প্রতীকী ছবি

ঢাকা, ১৮ জুন, ২০২৫ (বাসস) : দক্ষিণ আফ্রিকার বৃহত্তম টাউনশিপ সোয়েটোর শিশুদের কাছে এটি ‘হলুদ পাহাড়’ নামে পরিচিত। তবে এই পাহাড় আসলে একটি পুরনো সোনার খনি থেকে জমে ওঠা টেইলিংস বা বর্জ্য স্তূপ- যা বছরের পর বছর ধরে সোয়েটোর স্নেক পার্ক এলাকায় দূষণ ছড়িয়ে দিচ্ছে এবং স্থানীয় বাসিন্দাদের জীবন বিপন্ন করে তুলছে।

দক্ষিণ আফ্রিকার সোয়েটো থেকে এএফপি জানায়, এই পাহাড় থেকে বাতাসে উড়ে আসা হলুদ ধুলো শ্বাসনালীতে জ্বালাতর সৃষ্টি করে। একাধিক গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, এই ধুলোতে আর্সেনিক, সিসা, ইউরেনিয়ামসহ বিষাক্ত ভারী ধাতুর উপস্থিতি রয়েছে। ১৮৮০-এর দশকে দক্ষিণ আফ্রিকার সোনার খনির জোয়ারে এই বিষাক্ত উত্তরাধিকারের শুরু হয়। মূলত সই গোল্ড রাশ-ই জোহানেসবার্গ ও পরে সোয়েটো গড়ে তোলে।

২০১৭ সাল থেকে স্নেক পার্ক সেরিব্রাল পালসি ফোরামের তথ্য অনুযায়ী, অন্তত ১৫ জন শিশুর জন্ম হয়েছে সেরিব্রাল পালসি নিয়ে। এছাড়াও অনেক শিশু বিভিন্ন শারীরিক বিকলাঙ্গতা বা মানসিক প্রতিবন্ধ্যতা নিয়ে জন্ম নিচ্ছে।

১৩ বছর বয়সী ওখুলে একটি হুইলচেয়ারে বসে তার পালক মা লিলি স্টেব্বের পাশে হাসিমুখে কেবল শব্দ করে সাড়া দিচ্ছিল। জন্মের পর ধনধহফড়হ হওয়া এই শিশুটি হাঁটতে বা স্পষ্টভাবে কথা বলতে পারে না, নিজের বাহুও ব্যবহার করতে পারে না।

লিলি স্টেব্বে বলেন, ‘ও হাঁটতে পারে না, কথা বলতে পারে না... হাতও ব্যবহার করতে পারে না।’ তিনি অভিযোগ করেন, খনির বিষাক্ত ধুলোই ওর হাঁপানি, চোখ ও সাইনাসের সমস্যার কারণ।

স্টেব্বে নিজেও দীর্ঘদিন ধরে কাশি ও চোখে জ্বালাপোড়ার সমস্যায় ভুগছেন। দক্ষিণ আফ্রিকায় ব্যবসায়িক জবাবদিহি পর্যবেক্ষণ সংস্থা বেঞ্চ মার্ক ফাউন্ডেশনের প্রধান গবেষক ডেভিড ভ্যান উইক বললেন, ‘এই ধুলো শ্বাস নিলে ক্যানসার হতে পারে।’ 

তিনি বলেন, ‘এই ধুলো ডিএনএ কোড বিকৃত করে দিতে পারে। ফলে শিশুদের বিকলাঙ্গতা নিয়ে জন্ম হওয়ার আশঙ্কা বাড়ে। আমরা এই এলাকায় প্রচুর প্রতিবন্ধী শিশু দেখতে পাই।’

দক্ষিণ আফ্রিকায় ছড়িয়ে থাকা ৬,০০০’রও বেশি পরিত্যক্ত খনির মধ্যে অন্তত ২,৩২২টি উচ্চ ঝুঁকির আওতাভুক্ত বলে জানিয়েছে দেশটির অডিটর জেনারেল। ভ্যান উইকের হিসাবে, ১.৫ থেকে ২ কোটি দক্ষিণ আফ্রিকান এই ধরনের দূষণের আশপাশেই বসবাস করছেন।

মাত্র ৫০ হাজার মানুষের ছোট্ট এলাকা স্নেক পার্ক এবং এর লাগোয়া ‘মাউন্টেন ভিউ’ নামে একটি বস্তিতে এমন হাজারো পরিবার এই বিষাক্ত পরিবেশে বাস করছে।

ভ্যান উইক ইউনিভার্সিটি অব জোহানেসবার্গের সঙ্গে যৌথভাবে একটি দুই বছরের গবেষণা পরিচালনা করছেন। প্রতি মাসেই তিনি খনির বর্জ্যভূমিতে মাটি ও পানির নমুনা সংগ্রহ করে থাকেন।

সাম্প্রতিক পরীক্ষায় দেখা গেছে, খনির পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া একটি ছোট স্রোতে প্রতি লিটার পানিতে ৭৭৬ মিলিগ্রাম দ্রবীভূত কঠিন পদার্থ রয়েছে, যা পানযোগ্য নয়। সবচেয়ে বিপজ্জনক হলো, এই পানিতে ইউরেনিয়াম ও স্ট্রনটিয়াম রয়েছে—দু’টিই রেডিওঅ্যাকটিভ উপাদান।

এই বিষাক্ত পানি আশপাশের ভুট্টা ক্ষেতে এবং পশুর চরাগাহে প্রবাহিত হয়। স্থানীয় বাসিন্দারা জানাচ্ছেন, কিছু ছাগল তিন পা নিয়ে জন্ম নিচ্ছে।

স্থানীয় খনি এখন ‘প্যান আফ্রিকান রিসোর্সেস’ নামক একটি কোম্পানির মালিকানায়, যারা ২০২২ সালে এটি কিনে নিয়েছে। তারা জানায়, পূর্ববর্তী মালিক খনি পুনর্বাসনের কোনো ব্যবস্থা না করেই দেউলিয়া হয়ে যায়।

কমিউনিটি সম্পর্ক ব্যবস্থাপক সনওয়াবো মোডিমোএং বলেন, ‘আমরা জানি এটি মানুষের ওপর প্রভাব ফেলছে। আমরা লোকজনকে এখানে আসতে নিষেধ করেছি, সতর্কতামূলক চিহ্নও লাগানো হয়েছে। আমাদের ১০ বছর সময় দিন, সম্পূর্ণ বর্জ্য সরিয়ে ফেলব।’ 

কিন্তু স্থানীয় এনজিও ‘বামবানানি’র নেতা থোকোজিলে মনতাম্বোর দাবি, ‘এই স্তূপ এখনই সরাতে হবে, ১০ বছর পর নয়। প্রতিদিন এই ধুলো মানুষের শরীরে ঢুকে ক্ষতি করছে।’ 

৫৯ বছর বয়সী বাইলে বান্টসেকে তার অটিস্টিক নাতি মফোয়েন্তলের দেখাশোনা করেন। তিনি বলেন, ‘আমি সরকারকে দায়ী করি। যদি তারা আমাদের তোয়াক্কা করত, তাহলে এমনটা হতো না।’

বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের পরিবার প্রতি মাসে মাত্র ২,৩১০ র‌্যান্ড (প্রায় ১৩০ ডলার) ভাতা পায়, যা খাবার, কাপড় ও ডায়াপার কিনতেই যথেষ্ট নয়। ১৫ কিলোমিটার দূরের হাসপাতালে যাওয়ার যাতায়াত ব্যয়ও তারা বহন করতে পারে না।

স্নেক পার্ক সেরিব্রাল পালসি ফোরাম’-এর প্রতিষ্ঠাতা কেফিলও সেবোগোদি নিজের প্রতিবন্ধী ভাতিজিকে লালন-পালন করছেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের হুইলচেয়ার নেই, গাড়ি নেই।’ 

তবে এই কঠিন বাস্তবতার মাঝেও সেবোগোদি আশা ছাড়েননি। পুরোনো কমিউনিটি হলে মাসে একবার তাদের সমর্থনমূলক সভায় এক ডজনের বেশি মা, দাদি ও অভিভাবক জড়ো হন।

তিনি বলেন, ‘এই সভাগুলো প্রমাণ করে- এই কমিউনিটিতে আমাদের সন্তানদের গুরুত্ব আছে। আমরা এখনো লড়ছি, এখনো দাঁড়িয়ে আছি।’