
কালাম আজাদ
বগুড়া, ২২ নভেম্বর, ২০২৫ (বাসস) : ঐতিহাসিক মহাস্থানগড়ের কোলে গড়ে ওঠা বগুড়াকে শহরকে সমৃদ্ধ বলা হয় বহুমাত্রিক কারণে। এই শহরের গতিশীল অর্থনীতি, রাজনৈতিক কাঠামো কিংবা ভৌগলিক অবস্থান উত্তরের অন্যান্য জেলা থেকে ভিন্ন। আয়তনেও দেশের অন্যতম বৃহৎ পৌরসভা বগুড়া। এর বয়স প্রায় দেড়শ বছর।
এরই মধ্যে বগুড়া পৌরসভাকে সিটি করপোরেশনে উন্নীত করার আনুষ্ঠানিক উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। সম্প্রতি এক চিঠিতে বগুড়া পৌরসভাকে সিটি করপোরেশনে উন্নীত করার জন্য গণবিজ্ঞাপ্তি জারি এবং স্থানীয় বাসিন্দাদের মতামত ও আপত্তি নিষ্পত্তি করে চূড়ান্ত প্রতিবেদন পাঠানোর জন্য জেলা প্রশাসককে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
কিন্তু শহরে শতাধিক অনুমোদনহীন বহুতল ভবন, লোকালয়ের মধ্যেই প্রায় দেড় হাজারের বেশি হালকা প্রকৌশল শিল্পের কারখানা, খানা-খন্দে ভরপুর গলি সদৃশ্য রাস্তা, অপরিকল্পিত নালা, যত্রতত্র ময়লা-আবর্জনায় নাকাল নগরবাসী।
বগুড়া পৌরসভা কর্তৃপক্ষ বলছে, নতুন পৌরসভা গঠনের পাঁচ বছরের মধ্যে মাস্টারপ্ল্যান করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। আর পুরাতনগুলোর ক্ষেত্রে পৌরসভা আইন হওয়ার পাঁচ বছরের মধ্যে মাস্টারপ্ল্যান করতে বলা হয়েছে।
বিগত সময়ে পরিকল্পিত উন্নয়নের লক্ষ্যে দেশের ৩২৮টি পৌরসভার মধ্যে ২৫৫টির মাস্টারপ্ল্যান (মহাপরিকল্পনা) করে সরকার। এসবের মধ্যে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) তত্ত্বাবধানে প্রণীত ২৫০টি পৌরসভার মাস্টারপ্ল্যানের মেয়াদ গেজেট প্রকাশের আগেই শেষ হয়ে যায়। এসব পরিকল্পনা বিভিন্ন ধাপে ২০০৯ থেকে ২০১৭ সালে নেয়া হয়েছিল। এর মধ্যে বেশ কিছু পৌরসভায় মাস্টারপ্ল্যান নেওয়াও হয়েছে। কিন্তু প্রথম সারির পৌরসভা হয়েও প্রাচীন এই শহরটি বঞ্চিত থেকে গেছে।
মহাপরিকল্পনা বা মাস্টারপ্ল্যান হলো কোনো অঞ্চল বা শহর সুন্দরভাবে গড়ে তোলার ব্যবস্থাপনা। অর্থাৎ কতটুকু জায়গায় বাসাবাড়ি, হাসপাতাল, মার্কেট, স্কুল-কলেজ, খেলার মাঠ, সবুজ অঞ্চল, জলাশয় ও শিল্প-কারাখানা হবে তা নির্ধারিত থাকে মাস্টারপ্ল্যানে। ওই নির্দেশনা অনুসরণ করেই জায়গার উন্নয়ন করা হয়।
মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়নের সময় সংশ্লিষ্ট অঞ্চল বা শহরের ভূমির শ্রেণি, উন্নয়নের ধরন, মানুষের জীবনাচরণ ও চাহিদা বিবেচনা করে ‘নির্দিষ্ট’ সময়ের জন্য মাস্টারপ্ল্যান ডকুমেন্টস তৈরি করা হয়।
বগুড়া পৌরসভার সাম্প্রতিক বাজেটের তথ্য অনুযায়ী, ১৮৭৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় বগুড়া পৌরসভা। কালক্রমে আয়তন বাড়তে বাড়তে এখন ৬৯ দশমিক ৫৬ বর্গকিলোমিটার। ২১টি ওয়ার্ড নিয়ে গঠিত বগুড়া পৌরসভার জনসংখ্যা প্রায় ১০ লাখ।
এ পৌরসভায় ১ হাজার ৩৫০ কিলোমিটার সড়ক এবং ১ হাজার ২১০ কিলোমিটার ড্রেন আছে। এর মধ্যে ৪৫০ কিলোমিটার পাকা সড়কের বেশির ভাগই ভাঙা। এছাড়া কাঁচা সড়ক রয়েছে প্রায় ২৮৬ কিলোমিটার। একইভাবে অধিকাংশ এলাকায় অনেক কাঁচা ড্রেন আছে।
শহরের হালচিত্র নিয়ে ব্যাপক হতাশা ফুটে ওঠে বগুড়া পৌরসভার বাসিন্দাদের মধ্যে। পৌরসভা কিংবা সিটি করপোরেশনের জন্য পরিকল্পিত নগরায়নের বিকল্প নেই বলে জানান শহরের মালতিনগর এলাকার বাসিন্দা ও সুশাসনের জন্য নাগরিক বগুড়া শাখার সদস্য তাহমিনা পারভীন শ্যামলী।
তিনি বলেন, অপরিকল্পিত নগরায়নের কারণে বগুড়া শহরের সমস্যাগুলো প্রতিদিনই ভোগায়। রাস্তায় এলোমেলো যানবাহন, যেখানে সেখানে যানযট বাধে। যে যার মতো বাড়িঘর নির্মাণ করে রেখে দিয়েছে। ড্রেনগুলো ছোট, অনেক এলাকায় পর্যাপ্ত ড্রেনও নেই। প্রতিটি পাড়া, গলিতে ময়লার স্তুপ চোখে পড়ে।
শহরের চেলোপাড়ার বাসিন্দা শাহজাহান আলী জানান, তার বাড়ি থেকে অল্প দূরেই করতোয়া নদী। বসতি গড়ার সময় অনেকে ড্রেনের জন্য পর্যাপ্ত জায়গা ছাড়েনি। ফলশ্রুতিতে একটু বৃষ্টি হলে রাস্তা পানিতে ডুবে যায়। বাসা-বাড়ির আবর্জনা আর বর্জ্য গিয়ে নদীতে পড়ে। আবার পৌরসভার অপরিকল্পিত ড্রেন ব্যবস্থার জন্যও পানি নিষ্কাশন হয় না। ভোগান্তির শেষ নেই।
একইচিত্র শহরের কলোনী, খান্দার, সূত্রাপুরের।ড্রেনগুলোর স্বল্প ধারণ ক্ষমতার কারণেই মানুষকে বছরের পর বছর ধরে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) বগুড়া জেলার সাধারণ সম্পাদক জিয়াউর রহমান বলেন, পৌরসভার মধ্যে অনেকেই ইচ্ছে মতো বাড়িঘর নির্মাণ করছেন। এতে তৈরি হচ্ছে যানজট, জলজট, বায়ুদূষণসহ বহুমুখী দুর্যোগ। পরিবেশবান্ধব ও বসবাসযোগ্য নগর গড়তে হলে অবশ্যই এখন এই শহরের মাস্টারপ্ল্যান দরকার।
আবাসন ব্যবসায়ী আলী আখতিয়ার তাজু বলেন, উন্নয়ন আর কলকারখানার নামে বগুড়া পৌরসভার মধ্যে একটা বিশৃঙ্খলা অবস্থা। পৌরসভায় কোনো ময়লার ভাগাড় নেই। যেখানে সেখানে ময়লা আবর্জনা। বগুড়া সিটি করপোরেশন হওয়ার সময়ের দাবি। কিন্তু এর জন্য শহরকে বসবাসের উপযোগী করতে হবে। পৌরসভা কিংবা সিটি করপোরেশন হোক, বিশৃঙ্খলা নিরসনে নতুন করে মাস্টারপ্ল্যান অবশ্যই দরকার।
বগুড়া পৌরসভায় অন্তত ৬৪ হাজার বসতবাড়ি আছে। এর মধ্যে অনুমোদন ছাড়া নির্মাণ করায় অন্তত ১৪০টি ভবনকে অবৈধ হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে পৌর কর্তৃপক্ষ।
পৌরসভার আইন শাখায় খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বছরে অন্তত ২৫০টি অভিযোগ জমা হয় এখানে। নিয়ম বহির্ভূতভাবে বাড়ি নির্মাণ, জায়গার সীমানা নিয়ে জটিলতা, মানুষের চলাচলের রাস্তা ও ড্রেনের প্রয়োজনীয় জায়গা না ছাড়াকে কেন্দ্র করেই এসব অভিযোগ হয়ে থাকে। কিছু অভিযোগের নিষ্পত্তি হয়, কিছু মাসের পর মাস চলতে থাকে।
বগুড়া পৌরসভার নগর পরিকল্পনাবিদ আল মেহেদী হাসান জানান, সরকারি বিধি মোতাবেক একটা পৌরসভা গঠনের পাঁচ বছরের মধ্যে সেখানে মাস্টারপ্ল্যান গ্রহণ করতে হবে। অথচ বগুড়া পৌরসভার বয়স প্রায় দেড়শ বছর হতে চলেছে, কিন্তু কোনো মাস্টারপ্ল্যান নেই। এর মধ্যে বগুড়াকে সিটি করপোরেশন করতে চিঠি দেওয়া হয়েছে।
বগুড়া পৌরসভার প্রশাসক মাসুম আলী বেগ বলেন, মাস্টারপ্ল্যানের জন্য আমরা সম্প্রতি একটি চিঠি দিয়েছি। মাস্টারপ্ল্যান না থাকায় আমাদের অনেক অসুবিধা হচ্ছে। বাণিজ্যিক, আবাসিক সব এক জায়গা মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। এর মধ্যে স্থানীয় সরকার বিভাগের চিঠি পাওয়ার পর বাসিন্দাদের মতামত, আপত্তি নিষ্পত্তির জন্য পত্রিকায় গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশের সিদ্ধান্ত হয়েছে।