চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের অব্যবস্থাপনা দূর করতে প্রশাসনের হস্তক্ষেপ জরুরি

বাসস
প্রকাশ: ০৫ অক্টোবর ২০২৫, ১৪:২৭
চুয়াডাঙ্গা ১০০ শয্যার হাসপাতালটি নিজেই এখন রোগাক্রান্ত। ছবি: বাসস

//বিপুল আশরাফ //

চুয়াডাঙ্গা, ৫ অক্টোবর, ২০২৫ (বাসস) : জেলা সদরের একমাত্র হাসপাতালের দীর্ঘদিনের অব্যবস্থাপনা দূর করতে প্রশাসনের হস্তক্ষেপ জরুরি হয়ে পড়েছে। লোকবলের অভাব ও দীর্ঘদিনের অব্যবস্থাপনায় চুয়াডাঙ্গা ১০০ শয্যার হাসপাতালটি নিজেই এখন রোগাক্রান্ত। চাহিদা অনুযায়ী পরিচ্ছন্নকর্মী না থাকায় দুর্গন্ধে হাসপাতালে টেকা দায়।  

ড্রেনেজ ব্যবস্থা ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। জরুরি বিভাগেও টাকা ছাড়া চিকিৎসা সেবা পাওয়া যায়না। 
 
১৩ লাখ জনসংখ্যা অধ্যুষিত চুয়াডাঙ্গার ৪ উপজেলা থেকে প্রতিদিনই ১ হাজারের বেশি রোগী বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিতে আসে। তবে সবার ভাগ্যে ডাক্তার মেলে না। হাসপাতালের বিভিন্ন ওয়ার্ডে গড়ে প্রতিদিন রোগী ভর্তি থাকে ৩০০-৩২০ জন। তা সত্বেও হাসপাতালের দীর্ঘদিনের সমস্যা সমাধানে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।

এলাকাবাসীর প্রত্যাশা, এতদিন রাজনীতি প্রভাবিত প্রশাসন এদিকে নজর না দিলেও বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রশাসন বিষয়টি গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করে সমস্যা সমাধানে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।    

সরেজমিনে দেখা যায়, মাত্র ৯ জন মেডিক্যাল অফিসার নিয়ে পরিচালিত হচ্ছে চিকিৎসা কার্যক্রম। ভোগান্তিতে রোগী ও তাদের স্বজনেরা। চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালটি ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট হওয়ার কথা থাকলেও চালু আছে ১০০ শয্যা। তবে জনবল আছে মাত্র ৫০ শয্যার। প্রতিনিয়তই বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিচ্ছেন প্রায় এক থেকে দেড় হাজার রোগী। বিভিন্ন ওয়ার্ডে আন্তঃবিভাগে ভর্তি থাকে ৩০০ রোগী।
 
সংশ্লিষ্টরা জানান, চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালটি ২০০৪ সালে ৫০ শয্যা থেকে ১০০ শয্যায় উন্নীত করা হয়। তবে ১০০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালটিতে জনবল আছে প্রয়োজনের অর্ধেক। অন্তর্বিভাগ ও বহির্বিভাগ মিলিয়ে মাত্র ২৬ জন ডাক্তার চিকিৎসা সেবা দিচ্ছেন। নতুন ও পুরাতন ভবন মিলিয়ে নার্স আছে মাত্র ৬৫ জন এবং পরিচ্ছন্ন কর্মী ৪ জন। অফিস সহকারী আছেন একজন এবং স্বেচ্ছাসেবী রয়েছে ১৫ জন। অ্যানেস্থেশিয়ার চিকিৎসক না থাকায় দীর্ঘদিন যাবৎ বন্ধ ছিল অপারেশন থিয়েটার। সম্প্রতি জীবননগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স-এর একজন অ্যানেস্থেসিয়ার ডাক্তার চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে অতিরিক্ত সেবা দিচ্ছেন। 

চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে চক্ষু বিভাগে একজন, মেডিসিন বিভাগে একজন, অ্যানেস্থেসিয়ায় দুইজন, নাক কান গলা বিশেষজ্ঞ একজন, রেডিওলজিস্ট একজন এবং  একজন ডেন্টাল চিকিৎসক এর পদ শূন্য আছে। 

হাসপাতালের বিভিন্ন ওয়ার্ড ঘুরে দেখা যায়, আই সি ইউ এর দরজায় তালা ঝুলছে। আই সি ইউ শব্দটা যেন শুধু খাতা কলমেই সীমাবদ্ধ। অ্যান্টিভেনমের পর্যাপ্ত মজুত থাকা সত্ত্বেও সাপে কাটা রোগীরা অ্যান্টিভেনম না পেয়ে বাইরের ফার্মেসি থেকে কিনে আনছেন। ওষুধের তালিকায় ওমিপ্রাজল আছে বলা হলেও, মিলছে না কাঙ্ক্ষিত সেই ঔষধ। শিশু ওয়ার্ডের রোগীর সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। সেই তুলনায় চিকিৎসক কিংবা নার্সের সংখ্যা একই রয়ে গেছে। 

মাত্র ৪ জন পরিচ্ছন্ন কর্মী দিয়ে হাসপাতাল পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতেও বেশ বেগ পেতে হচ্ছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের। প্রতিটি ওয়ার্ডের ওয়াশরুমগুলোর অবস্থা শোচনীয়। বেশিরভাগ ওয়াশরুম ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। 

ডিঙ্গেদহ থেকে চিকিৎসা নিতে আসা রেজাউল করিম বাসসকে বলেন, হাসপাতাল প্রাঙ্গণ অপরিচ্ছন্ন। রাতে বাড়ে মশার উপদ্রব। যথাসময়ে নার্সদের ডেকেও চিকিৎসা সেবা পাওয়া যায় না। রোগীর হাতে ক্যানোলা পড়াতে গেলেও টাকা দিতে হয়। সব রকম ওষুধ এখানে পাওয়া যায় না। অনেক ওষুধ বাইরে থেকেও কিনতে হয় আমাদের। 

সরোজগঞ্জ থেকে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীর স্বজন টিটু আহমেদ বলেন, হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে গেলে লম্বা লাইনে দাঁড়াতে হয়। জরুরি বিভাগে চিকিৎসা নিতে গেলেও একই রকমের ভিড়। এই হাসপাতালে তেমন কোন সেবাই পাই না আমরা। কোন গুরুতর রোগী আসলেই বাইরের অন্য হাসপাতালে রেফার্ড করে দেওয়া হয়। চিকিৎসা নেওয়ার জন্য যদি বাইরেই যাওয়া লাগে, তাহলে এই হাসপাতাল থেকে আমাদের লাভ কি? 

ভালাইপুর থেকে চিকিৎসা নিতে আসা সাহার বানু বলেন, হাসপাতালের বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিতে গিয়েছিলাম। 

এই গরমে লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে ভেতরে ঢোকার সুযোগ পেলাম। ডাক্তার যা ওষুধ লিখে দিল হাসপাতালে গিয়ে শুধু অ্যান্টাসিড ছাড়া কিছুই পেলাম না। দামি দামি ওষুধগুলো বাইরে থেকেই কিনতে হলো। সরকারি হাসপাতালগুলোতে যদি সরকারি ওষুধ না পাই, তাহলে আমরা গরিবরা কোথায় যাব? 

তিনি বলেন, সদর হাসপাতালে এই দৃশ্য নতুন নয়। দীর্ঘদিন যাবৎ চিকিৎসক ও নার্স সংকটের বিষয়টি সকলেই জানেন। এই যদি হয় চিকিৎসা সেবার মান তাহলে জেলাবাসী যাবে কোথায়? 

চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে নার্সিং সুপারভাইজার রেহেনা পারভীন বলেন, পার্শ্ববর্তী জেলা মেহেরপুরে ১৬৫ জন নার্স থাকলেও, আমাদের চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে মাত্র ৬৫ জন নার্স কর্মরত আছেন। হাসপাতালটি ১০০ শয্যা বিশিষ্ট হলেও এখানে রোগী থাকে প্রায় ৩০০ থেকে ৪০০ জন। প্রতিনিয়ত এত রোগীর চাপ সামলাতে আমরা হিমশিম খাচ্ছি। 

নার্সিং সুপারভাইজার মমতাজ বেগম বলেন, সদর হাসপাতালের পুরুষ মেডিসিন ওয়ার্ড ২২ শয্যা বিশিষ্ট, কিন্তু রোগী আছে প্রায় ৮০ জন। এই ওয়ার্ডে খাবার বরাদ্দ আছে ২২ জনের। কিন্তু চিকিৎসা নিতে আসা রোগীরা সকলেই খাবার চায়। এই নিয়ে নানারকম অভিযোগ আমাদের কাছে আসে। তিনি আরো বলেন, হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগী ও তাদের স্বজনেরা নিয়মিত ডাস্টবিন ব্যবহার করে না। এতে করে এখানকার পরিবেশ দিন দিন খারাপ হয়ে যাচ্ছে। হাসপাতালে মাত্র ৪ জন পরিচ্ছন্ন কর্মী আছে। এই স্বল্পসংখ্যক পরিচ্ছন্ন কর্মী দ্বারা হাসপাতাল পরিচ্ছন্ন রাখা  বেশ কষ্টকর। জনবল সংকট দূর হয়ে গেলেই এখানকার পরিবেশ ভালো হবে বলে আমি মনে করি। 

চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের প্রধান সহকারী কাম হিসাব রক্ষক মো. আব্দুস ছবুর বলেন, বহির্বিভাগ ও আন্তঃবিভাগ মিলিয়ে মোট ২২ জন চিকিৎসক সেবা দিচ্ছেন। আমি যতটুকু জানি, হাসপাতালটি ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট করার জন্য প্রস্তাব করা হয়েছে। ২৫০ শয্যায় উন্নীত করার জন্য মোট ৬৫ জন মেডিক্যাল অফিসার দরকার। আশপাশের সব জেলা হাসপাতালগুলো ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট হলেও চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালটি আজও ১০০ শয্যায় রয়ে গেছে। 

বাসসের সাথে আলাপকালে হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক বিদ্যুৎ কুমার বিশ্বাস বলেন, চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে চিকিৎসক সংকটের কারণে চিকিৎসা ব্যবস্থা কিছুটা ব্যাহত হয়েছে। হাসপাতালটি ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট হওয়ার কথা থাকলেও চালু আছে বর্তমানে ১০০ শয্যা। ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট হলে রোগীদের চিকিৎসা নিতে আর কোন সমস্যা হবে না। 

তিনি বলেন, চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে পর্যাপ্ত অ্যান্টিভেনমের সরবরাহ আছে। হাসপাতালে ঔষধ ও চিকিৎসা সরঞ্জামের পর্যাপ্ত মজুত রয়েছে।  তিনি আরো বলেন, মাঝে মাঝে আমরা দেখতে পাই দালাল চক্রের কিছু লোকজন হাসপাতালের পরিবেশ নষ্ট করছে। তারা রোগী ও তাদের স্বজনকে ভুল বুঝিয়ে প্রতারণা করে নানানভাবে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। হাসপাতালে দালাল চক্রের কাউকে থাকতে দেওয়া হবে না। 

চুয়াডাঙ্গার ভারপ্রাপ্ত সিভিল সার্জন ডা. আওলিয়ার রহমান বাসসকে বলেন, ‘৫০ শয্যার জনবল দিয়ে চলছে বৃহৎ এ হাসপাতালের কার্যক্রম। আমরা ১০০ শয্যার জনবল চেয়ে মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠিয়েছি। খুব দ্রুতই আমরা জনবল পেয়ে যাবো। ডাক্তারসহ অন্য জনবল পেলে হাসপাতালে বর্তমানে যে সমস্য রোগীরা পোহাচ্ছে তা দূর হয়ে যাবে।’

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
সাতক্ষীরায় কাঠবোঝাই ট্রলি উল্টে চালকের সহকারী নিহত
ইউক্রেনে রুশ হামলায় নিহত ৫, বিদ্যুৎ বিভ্রাট
কাপ্তাই হ্রদ থেকে বালু উত্তোলনের দায়ে একলাখ টাকা জরিমানা
নেত্রকোণা শহরের ফুটপাত দখলমুক্তে উচ্ছেদ অভিযান জেলা প্রশাসনের 
সুনামগঞ্জে নিরাপদ মাছ উৎপাদন বিষয়ক সেমিনার 
নেপালে বন্যা ও ভূমিধসে নিহত ৪২
রাঙ্গামাটিতে জেলা পুলিশের প্রশিক্ষণ কর্মশালা
কুমিল্লায় নতুন প্রকল্প নিয়ে ডিসির মতবিনিময়
জাপানের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন তাকাইচি
আগামীকাল বিসিবির নির্বাচন অনুষ্ঠানে বাধা নেই
১০