ঢাকা, ৭ মে, ২০২৫ (বাসস) : প্রথম দফায় ঐতিহাসিক ব্যর্থতার পর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই মঙ্গলবার দ্বিতীয় দফার ভোটে জার্মানির চ্যান্সেলর নির্বাচিত হয়েছেন ফ্রিডরিশ মের্ৎস। ভোটাভুটির প্রথম দফায় প্রয়োজনীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলেও দ্বিতীয় রাউন্ডে ৩২৫ ভোট অর্জন করে যুদ্ধোত্তর জার্মানির ১০তম চ্যান্সেলর হলেন তিনি।
বার্লিন থেকে এএফপি জানায়, মঙ্গলবার পার্লামেন্টে অনুষ্ঠিত প্রথম দফার ভোটে ৬৩০ সদস্যের সংসদে প্রয়োজনীয় ৩১৬ ভোটের বিপরীতে মের্ৎস পান মাত্র ৩১০টি ভোট। অথচ তার নেতৃত্বাধীন জোটের হাতে ছিল ৩২৮টি আসন। পরবর্তী রাউন্ডে ৩২৫ ভোট পেয়ে তিনি বিজয়ী হন।
যুদ্ধ-পরবর্তী জার্মানিতে এই প্রথম কোনো চ্যান্সেলর প্রার্থী প্রথম দফায় ব্যর্থ হলেন। এই ঘটনাকে ‘ইতিহাসগড়া’ বলছে দেশটির গণমাধ্যম। ভোটাভুটির সময় তিনজন এমপি অনুপস্থিত ছিলেন, একজন ভোটদাতা বিরত ছিলেন এবং একটি ব্যালট বাতিল হয়।
উল্লেখ্য, মের্ৎসের বিজয়কে একপ্রকার আনুষ্ঠানিকতা হিসেবেই দেখা হচ্ছিল। কারণ তিনি ফেব্রুয়ারির সাধারণ নির্বাচনে জয়ী সিডিইউ/সিএসইউ জোট এবং মধ্য-বাম সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটস (এসপিডি)-এর সমর্থন পেয়েছিলেন। সম্মিলিতভাবে তাদের হাতে ৩২৮টি আসন রয়েছে।
প্রথম রাউন্ডের ব্যর্থতা ঘিরে হঠাৎ উত্তাল হয়ে ওঠে জার্মানির রাজনৈতিক অঙ্গন। চরম ডানপন্থী বিরোধীদল এএফডি সাধারণ নির্বাচনের দাবি তোলে। দলটির সহ-নেতা অ্যালিস ওয়েইডেল সাংবাদিকদের বলেন, ‘মের্ৎসেট সরে দাঁড়ানো এবং একটি নতুন সাধারণ নির্বাচনের পথ সুগম করা উচিত।’ তিনি এই ফলকে ‘জার্মানির জন্য ভালো দিন’ হিসেবে অভিহিত করেন।
চ্যান্সেলর হিসেবে দায়িত্ব নিয়ে ৬৯ বছর বয়সী মের্ৎস বিদায়ী নেতা ওলাফ শোলৎজের (এসপিডি) জায়গা নিলেন। শোলৎজের তিনদলীয় জোট সরকার গত নভেম্বরে ভেঙে পড়ে।
ব্যবসায়ী পটভূমি থেকে উঠে আসা মের্ৎস এর আগে কখনো সরকার প্রধানের দায়িত্বে ছিলেন না। সোমবার তিনি বলেন, ‘আমরা গভীর পরিবর্তন, প্রবল আলোড়ন এবং অনিশ্চয়তার যুগে বাস করছি। এমন সময় ইতিহাস আমাদের এই জোটকে সফল করার দায়িত্ব দিয়েছে।’
চ্যান্সেলর হিসেবে মের্ৎসের অঙ্গীকার—
অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করা, অনিয়মিত অভিবাসন দমন, ইউরোপে বার্লিনের ভূমিকা আরও শক্তিশালী করা, সেনাবাহিনীতে দীর্ঘদিনের অবহেলা দূর করে শক্তি বাড়ানো, জরাজীর্ণ অবকাঠামো পুনর্গঠন এবং ইউক্রেনকে সমর্থন অব্যাহত রাখা।
বিদায়ী পার্লামেন্ট এরইমধ্যে শত শত বিলিয়ন ইউরো বরাদ্দ রেখে একটি বড় ব্যয় পরিকল্পনা পাস করেছে।
মের্ৎসের এক প্রতিশ্রুতি হলো, সীমান্তে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করে অনিয়ন্ত্রিত অভিবাসন ঠেকানো এবং সাবেক চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মের্কেলের উন্মুক্ত-দ্বার নীতির অবসান ঘটানো। তার ভাষায়, এ পদক্ষেপ না নিলে আগামী চার বছরের মধ্যে আফডি নির্বাচনে জিতে যেতে পারে।
উল্লেখ্য, শুক্রবার জার্মান গোয়েন্দা সংস্থা এএফডিকে ‘চরম ডানপন্থী’ দল হিসেবে আখ্যায়িত করেছে, যা দলটি নিষিদ্ধ করার বিতর্ক ফের উসকে দিয়েছে।
এতে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন ট্রাম্পপন্থীরা। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও একে ‘ছদ্ম-নির্যাতন’ বলে আখ্যা দেন এবং গোয়েন্দা সংস্থার বিরুদ্ধে ‘ছদ্মবেশী স্বৈরাচার’ চালানোর অভিযোগ তোলেন।
বিশ্লেষকরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন নিরাপত্তা ও বাণিজ্য সম্পর্কের প্রচলিত কাঠামোকে চ্যালেঞ্জ করছেন, তখন এই ঘোষিত ট্রান্সআটলান্টিকপন্থী নেতার সামনে এক জটিল আন্তর্জাতিক বাস্তবতা হাজির রয়েছে।
৬৯ বছর বয়সী এই আইনজীবী ও অভিজ্ঞ ব্যবসায়ী একসময় যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সম্পদ ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠান ব্ল্যাকরকের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তবে এর আগে কখনও সরকারি নেতৃত্বের পদে ছিলেন না। একজন উদ্দীপনাময় বাগ্মী ও শৌখিন ধনাঢ্য পাইলট হিসেবে তিনি জার্মান রাজনীতিতে পরিচিত মুখ।
এবার তার লক্ষ্য—অর্থনীতিকে চাঙ্গা করা, প্রতিরক্ষা খাতকে পুনর্গঠন, ও অনিয়মিত অভিবাসন রোধ করে এমন একটি জার্মানি গড়া ‘যার ওপর আমরা আবার গর্ব করতে পারি’।
অ্যাঙ্গেলা মের্কেল ও পরে সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটদের নেতৃত্বে দুই দশকের মধ্যপন্থী শাসনের পর মের্ৎস তার ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্র্যাটিক ইউনিয়ন (সিডিইউ)'র পুরনো রক্ষণশীল শিকড়ে ফেরার অঙ্গীকার করেছেন।
কট্টর ডানপন্থী অল্টারনেটিভ ফর জার্মানি (এএফডি) পার্টির উত্থানকে রুখতেই মের্ৎস এই পথে হাঁটছেন বলে মত দিয়েছেন বিশ্লেষকেরা। ফেব্রুয়ারির সাধারণ নির্বাচনে এএফডি দ্বিতীয় স্থান দখল করে এবং এখন কিছু জরিপে শীর্ষস্থানে রয়েছে।
ডানপন্থায় ঝোঁকার আরও ইঙ্গিত দিয়ে মের্ৎস আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় ‘শূন্য সহনশীলতা’ নীতি, ‘ওয়োক’ নীতিমালা ও লিঙ্গ-সংবেদনশীল ভাষা সীমিতকরণ এবং মের্কেল আমলে বিলুপ্ত পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প পুনর্বিবেচনার ঘোষণা দিয়েছেন।
ক্ষমতা গ্রহণের আগেই তিনি পার্লামেন্ট থেকে শত শত বিলিয়ন ইউরোর সামরিক ও অবকাঠামোগত বরাদ্দ অনুমোদন করিয়ে নিয়েছেন, যাতে তিনি শুরু থেকেই কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারেন।
তিনি বলেন, ‘বাইরের দুনিয়া আমাদের অপেক্ষায় বসে থাকছে না।' গত ছয় মাস ধরে বার্লিনে রাজনৈতিক অচলাবস্থার পর তার এই মন্তব্য আসে, যা শুরু হয়েছিল বিদায়ী চ্যান্সেলর ওলাফ শোলৎজের জোট সরকার ৬ নভেম্বর—ট্রাম্প পুনর্নির্বাচিত হওয়ার দিন—ভেঙে পড়ার মধ্য দিয়ে।
ম্যার্কেলের প্রতিদ্বন্দ্বী
ইউরোপীয় মঞ্চে তিনি বার্লিন, প্যারিস ও ওয়ারশ’র ঘনিষ্ঠ অংশীদারত্বে ইউরোপীয় ইউনিয়নে জার্মানির কেন্দ্রীয় ভূমিকা পুনর্গঠনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
মার্কিন প্রশাসন মস্কোর সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের উদ্যোগ নিচ্ছে এমন সময়ও তিনি ইউক্রেনকে রাশিয়ার আগ্রাসন প্রতিহত করতে সহায়তার পক্ষে অটল।
এই অভিষেকের মধ্য দিয়ে মের্ৎস জীবনের বহু আকাঙ্ক্ষিত চ্যান্সেলর হওয়ার স্বপ্নপূরণ করলেন—যেটি মের্কেল বহু বছর আগে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে তাকে পরাজিত করে নস্যাৎ করেছিলেন।
এক সময়ের প্রতিদ্বন্দ্বী মের্কেল তাকে নেতৃত্ব প্রতিযোগিতায় হারিয়ে ১৬ বছর শাসন করেন। এরপর মের্ৎস রাজনীতি ছেড়ে ব্যবসা জগতে প্রবেশ করেন এবং ব্ল্যাকরকের জার্মান শাখাসহ বহু প্রতিষ্ঠানে দায়িত্ব পালন করেন। তার জীবনীকার সারা সিভার্ট লিখেছেন, এই সময়ে মের্ৎস ব্যক্তিগত আড্ডায় প্রায়ই মের্কেলের সমালোচনা করতেন।
জীবনীকার সারা সিভার্ট লিখেছেন, ‘প্রায় এক দশক ধরে মের্ৎস বারবার ইঙ্গিত দিয়েছেন যে তিনি রাজনীতি থেকে বিদায় নেননি এবং ফিরতে চান।’ সিডিইউ'র অনেকেই মনে করতেন, তিনি কেবল মের্কেলের বিদায়ের অপেক্ষায় ছিলেন।
নতুন করে রাজনীতিতে ফিরে মের্কেলের নীতিগুলোর সমালোচনায় সরব হন মের্ৎস, বিশেষ করে এক দশক আগে সিরিয়া ও আফগানিস্তান থেকে আগত শরণার্থীদের ব্যাপকভাবে স্বাগত জানানোর সিদ্ধান্তকে। নির্বাচনী প্রচারে অভিবাসন নিয়ন্ত্রণ তার প্রধান এজেন্ডা হয়ে ওঠে—বিশেষ করে একাধিক প্রাণঘাতী হামলার পর, যেখানে সন্দেহভাজনরা বিদেশি বংশোদ্ভূত।
এক বিতর্কিত রাজনৈতিক পদক্ষেপ হিসেবে তিনি সংসদে এক অভিবাসন বিরোধী প্রস্তাব তুলেছিলেন, যাতে এএফডি'রও সমর্থন ছিল—যা জার্মান রাজনীতিতে কট্টর ডানপন্থীদের সঙ্গে সহযোগিতার এক দীর্ঘদিনের ট্যাবু ভঙ্গ করে।
সাবেক চ্যান্সেলর ওলাফ শোলৎজ মের্ৎসকে আবেগপ্রবণ ও ‘মাথা গরম’ বলে অভিহিত করেন। তার মতে, মের্ৎস এএফডি'র সঙ্গে ভবিষ্যতে আরও সহযোগিতার পথ তৈরি করছেন—যা মের্ৎস দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করেন।
‘শিল্পের কাণ্ডারী ’
ক্যাথলিক ধর্মাবলম্বী মের্ৎস ১৯৫৫ সালের ১১ নভেম্বর জন্মগ্রহণ করেন, ও উত্তর রাইন-ওয়েস্টফালিয়ার সৌয়ারল্যান্ড অঞ্চলের পাহাড়-জঙ্গলে বেড়ে ওঠেন।
১৯৮ সেন্টিমিটার (৬ ফুট ৬ ইঞ্চি) লম্বা এই রাজনীতিক ভিড়ের মধ্যেও আলাদা করে চোখে পড়েন। তিনি একজন লাইসেন্সধারী পাইলট এবং মাঝে মাঝে নিজের ব্যক্তিগত বিমান চালান।
তিনি ৪০ বছরের বেশি সময় ধরে বিচারক শার্লট মের্ৎসের সঙ্গে বিবাহিত, তাঁদের তিন প্রাপ্তবয়স্ক সন্তান রয়েছে।
সিভার্ট লিখেছেন, ‘মের্ৎস একজন ধ্রুপদি বুর্জোয়া রক্ষণশীল—ভদ্রতা, সময়নিষ্ঠতা, পরিপাটি পোশাক ও ঝকঝকে অফিসকে পছন্দ করেন।'
তিনি ১৯৮৯ সালে ইউরোপীয় পার্লামেন্টে নির্বাচিত হন এবং শিগগিরই বুন্ডেসট্যাগে আসেন। সেখানে তার রাজনৈতিক অভিভাবক ছিলেন প্রয়াত সিডিইউ নেতা উলফগাং শয়েবল।
মের্ৎস একজন মুক্তবাজারপন্থী উদারনীতিক, যিনি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলোকে সহায়তা করতে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা কমাতে চান।
২০০৮ সালে প্রকাশিত তার বই 'ডেয়ার মোর ক্যাপিটালিজম-এ তিনি কর ও আমলাতন্ত্র হ্রাস করে ‘জার্মানি ইনকর্পোরেটেড’কে চাঙ্গা করার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেন। যেখানে তিনি ব্যবসাবান্ধব নীতির পক্ষে যুক্তি দেন।
মের্ৎস তার দীর্ঘ ব্যবসায়িক অভিজ্ঞতাকে রাজনৈতিক পুঁজি হিসেবে ব্যবহার করার চেষ্টা করেছেন বলে মনে করেন বার্লিনের ফ্রি ইউনিভার্সিটির রাজনৈতিক বিজ্ঞানী আন্তোনিওস সোরিস।
তিনি বলেন, 'শোলৎজের মতো পেশাদার রাজনীতিবিদের বদলে মের্ৎস একজন ‘শিল্পের কাণ্ডারী’ হিসেবে রাজনীতিতে ফিরেছেন—এই পরিচয়টি তিনি উপভোগ করেন।'