’