নিজাম হাজারীর মতো তার স্ত্রীরও অঢেল অর্থ সম্পদ

বাসস
প্রকাশ: ১৬ মে ২০২৫, ১৪:৪৮ আপডেট: : ১৬ মে ২০২৫, ১৫:৩৬
সাবেক সংসদ সদস্য নিজাম উদ্দিন হাজারী। ছবি : সংগৃহীত

কাশেম মাহমুদ

ঢাকা, ১৬ মে, ২০২৫ (বাসস): ফেনীর আলোচিত সাবেক সংসদ সদস্য নিজাম উদ্দিন হাজারীর স্ত্রী নুরজাহান বেগমের কোনো পেশা না থাকা সত্ত্বেও তার নামে রয়েছে অঢেল অর্থ সম্পদ। নুরজাহান তার স্বামীর মতোই বিপুল অর্থ সম্পদের মালিক। তার স্বামী সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে থাকাকালীন মাত্র কয়েক বছরে তিনিও এই অর্থ সম্পদের পাহাড় গড়েছেন।

অর্থ সম্পদ অর্জনে স্বামী-স্ত্রীর তুলনামূলক দেখা যায়, নিজাম হাজারীর নামে ৬টি প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ রয়েছে ১১ কোটি ৬৮ লাখ ৮০ হাজার টাকা। অপরদিকে স্ত্রী নুরজাহানের নামে ব্যাংকসহ ৮ প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ রয়েছে ২৬ কোটি ২৮ লাখ ৬১ হাজার ৩২১ টাকা। ফেনী পৌরসদর এলাকায় নিজাম হাজারী  ৫৩ কোটি ৯৪ লাখ ৫ হাজার ২৮০ টাকা দলিল মূল্যে জমি ক্রয় করেছেন ১৩০০ শতক। স্ত্রী নুরজাহানের সাথে ঢাকার গুলশানে যৌথ নামে রয়েছে একটি ফ্ল্যাট। পক্ষান্তরে স্ত্রী নুরজাহান বেগমের যৌথ নামে ফ্ল্যাটসহ গুলশানে ৩টি ফ্ল্যাট, ঢাকার পল্টন, মোহাম্মদপুর, কাকরাইলে ৩টি ফ্ল্যাট, মোহাম্মদপুরে ৪ কাঠা জমির উপর ৪ তলা ভবন, চট্টগ্রামে ২টি ফ্ল্যাট, জয়দেবপুরে জমিসহ স্টিল স্ট্রাকচার স্থাপনা, বাগানবাড়ি। এসবগুলোর মূল্য দেখানো হয়েছে ১৪ কোটি ৫২ লাখ ২৫ হাজার ৭২৫ টাকা । নিজাম হাজারীর নামে ৩৬ ব্যাংক একাউন্টে জমা ১২ কোটি ৬০ লাখ ৯৫ হাজার ৪৫০ টাকা। অপরদিকে নুরজাহানের ২০ একাউন্টে জমা রয়েছে ৩ কোটি ৫৮ লাখ ৫২ হাজার ৭৪৫ টাকা। অথচ নুজাহান বেগমের ঢাকা-চট্টগ্রামে অর্জন করা ফ্ল্যাট, প্লট ও জমির প্রকৃত বাজার মূল্য অনেক বেশী বলে উল্লেখ করেন দুদক কর্মকর্তা। 

নিজাম হাজারী আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে ফেনী কেন্দ্রিক নেতৃত্ব ও সংসদ সদস্য হওয়ার সুবাদে তার স্ত্রী নুরজাহানও রাতারাতি আলোচিত হয়ে উঠেন। ফলে স্ত্রী নুরজাহানকেও চলাফেরা করার সময় নিজের নিরাপত্তার জন্য প্রশাসন থেকে অস্ত্রের লাইসেন্স নিয়ে চলাফেরা করতে হতো। স্বামী নিজাম হাজারী ছাড়াও নুরজাহানের নামে আলাদা পিস্তলের লাইসেন্স রয়েছে। তিনিও চলাফেরা করতেন নিজস্ব বডিগার্ড নিয়ে।   

দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সাবেক সংসদ সদস্য নিজাম উদ্দিন হাজারীর অর্থ সম্পদ তদন্ত করতে গিয়ে স্ত্রী  নুরজাহান বেগমের এই অর্থ সম্পদের সন্ধান পেয়েছে। ইতোমধ্যে দুদক উক্ত সম্পদ ক্রোক এবং অবরুদ্ধ করে অনুসন্ধান পূর্বক আদালতে এসব সম্পদ জব্দের আবেদন জানানোর পর আদালত অবরুদ্ধসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য দুদককে নির্দেশ দিয়েছেন।

আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে আরেক আলোচিত ফেনীর সাবেক এমপি জয়নাল হাজারী রাজনীতি থেকে নির্বাসনে যাবার পর তার শিষ্য নিজাম হাজারীর উত্থান হয় ফেনী জেলার আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে। দল ক্ষমতায় থাকায় মাত্র কয়েক বছরে গুরুকে ছাড়িয়ে যান শিষ্য নিজাম হাজারী। এই সময়ে স্বামীর আয় অর্জনের সঙ্গে-সঙ্গে স্ত্রী নুরজাহান বেগমও বিপুল অর্থ সম্পদের মালিক বনে যান। 

ফেনী-২ আসনে আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি নিজাম হাজারীর জ্ঞাত আয় বহির্ভূত অর্থ সম্পদের সন্ধান করতে গিয়ে দুদক স্ত্রী নুরজাহান বেগমের নামে ঢাকা, চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, গাজিপুর, কেরাণীগঞ্জ, ফেনীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ফ্ল্যাট, প্লট, জমি, বাগানবাড়ি, পাহাড়, পুকুরসহ বিপুল অর্থ সম্পদ ও বিনিয়োগের সন্ধান পান।

দুদকের উপ-পরিচালক মোহাম্মদ নুরুল হুদা ইতোমধ্যে তদন্ত ও অনুসন্ধান চালিয়ে বিভিন্ন ব্যাংকে গচ্ছিত টাকা, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগসহ এসব স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের খোঁজ পেয়েছে। দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে মহানগর সিনিয়র স্পেশাল জজ মো. জাকির হোসেনের আদালত (পারমিশন পিটিশন ২০৭/ ২০২৫) মূলে এসব সম্পদ অবরুদ্ধের আদেশ দিয়েছেন এবং এসব সম্পদ যেন হস্তান্তর করতে না পারেন সে ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলোর কাছেও নির্দেশনা দিয়েছেন।

দুদক জানিয়েছে, ঢাকা মহানগরীর গুলশানে রাজউকের বরাদ্দকৃত ১০৬ নম্বর সড়কের ১৮/ডি নম্বর প্লট এর ৫ কাঠার উপর নির্মিত এমপরি লেক ফ্রন্ট নামের আটতলা আবাসিক এপার্টমেন্টে দশমিক ৭৬ কাঠা ভুমিসহ ২ হাজার ৪৭০ বর্গফুটের এ-৫ নাম্বার ফ্ল্যাট রয়েছে। নিজাম হাজারী ও তার স্ত্রী নুরজাহান বেগমের যৌথ নামে রয়েছে। ফ্ল্যাটটির মূল্য ধরা হয়েছে ৭৪ লাখ ১০ হাজার টাকা।

নুরজাহানের নামে রাজধানী ঢাকায় আরো পাঁচটি ফ্ল্যাটের সন্ধান পেয়েছে দুদক। এরমধ্যে গুলশান-২ ব্লক-সিইএন (বি), রোড়-৯৬, প্লট-১০বি ভবনে বি-৬ ও বি-৮ দু’টি আলাদা ফ্ল্যাট রয়েছে। একটির দলিল মূল্য ১ কোটি টাকা। দলিল নম্বর ৩০৬২, রেজিস্ট্রি তারিখ ১৯ জুলাই, ২০২০। অপরটির দলিল মূল্য ২ কোটি টাকা। 

দলিল নম্বর ৫৫৮৬, রেজিস্ট্রি তারিখ ৫ নভেম্বর, ২০২০। মোহাম্মদপুরে উত্তর আদাবর এলাকায় একটি ফ্ল্যাট রয়েছে। যার দলিল মূল্য ধরা হয়েছে ২৪ লাখ ৪৬ হাজার ৩২৫ টাকা। দলিল নম্বর ৮৩৪৯, তারিখ ৫ ডিসেম্বর, ২০১১। পুরানা পল্টন লাইনে আরেকটি ফ্ল্যাট রয়েছে। যার দলিল নম্বর ৩৭৫৬, তারিখ ৩ অক্টোবর, ২০২১। যার দলিল মূল্য ধরা হয়েছে ১ কোটি ২১ লাখ টাকা। কাকরাইলে একটি ফ্ল্যাট (দলিল নম্বর ৯৭৭৩) ২০১১ সালের ২২ ডিসেম্বর রেজিস্ট্রি করা ফ্ল্যাটটির দলিল মূল্য ধরা হয়েছে ৪৮ লাখ ৩৯ হাজার ৯০০ টাকা। 

চট্টগ্রামে দু’টি ফ্ল্যাট রয়েছে। এর একটি গ্রিন লিপ-এ রাউট টাওয়ারে। যার মূল্য ধরা হয়েছে ৩৭ লাখ ৮০ হাজার টাকা। অপর ফ্ল্যাটটি রয়েছে চট্টগ্রামের অভিজাত খুলশি এলাকার ‘কাল ফার সারুজ’ ভবনের ৪-বি ফ্ল্যাট। ২০২২ সালের ৭ আগস্ট ১২৮০৫ নং দলিল মূলে ক্রয়কৃত ফ্ল্যাটের মূল্য দেখানো হয়েছে ৬৮ লাখ ৪০ হাজার টাকা।  

দুদক জানায়, নুরজাহানের নামে রাজধানীর মোহাম্মদপুরের কাটাসুর মৌজায় দু’টি পৃথক দলিলে ৪৯ দশমিক ৫০ কাঠা জমি রয়েছে। যার ক্রয় মূল্য দেখানো হয়েছে ৪৯ লাখ ৭৫ হাজার ৫০০ টাকা। মোহাম্মদপুর কাটাসুর মৌজায় চার কাঠা জমির উপর চার তলা ভবনসহ ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বর ৬৫৫৪ দলিল মূলে ক্রয়কৃত ভবনের মূল্য দেখানো হয়েছে ৩ কোটি ৬৮ লাখ ৫০ হাজার টাকা।  ২০১৭ সালে ২৯ নভেম্বর কেরানীগঞ্জের ঘাটারচরে ৬০ শতাংশ জমির উপর বাগানবাড়ি ক্রয় করা হয় মাত্র ৬০ লাখ টাকা মূল্যে। 

খাগড়াছড়ির রামগড়ে ১৫ একর জমি রয়েছে। গাজীপুরের জয়দেবপুরের আড়াইশপ্রসাদ এলাকায় ১ একর ৯ দশমিক ১০ শতাংশ জমিসহ বাগানবাড়ি (দলিল নম্বর ১৩৪৭৫,তারিখ ১ নভেম্বর, ২০১৬) মূল্য ৪৬ লাখ ৩১ হাজার টাকা, জয়দেবপুরের একই জায়গায় ৪ দশমিক ৯৫ শতাংশ চালাজমি (দলিল নম্বর ৬১১১, তারিখ ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২১) এবং ১৩ দশমিক ৭৫ শতাংশ চালা জমি ক্রয় (দলিল নম্বর ৯৭৮১, তারিখ ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২১)।

দুদকের অনুসন্ধানে দেখা যায়, মেঘনা ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামি ব্যাংক, এসসিসি ব্যাংক, এফএসআইবিএল ব্যাংকে জমা ও নগদ মিলিয়ে ১৯ কোটি ২৯ লাখ ৮২১ টাকা জমা রয়েছে। অনুসন্ধানে দেখা যায়, নুরজাহানের নামে দেড় লাখ টাকা দামের একটি পিস্তল রয়েছে। স্নিগ্ধা ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট লিমিটেডে ১ হাজার টাকা মূল্যের ১৫ হাজার শেয়ার। যার মূল্য ১ কোটি ৫০ লাখ টাকা, স্নিগ্ধা ইক্যুইটিজ লিমিটেডে ২ কোটি ৫০ লাখ টাকা মূল্যের ২৫ হাজার শেয়ার, স্নিগ্ধা ডিজাইন লিমিটেডে ৫ লাখ টাকা, স্নিগ্ধা ওভারসিজ লিমিটেডে ৮ লাখ টাকা মুল্যেও ৮০০ শেয়ার, এম এন ফিশারিজ এন্ড হ্যাচারিতে ২ কোটি ৫ লাখ ৩০ হাজার ৫০০ টাকার শেয়ার, স্নিগ্ধা ডিজাইন লিমিটেডে ১০০ টাকা মূল্যের ৫ হাজার শেয়ার। যার মূল্য ৫ লাখ টাকা। ব্যবসার মুলধন আছে ৮০ লাখ টাকা। নুরজাহান বেগমের নামে ৩০টি ব্যাংক হিসাব রয়েছে। এর মধ্যে ফাস্ট সিকিউরিটি ইসলামি ব্যাংকে ২২টি, মেঘনা ব্যাংকে চারটি, উত্তরা ব্যাংকে-একটি, জিআইবি’তে দু’টি এবং এবি ব্যাংকে একটি একাউন্ট পাওয়া যায়। যেখানে ৩ কোটি ৫২ লাখ ৫৮ হাজার, ৭৪৫ টাকা স্থিতি রয়েছে। 

দুদক কর্মকর্তা জানান, আদালতের নির্দেশনা মোতাবেক নিজাম হাজারীর বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। তার স্ত্রী বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। স্পষ্টই প্রতীয়মান হয় যে নিজাম হাজারী তার ক্ষমতার অপব্যবহার করে স্ত্রীর নামে এসব অবৈধ সম্পদ অর্জন করেছেন। 

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
নাটোরে বাস-সিএনজি সংঘর্ষে নিহত ২
চাঁদপুরে ১৩ জনকে ব্ল্যাক বেল্ট ও সার্টিফিকেট প্রদান
জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী ৩০০ আসনে প্রার্থী ঘোষণা করেছে জামায়াত : এটিএম মাসুম
ইরান-ইসরাইল সংঘাত নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে : এরদোয়ান
ময়মনসিংহে পৃথক সড়ক দুর্ঘটনায় ৯ জন নিহত, আহত ২০
অনূর্ধ্ব-১৯ সিক্স-এ-সাইড ক্রিকেট দিয়ে টেস্ট মর্যাদার ২৫ বছর উদযাপন করবে বিসিবি
বিদেশের মাটিতে প্রথম ফাইফার নাইমের
ফ্যাসিস্টদের বিরুদ্ধে যারা কথা বলেছে তারাই জেল খেটেছে : এ্যানি
দ্বীন প্রতিষ্ঠায় ময়দানে ইস্পাত কঠিন ঐক্য গড়ে তুলতে হবে : শফিকুর রহমান
তারেক রহমানের ফেরার প্রস্তুতি চলছে : আমীর খসরু
১০