জীতেন বড়ুয়া
খাগড়াছড়ি, ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ (বাসস) : বর্ষার বিদায় মানেই প্রকৃতিতে রং বদলের আভাস। পাহাড়ি জনপদ খাগড়াছড়ি তখন সাজে শরতের অপরূপ সাজে। দক্ষিণা বাতাসের মৃদু ছোঁয়ায় দুলতে থাকে সবুজ ধানের চারা। পথিকেরও মন কেড়ে নেয় প্রকৃতি। শরৎ মানেই খাগড়াছড়ির পাহাড়ে, টিলায়, ছড়ায়, নদীর তীরে সাদা সাদা কাশফুলের সমারোহ। জেলা জুড়ে কাশফুলের এই স্নিগ্ধতা উপভোগ করতে পর্যটকদের ভিড় বাড়ছে।
জেলা শহরের কোল ঘেষে এক পাশে চেংগী নদীর স্বচ্ছ জল, অন্য পাশে পাহাড়। নদীর তীরে তীরে হাওয়ায় দুলছে কাশফুল। মনে হয় যেন সবুজের বুক জুড়ে শুভ্রতার চাদর বিছানো। কাশফুলের মায়াবী আহ্বানে ভ্রমণপিয়াসীরা ছুটছেন খাগড়াছড়ি শহরের দিঘীনালা সড়কের ৮ মাইল এলাকায়। চেংগী নদীর কুল ঘেঁষে রাস্তার দুই ধারে ফুটে থাকা কাশফুল আর নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা মুহূর্তেই ছুঁয়ে যায় হৃদয়।
কখনো রোদ, কখনো বৃষ্টির লুকোচুরি খেলা মনে করিয়ে দেয় শৈশবের খেঁকশিয়েলের বিয়ের গল্প। চারপাশে গাছের সতেজতা, নদীর হাঁটুজলে শিশুদের দুরন্তপনা আর মাটির সোঁদা গন্ধে শরৎ যেন হয়ে ওঠে প্রাণজুড়ানো এক উৎসব। সব মিলিয়ে শরতের ছোঁয়ায় খাগড়াছড়ি আজ এক ছবির মতো সুন্দর জনপদ। যা মুগ্ধ করে প্রকৃতিপ্রেমী থেকে প্রতিটি পথিকের হৃদয়।
খাগড়াছড়ি জেলা জুড়ে কাশফুল ফুটলেও দীঘিনালা সড়কের ৮ মাইল ও পানছড়ির চেংগী নদীর তীরই এখন পর্যটকদের লক্ষ্যস্থল। প্রতিদিনই সৌন্দর্য পিপাসু অসংখ্য মানুষ ছুটে আসছেন খাগড়াছড়িতে। বিশেষ করে শুক্র ও শনিবার বন্ধের দিনে ভিড় বেশি হয়। এ ছাড়া সাধারণ মানুষের পাশাপাশি টিকটকারদের আনাগোনাও লক্ষণীয়।
পাশাপাশি অনেকেই কন্টেন্ট বানাতেও ছুটে আসছেন মনোমুগ্ধকর কাশবনে। খাগড়াছড়ি জেলা সদর ও পৌর এলাকার মাঠ-ঘাট, নদীর ধার ও পাহাড়ের কোলজুড়ে এখন কাশফুলের স্নিগ্ধতা।
সরেজমিনে দেখা যায়, খাগড়াছড়ি-দিঘীনালা সড়কের ৮ মাইল এলাকা ও পানছড়ির চেংগী নদীর তীরে প্রাকৃতিকভাবে গড়ে উঠেছে কাশবন। বাইরের পর্যটকদের পাশাপাশি এলাকার ভ্রমণপিপাসুদের অন্যতম আকর্ষণ এখন এই ৮ মাইল এলাকা ও চেংগী নদীর পাড়। ধবধবে সাদা পালকের মতো নরম কাশফুল প্রকৃতিকে রূপকথার আবেশে ভরিয়ে তুলেছে।
ছয় ঋতুর বৈচিত্র্যময় বাংলায় শরতের আগমন জানান দেয় কাশফুল। যা আমাদের সংস্কৃতিতে সৌন্দর্য ও শান্তির প্রতীক। কাঠফাটা রোদ আর তীব্র গরমের মধ্যে ময়ূরের পালকের মতো কোমল কাশফুলের শোভা হৃদয়ে এনে দেয় নির্মল স্নিগ্ধতা। এ সময় কিশোর কিশোরী,তরুণ তরুণী ও মধ্য বয়সীদেরও দেখা যায় কাশবনে প্রাণের উচ্ছ্বাসে মেতে উঠতে ।
দীঘিনালার ৮ মাইল এলাকায় ঘুরতে আসা খাগড়াছড়ি সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী তন্দ্রা চাকমা বাসসকে বলেন, ‘অনেকদিন ধরে কাশফুল দেখতে চেয়েছিলাম। আজ এসে ভীষণ আনন্দিত। কিছু কাশফুল তুলে মায়ের জন্য নিয়ে যাব।’ তন্দ্রার সহপাঠী ডলি বলেন, ‘গত বছর আসতে না পারলেও এ বছর বন্ধুদের নিয়ে আসতে পেরে অনেক ভালো লাগছে।
খাগড়াছড়ি পাহাড় গবেষণা কেন্দ্রের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডক্টর আলতাফ হোসেন বাসসকে বলেন, ‘শরতের কাশফুল শুধু চোখের আরাম নয়, মানুষের মনেও আনে প্রশান্তি এবং প্রকৃতির সঙ্গে এক নিবিড় বন্ধনের অনুভূতি। তাই প্রাকৃতিক এ সৌন্দর্যকে টিকিয়ে রাখা সকলের দায়িত্ব।’
স্কুল শিক্ষিকা সবিতা চাকমা বলেন, শরতের দখিনা হাওয়া সত্যিই মনে পুলক জাগায় আর আনন্দ দেয়। গ্রাম বাংলা তথা পার্বত্য চট্টলার পানছড়ি উপজেলার প্রাকৃতিক দৃশ্য এতই মনোরম যে, যা ঘুরে ফিরে দেখলে মন জুড়িয়ে যায়। পার্বত্য চট্টলার পাহাড়ে, ছড়ায়, নদী-নালায়, জুমে ঋতু বৈচিত্র্যের খেলা সত্যিই চমকপ্রদ। এ জন্যই আমি শরৎ কালকে বড্ড বেশী ভালোবাসি।
বিশেষজ্ঞদের মতে, কাশফুল শুধু সৌন্দর্যের প্রতীক নয়, এর রয়েছে বহুমুখী ব্যবহারও। ছন গোত্রীয় এ উদ্ভিদ গ্রামে জ্বালানি, ঝাড়ু ও ছাউনিতে ব্যবহৃত হয়। আয়ুর্বেদিক চিকিৎসকদের মতে, এতে রয়েছে নানা ঔষধি গুণ, যা পিত্তথলির পাথর নির্মূলে ও ফোঁড়ার চিকিৎসায় কার্যকর।
স্থানীয়রা জানান, একসময় খাগড়াছড়ির নদীর ধারে, মাঠে-ঘাটে অসংখ্য কাশবন দেখা যেত। যদিও এখন সেই সংখ্যা অনেকটাই কমে এসেছে। তবে জেলার পানছড়ি, ভাইবোনছড়া ও মহালছড়িসহ কয়েকটি উপজেলায় এখনোা কাশফুলের নান্দনিক শোভা দেখা যায়।