
ভুবন রায় নিখিল
নীলফামারী, ২২ নভেম্বর, ২০২৫ (বাসস) : এক টাকায় চা আর এক টাকায় তেলে ভাজা পেঁয়াজু বিক্রি করছেন নীলফামারীর আপন আহমেদ (৪৫)। তার দোকানের নাম ‘ভাই ভাই টি স্টল’। শুরুটা ১৯৯৫ সালে। গত ৩০ বছরে কয়েকগুণ দ্রব্যমূল্য বাড়লেও তিনি বাড়াননি চা আর পেঁয়াজুর দাম। আগের দামেই গ্রাহক সেবা দিয়ে চলছেন তিনি। এই চা আর পেঁয়াজু বিক্রি করেই তিনি এখন সফল ব্যবসায়ী।
নীলফামারী জেলা সদরের খোসবাবাড়ি ইউনিয়নের সন্ন্যাসীতলা গ্রামে আপন আহমেদের বাড়ি। বাড়ির পাশেই সন্ন্যানীতলা বাজারে গড়ে তুলেছেন ওই টি স্টলের ব্যবসা। সেখানে গ্রাহক সেবা বিকেল তিনটার পর থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত চলে জমজমাট।
অনেকেই ব্যবসা শুরু করেন মুনাফা অর্জনের জন্য। কিন্তু আপন আহমেদের শুরুটা শুরু মানবিকতার অনুভ’তিতে।
এমন মানবিকতার কথায় আপন আহমেদ বলেন, আমি এ ব্যবসা শুরু করি ১৯৯৫ সালে, তখন এসএসসি পাস করেছি। সে সময়ে সন্ন্যাসীতলা বাজারে কয়েকটি দোকান ছিল। এক বৃদ্ধ একটি দোকানে ছয় টাকার চা-বিস্কিট খেয়েছিলেন। কিন্তু ওই বৃদ্ধের কাছে ছিল পাঁচ টাকা। এক টাকা ঘাটতির কারণের দোকানদার গলাধাক্কা দিয়ে দোকান থেকে বের করে দেন বৃদ্ধকে। সে দৃশ্য আমাকে মর্মাহত করেছে।
তিনি বলেন, আমার মনে হয়েছে, সবার বৃদ্ধ বাবা-মা আছে। তাদের সাধ জাগে বাজারে গিয়ে চা-নাস্তা খাওয়ার। কিন্তু সামর্থ না থাকায় অনেকে পারছেন না। তাই অল্প টাকায় কিভাবে সকলকে খাওয়ানো যায় এমন চিন্তা থেকে এক টাকায় চা ও এক টাকায় পেঁয়াজু বিক্রি শুরু করি। এখন অনেক বৃদ্ধ ও অসহায় মানুষকে বিনামূল্যে খাওয়াই।
দ্রব্যমূল্য বাড়লেও ৩০ বছর আগের দাম ধরে রাখার ব্যাপারে তিনি বলেন, কেউ ব্যবসা করে দুধভাত খায়, আমার ডালভাত হলেই চলবে। তাই সারাজীবন একই দামে চা-ঁপেয়াজু বিক্রি করবো।
আপন আহমেদ জানান, তার ক্ষুদ্রব্যবসায়ী বাবা আব্দুল হাই মারা গেছেন তিন বছর আগে। বেছে আছেন মা রূপেনা বেগম (৬৫)। ২০০৮ সালে বিয়ে করেছেন রোজিনা আক্তারকে (৩৩)। বর্তমানে মা, স্ত্রী এবং দুই সন্তানকে নিয়ে পাঁচ সদস্যের পরিবার তার। বড় ছেলে রিজু আহমেদ এইচএসসিতে বিজ্ঞান বিভাগে পড়ছে নীলফামারী সরকারি কলেজে। আর ছোট ছেলে সিজু আহমেদ গ্রামের একটি স্কুলে পড়ছে সপ্তম শ্রেণিতে। স্ত্রী এবং দুই ছেলে লেখাপড়ার পাশপাশি ব্যবসায় সহযোগিতা করছে তাকে।
তিনি জানান, প্রতিদিন ২০ কেজি ডালের পেঁয়াজু বিক্রি হয় তার দোকানে। ওই ২০ কেজি ডালে পেঁয়াজু তৈরি হয় আট হাজার পিসের ওপরে। দোকানে চা বিক্রি হয় ৭০০ কাপের ওপরে। তেল, মসলা, জ্বালানি এবং চা, চিনিসহ প্রতিদিন তার খরচ হয় চার হাজার টাকা। সবমিলে প্রতিদিনের বিক্রি আট হাজার টাকার ওপরে। ওই আয়ে তিনি সংসার চালানোর পর বহন করছেন দুই সন্তানের লেখাপড়ার খরচ। ৩০ বছরে বাড়ির ভিটার পৈত্রিক সাত শতক জমির পাশে কিনেছেন আরও ২৬ শতক জমি। ছনের ঘর পরিবর্তন করে নির্মাণ করেছেন টিন সেডের ঘর।
তার দোকানের পেঁয়াজুর স্বাদের সুনাম ছড়িয়ে পড়েছে দূরদুরান্তে। বিকেল হলেই অনেকে ছুটে আসেন পেঁয়াজু-চায়ের দোকানে। সম্প্রতি সন্ধ্যায় ওই দোকানে গিয়ে দেখা গেছে, দুই ছেলেসহ আপন আহমেদের কর্মব্যস্ততা। সেখানে কথা হয় জেলা শহরের পাঁচমাথা মোড়ের মাসুদ ইসলাম (২২) এবং রবিউল ইসলামের (২২) সঙ্গে। তারা দুজনই থাই গ্লাস মিস্ত্রির কাজ করেন। কাজ শেষে সন্ধ্যায় দুই বন্ধু মিলে শহর থেকে প্রায় ১২ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে আপন আহমেদের পেঁয়াজুর স্বাদ নিতে যান।
জেলা শহরের নতুন বাজার এলাকার জাহিদুল ইসলাম বলেন, আমার ভাগিনা ঢাকায় থাকে। সে বিশ্বাস করতে পারছিল না এক টাকায় চা, এক টাকায় পেঁয়াজু পাওয়া যায়। তাই তাকে দেখাতে নিয়ে এসেছি।
খোকসাবাড়ি গ্রামের প্রবীণ ব্যক্তি গঙ্গা রাম রায় (৭৫) বলেন, আপনের চায়ের দেকানের কারণে আমাদের সন্ন্যাসীতলা বাজারের সুনাম এখন দূরদুরান্তে ছড়িয়ে পড়েছে। এখানে প্রতিদিন অনেক লোক আসে তার হাতের বানানো পেঁয়াজু খেতে। বাইরের লোকজন আসায় আমাদের বাজারের ব্যবসা-বাণিজ্য বেড়েছে। সবাইকে তাক লাগিয়ে ৩০ বছর ধরে একই দামে পেঁয়াজু-চা বিক্রি করছে সে।