বার্লিনের হলোকস্ট স্মৃতিস্তম্ভ : ২০ বছরে মনোযোগ কেড়েছে লাখো পর্যটকের

বাসস
প্রকাশ: ০৭ মে ২০২৫, ১২:১৬

ঢাকা, ৭ মে, ২০২৫ (বাসস) : কেউ বলেন, এটি যেন কবরস্থানে হাঁটার অনুভূতি দেয়। কেউ বলেন, এটি কফিনের গোলকধাঁধা—বার্লিন শহরের মধ্যভাগে অবস্থিত হলেও এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা আর দিকভ্রান্তিকর পরিবেশ তৈরি করে এটি।

জার্মান রাজধানী বার্লিনের এই গম্ভীর হলোকাস্ট স্মারকটি—২,৭১১টি কংক্রিট স্তম্ভের এক ব্যতিক্রমী বিন্যাস—এই মাসে ২০ বছর পূর্ণ করছে। এটি ইতোমধ্যে লাখো পর্যটকের মনোযোগ কাড়তে সক্ষম হয়েছে।

‘ইউরোপের নিহত ইহুদিদের স্মৃতিস্তম্ভ’ জার্মানির এই বার্তা বহন করে যে, তারা ইতিহাসের সেই ভয়ঙ্কর অধ্যায় ভুলে যেতে চায় না।

কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবসানের ৮০ বছর পূর্তি ঘনিয়ে আসার প্রেক্ষাপটে নতুন করে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে যে, জার্মানির দীর্ঘদিনের স্মরণ-সংস্কৃতি ধীরে ধীরে ক্ষয়প্রাপ্ত হচ্ছে।

স্মারকের স্থপতি পিটার আইজেনম্যানের নিউইয়র্কভিত্তিক প্রতিষ্ঠান এটি নকশা করেছে। তিনি এএফপিকে বলেন, 'আমি এমন একটি অভিজ্ঞতা তৈরি করতে চেয়েছিলাম, যা এই শহরের অন্য কোনো স্থানে পাওয়া যাবে না।'

'মানুষ এটিকে ভয়ানক বলে মনে করে কারণ এটি শহরের জন্য উন্মুক্ত হলেও এখানে কেউ অদৃশ্য হয়ে যেতে পারে, এমনকি একটি শিশুও হারিয়ে যেতে পারে,' বলেন ৯২ বছর বয়সী আইজেনম্যান।

তবে তার উদ্দেশ্য ছিল না কাউকে দুঃখিত বা অপরাধবোধে ভোগানো। তিনি বলেন, 'শিশুরা এখানে লুকোচুরি খেলে, দৌড়ায়, কেউ কেউ স্তম্ভের ওপর রোদ পোহায়—তাদের যা ভালো লাগে তাই করুক। এখানে কোনো বাধ্যবাধকতা নেই।'

—‘একটি কবরস্থানের মতো’—

বার্লিনে একটি কেন্দ্রীয় হলোকাস্ট স্মৃতিস্তম্ভ গড়ার ধারণা আসে ১৯৮০-এর দশকে, তবে এটি নিয়ে বহু বিতর্ক তৈরি হয়, মূলত আশঙ্কা ছিল এটি নতুন করে ইহুদিবিদ্বেষ উসকে দিতে পারে।

জার্মান পার্লামেন্ট ১৯৯৯ সালে এই প্রকল্পে সম্মতি দেয় এবং ২০০৫ সালের ১০ মে এটি আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হয়। স্মৃতিস্তম্ভটির সঙ্গে একটি ভূগর্ভস্থ তথ্যকেন্দ্রও রয়েছে।

এটি প্রতি বছর কতজন মানুষ পরিদর্শন করেন তার নির্দিষ্ট পরিসংখ্যান নেই। তবে স্মারকের দেখভালকারী ফাউন্ডেশনের প্রধান উভে নয়মার্কার বলেন, 'সাধারণভাবে বলা যায়, বার্লিনে আসা প্রায় প্রতিটি পর্যটকই এই স্মৃতিস্তম্ভে আসেন।'

'এটি দিনরাত উন্মুক্ত, এবং এখানে সবসময় পর্যটক দেখা যায়। মানুষ একে ভালোবাসে কি না বলা কঠিন, তবে এটি তাদের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছে।'

স্মৃতিস্তম্ভের রক্ষণাবেক্ষণ ও নিরাপত্তা বাবদ প্রতি বছর আনুমানিক ২০ লাখ ইউরো (প্রায় ২৩ লাখ ডলার) খরচ হয়। নয়মার্কার বলেন, 'যত লোক আসে, তা বিবেচনায় নিলে এটা সঠিক খরচ।'

বার্লিনের যেকোনো দিনে, যেকোনো আবহাওয়ায়, পর্যটকদের দেখা যায় স্তম্ভগুলোর ভেতর দিয়ে হাঁটছে, ছবি তুলছে, কিংবা ইতিহাসের ভাবনায় নিমগ্ন হচ্ছে।

৭৪ বছর বয়সী ইংল্যান্ড থেকে আসা পর্যটক ক্লিফোর্ড গ্রিনহালঘ বলেন, 'আমি মনে করি জার্মানির জন্য এটা একটি ভালো সিদ্ধান্ত—এমন কিছু তৈরি করা। একটি ভাস্কর্য তো দেওয়া যায়, কিন্তু এমন কিছু... এটা ভোলার নয়। এখানে কোনো নাম নেই, কিন্তু নামের প্রয়োজনও নেই।'

কাজাখস্তানের ২৪ বছর বয়সী শিক্ষার্থী পোলিনা চেরনিয়াভস্কায়া বলেন, 'আমি যখন এর ভেতর দিয়ে হাঁটি, তখন বেশ শান্তি ও নির্জনতা অনুভব করি। এটি অনেকটা কবরস্থানের মতো—খুব শান্ত এবং চিন্তা করার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ।

—‘অতীতের অপরাধবোধ’—

নাজিদের নিষ্ঠুরতা স্মরণ এবং ‘আর কখনও নয়’ এই বার্তা—দীর্ঘদিন ধরে জার্মান রাজনীতি ও সমাজের একটি কেন্দ্রীয় দিক হয়ে রয়েছে, যার মাধ্যমে দেশটি অতীতের অন্ধকার অধ্যায়ের প্রায়শ্চিত্ত করতে চায়।

কিন্তু সম্প্রতি উগ্র-ডানপন্থী দল অল্টারনেটিভ ফর জার্মানি (এএফডি )-এর জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির কারণে নতুন করে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। দলটি ফেব্রুয়ারির জাতীয় নির্বাচনে দ্বিতীয় বৃহত্তম দল হয়ে ওঠে।

এই দলের নেতা বিয়োর্ন হেকে বার্লিনের এই স্মারককে ‘লজ্জার স্মৃতিস্তম্ভ’ বলে উল্লেখ করেন।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রযুক্তি কুবের ইলন মাস্ক একটি এএএফডি সমাবেশে ভিডিও বার্তায় বলেন, জার্মানি 'অতীতের অপরাধবোধ' নিয়ে "অতিরিক্ত মনোযোগী।'

স্মরণ-সংস্কৃতি বিষয়ক ফাউন্ডেশন ইভিজেড-এর এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ৩৮ শতাংশ উত্তরদাতা মনে করেন, এখন 'নাৎসি অধ্যায়ের ওপর একটি রেখা টেনে দেওয়া উচিত।'

ইভিজেড-এর পরামর্শক ভেরোনিকা হ্যাগার বলেন, এই ফলাফল স্মরণ-সংস্কৃতির জন্য এক ধরনের 'টার্নিং পয়েন্ট' নির্দেশ করে।

শুরুতে ভীতি থাকলেও স্মৃতিস্তম্ভটি সাম্প্রতিক সময়ে জার্মানিতে বাড়তে থাকা ইহুদিবিদ্বেষী হামলা বা নাশকতার শিকার হয়নি বললেই চলে।

তবে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে এক স্প্যানিশ পর্যটক এখানে ছুরিকাঘাতে গুরুতর আহত হন। পুলিশ জানায়, হামলাকারী এক সিরীয় নাগরিক ছিলেন, যিনি ইসলামিক স্টেটপন্থী বলে সন্দেহ করা হয়।

'আমরা এমন এক সময়ে বাস করছি যখন ডানপন্থী, চরমপন্থী ও নাৎসি-মনস্কদের কণ্ঠ ক্রমেই জোরালো হচ্ছে,' বলেন নয়মার্কার। 'এই সময়েই এমন একটি স্মারকের গুরুত্ব আরও বেশি।'

২০ বছর পরও এই স্মারক কি ততটাই প্রাসঙ্গিক থাকবে? স্থপতি আইজেনম্যান আশাবাদী।

'আমরা একটি ভালো স্মারক নির্মাণ করেছি। এটি বিমূর্ত। এটি কাউকে কোনো কিছু করতে বলে না। এটি বাধা দেয় না। এটি চটকদার নয়, বরং অত্যন্ত গম্ভীর... আমি মনে করি এটি দীর্ঘ দিন টিকে থাকবে।'

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
লেবাননের প্রেসিডেন্টের কাছে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের পরিচয়পত্র পেশ
শিল্পে উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য গ্যাস সরবরাহ করা হবে : জ্বালানি উপদেষ্টা
ঐকমত্য কমিশনের সাথে নাগরিক ঐক্যের বর্ধিত আলোচনা অনুষ্ঠিত
সৃষ্টিশীলতার মাধ্যমে সভ্যতা বিনির্মাণে প্রতিনিয়ত অবদান রেখে যাচ্ছেন প্রকৌশলীরা: কাদের গনি চৌধুরী
জুলাই বিপ্লবে শহীদ আবু সাঈদ হত্যার ঘটনায় মামলা
প্রাথমিক শিক্ষা সপ্তাহ শুরু ১০ মে
শ্রম পরিদর্শন ও বিভাগের কার্যাবলী সম্পূর্ণরূপে ডিজিটালাইজড করা হবে : শ্রম সচিব
চট্টগ্রামে পুলিশ হেফাজত থেকে পালানো আরেক আসামি গ্রেফতার
ইসরাইলের ছাড়া সব জাহাজের জন্য জলপথ নিরাপদ: হুথি
ভারত-পাকিস্তান সংঘর্ষ বন্ধে ‘সংলাপে’র আহ্বান যুক্তরাজ্যের
১০