ঢাকা, ১২ মে, ২০২৫ (বাসস) : ধর্ষণ! ভয়াবহ একটি শব্দ। শব্দটির সাথে আমরা প্রায় সকলেই পরিচিত। শিশু থেকে শুরু করে যে কোন বয়সী নারীই ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন।
ধর্ষণের নানাদিক নিয়ে আলোচনা হলেও এর যে অর্থনৈতিক ক্ষতি তা নিয়ে আলোচনা বলতে গেলে নেই।
বাংলাদেশে নারীর প্রতি সহিংসতার কারণে যে ক্ষতি হয়, তা দেশের মোট দেশজ উৎপাদনের আনুমানিক ২ দশমিক ১ শতাংশ। সহিংসতা, প্রতিদিন একটি মেয়েকে বিদ্যালয়ে যেতে এবং একজন নারীকে চাকরি করতে বাধা দেয়। আর এর ফলে তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে আপোস করতে হয় এবং একটি গোষ্ঠীর অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয়।
তবে তা কি পরিমাণে তা নিয়ে আলোচনা জরুরি, গবেষণা জরুরি। একজন শিশু বা নারীর ধর্ষণের পর আমরা এই ঘটনাকে দেখি আবেগের জায়গা থেকে। এই জায়গায় আবেগের চেয়ে আইন ও অর্থনৈতিক হিসেব জরুরি। অর্থাৎ একটা নির্দিষ্ট ধর্ষণের ঘটনার পেছনে কী পরিমাণ ক্ষতি হয় এবং সেই ধর্ষণ যদি প্রতিরোধ করা সম্ভব হয় তাহলে অর্থনৈতিকভাবে কীভাবে লাভবান হওয়া যেতো তার হিসেব জানা জরুরি।
দিনাজপুরের ১৮ অক্টোবর ২০১৬ সালের একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করছি। প্রতিবেশীর একই বয়সী মেয়ের সঙ্গে খেলতে গিয়ে নিখোঁজ হয় একটি শিশু। পরদিন শিশুটিকে তার বাড়ির কাছে অসুস্থ অবস্থায় পাওয়া যায়। শিশুটির প্রজনন অঙ্গ, মাথা, গলা, হাত ও পায়ে ধারালো অস্ত্রের আঘাতের চিহ্ন ছিল। ঊরুতে সিগারেটের ছ্যাঁকার ক্ষত ছিল। শিশুটির বাবা ২০ অক্টোবর ২০১৬-এ নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা করেন। ঘটনার পরপরই প্রতিবেশী সাইফুল ইসলামকে আসামি হিসেবে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। সংবাদমাধ্যমে ঘটনাটি আলোচিত হয়। বিচারে সাইফুল ইসলামের অপরাধ প্রমাণিত হওয়ায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয় আদালত।
এই ঘটনায় যে মেয়েটি ভিকটিম তার বয়স তখন ছিল ৫ বছর। তখন ধর্ষকের বয়স ছিল ৩৮। প্রতিবেশী সাইফুল ইসলাম ছিল শিশুটির পরিচিত। সেই সূত্রে সাইফুল সাথে করে নিয়ে গিয়েছিল তাকে। এরপর বীভৎসভাবে ধর্ষণ করে। হয়। এই বীভৎসতা বর্ণনা করার মতো নয়।
মেয়েটির বাবা কৃষক। কৃষিকাজ করে কত আয় হয় তা সবারই জানা। তা দিয়েই তার বাবা যুদ্ধে নামে। কিন্তু এই যুদ্ধের তো শেষ নেই। সর্বশান্ত বাবার পাশে দাঁড়ান বিভিন্ন এনজিও ও সংগঠন। তাদের আর্থিক সহযোগিতায় তার চিকিৎসা চলে।
ঘটনার পর থেকে মেয়েটি প্রস্রাব নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। দুই দিনেই লাগে ৬০০ টাকার ডায়াপার (প্যাকেটে ১০টি ডায়াপার থাকে)। তবে সব সময় ডায়াপার কেনার টাকা থাকে না, তখন পুরোনো কাপড় পরতে হয়। এই খরচও কম নয়।
২০১৬ সালের ঘটনার পর থেকে মেয়েটি ও তার পরিবারের সদস্যদের বেশিরভাগ সময় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওয়ানস্টপ ক্রাইসিস সেন্টার, হাসপাতালটির শিশু সার্জারি বিভাগ, বার্ন ইউনিটসহ বিভিন্ন হাসপাতালেই দিন পার করতে হচ্ছে। এ পর্যন্ত প্রজনন অঙ্গে কয়েক দফায় অস্ত্রোপচার হয়েছে।
ভিকটিমের পরিবারের যে ক্ষতি হয়েছে তা বলে শেষ করা যাবে না। এককথায় বলা যায়, পরিবারে একজন শিশু-মেয়ে-নারী ধর্ষিত হওয়া মানে তার এবং পরিবারের সব শেষ হয়ে যাওয়া। কোথাও আবার ভিকটিমকে বাঁচানো দুষ্কর হয়ে পড়ে। কিন্তু যে ভিকটিম বেঁচে থাকেন তার কী হয়? তাকে লড়তে হয় প্রতিক্ষণ, প্রতিঘণ্টা, প্রতিদিন, প্রতিমূহূর্ত। এই দুর্গম যাত্রায় কেউ হয়তো পাশে থাকেন, কেউ থাকেন না, কিন্তু কণ্টক পথ পাড়ি দিতে হয় ভিকটিম এবং পরিবারকে একাই।
যে পরিবারের কথা বলছিলাম, তাকে এবং তার পরিবারকে প্রতিবার দিনাজপুর থেকে ঢাকায় আসা, ঢাকায় থাকা-খাওয়া খরচ, চিকিৎসাসহ গোটা ব্যয় প্রক্রিয়া সমাধা করা একার আয়ের ওপর অসম্ভব। সচ্ছল হলেও অসম্ভব। কারণ এটা মহাকর্মযজ্ঞ।
এই বিশাল পাহাড় ঠেলতে হয় ভিকটিমের পরিবারকে। এই প্রক্রিয়ায় হাঁটতে কী পরিমাণ প্রতিবন্ধকতার মধ্য দিয়ে যে ভিকটিম এবং তার পরিবারকে যেতে হয় তা, তারা ছাড়া আর কেউই বলতে পারবে না।
ধর্ষণের শিকার একটা পরিবারকে কত ধরনের মানসিক, আর্থিক এবং আনুষঙ্গিক সংকটপূর্ণ পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেতে হয় তা নিয়ে সঠিক এবং সুনির্দিষ্ট গবেষণা আমাদের দেশে নেই। এসব নিয়ে গবেষণা প্রয়োজন। তুলনা করা প্রয়োজন ধর্ষণের শিকার একটি পরিবারের মানসিক, আর্থিক এবং আনুষঙ্গিকসহ কতধরনের ক্ষতির মধ্য দিয়ে যেতে হয়, আর সেই পরিবার যদি ধর্ষণের শিকার না হতো তবে কতধরনের সম্ভাবনা সেই পরিবার থেকে আশা করা যেত।
দিনাজপুরের সেই মেয়েটির প্রতিবার অস্ত্রোপচারে অঢেল অর্থ ব্যয় হয়। শেরেবাংলা নগরের ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব কিডনি ডিজিজেস অ্যান্ড ইউরোলজি হাসপাতালে সহযোগী অধ্যাপক (ইউরোলজি) মো. ফয়সাল ইসলাম জানান, এই অস্ত্রোপচারে ছয় থেকে সাত লাখ টাকা লেগেছে। তবে মেয়েটির চিকিৎসা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ করেছে বিনামূল্যে। বললেন, ‘মেয়েটির শারীরিক অবস্থা দেখে আমি নিজেই ইমোশনাল হয়ে পড়ি।’
সবসময় কি ধর্ষণের ভিকটিমরা এমন সাপোর্ট পান? পান না। এই ভোগান্তি, এই কষ্ট, এই বেদনা জানার পর ধর্ষণের ভিকটিম এবং তার পরিবারকে প্রণম্য মনে হয়। যে মর্মবেদনা তারা সহ্য করছেন তার মূল্য অঢেল।
ধর্ষণের শিকার ব্যক্তি ও তার পরিবারকে কী ধরনের অর্থনৈতিক সংকটের মুখে পড়তে হয় তার একটা তালিকা নিম্নরূপ:
# ধর্ষণের পর ভিকটিমের প্রাথমিক চিকিৎসা ব্যয়
# তাৎক্ষণিক উন্নত চিকিৎসার জন্য পরিবহন ব্যয়
# থাকা-খাওয়া খরচ
# উন্নত চিকিৎসা ব্যয়
# ভিকটিমের সাথে পরিবারের যেসব সদস্য থাকেন তাদের ব্যয়
# ভিকটিমের পরিবারের চাকরি বা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে অগ্রগতি স্থবির হওয়া
# মামলা সংক্রান্ত ব্যয়
# আইনজীবী নিয়োগ
# প্রতিবার মামলায় হাজিরা দেওয়া সংক্রান্ত পরিবহন, থাকা-খাওয়া খরচ
# মামলা চলমান রাখার খরচ
# সাক্ষ্য উপস্থিতকরণ ব্যয়
# প্রতিবার উন্নত চিকিৎসার জন্য প্রান্তিক থেকে শহরে আসা-যাওয়া, থাকা বাবদ খরচ;
# ভিকটিমকে মানসিক চিকিৎসা দেওয়ার খরচ
# ভিকটিমের বাড়তি পুষ্টি, আমিষসহ অন্যান্য খাবার ও ওষুধের খরচ
# ভিকটিমের জন্য আলাদা পরিবেশজনিত খরচসহ বিবিধ খরচ যুক্ত হয় ধর্ষণের পরে।
এইসব খরচ যদি না হয় তবে সেই পরিবার থেকে এবং পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে জাতি অনেককিছু পেতে পারতো। সেই পরিবার থেকে যদি মেধাবী কেউ না দাঁড়ায় তাও পরিবার স্থিতিশীলভাবে চলতে পারতো। ধর্ষণের কারণে অর্থনৈতিক সেই স্থিতিশীলতা আর দেখা যায় না।
ধর্ষণের পর সবাই যে ঘুরে দাঁড়াতে পারেন এমন নয়, বেশিরভাগ ভিকটিম এবং পরিবারই সামাজিক, আর্থিক ও মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। সেখান থেকে উঠে আসা বেশ কষ্টসাপেক্ষ। অনেক হারিয়েও যান। এই হারিয়ে যাওয়া থামিয়ে দেয়া জরুরি।
রাষ্ট্রে প্রত্যেক নাগরিকের বিশেষ করে নারী ও শিশুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত হলে অর্থনীতি সমৃদ্ধ হবে, সমৃদ্ধ হবে দেশ। তাই ধর্ষণ বন্ধে সবাইকে এক হয়ে কাজ করতে হবে।