ঢাকা, ১৯ জুন, ২০২৫ (বাসস) : মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের বর্ষীয়ান নেতা অং সান সু চি বৃহস্পতিবার জান্তার কারাগারে তাঁর ৮০তম জন্মদিন পালন করেছেন, যেখানে তিনি একাধিক মামলায় দণ্ডিত হয়ে আজীবন সাজা ভোগ করছেন।
ইয়াঙ্গুন থেকে এএফপি জানায়, সু চি ছিলেন দেশটির এক দশকের গণতান্ত্রিক উন্মেষের প্রতীক। তিনি মিয়ানমারের সামরিক শাসনের অবসানের পর কার্যত দেশের নেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। কিন্তু ২০২১ সালের সেনা অভ্যুত্থানে ক্ষমতা হারিয়ে দুর্নীতি থেকে শুরু করে কোভিড বিধিভঙ্গসহ নানা অভিযোগে তাঁকে কারাবন্দি করা হয়। বর্তমানে তিনি ২৭ বছরের কারাদণ্ড ভোগ করছেন।
সন্তানের ব্যথিত কণ্ঠ
সু চির ৪৭ বছর বয়সী পুত্র কিম অ্যারিস ব্রিটেন থেকে বলেন, ‘এই সময়ে জন্মদিন উদযাপন সম্ভব নয়। দীর্ঘ সময় ধরে এটি চলায় আমরা সহ্য করতে শিখেছি।’
মায়ের ৮০তম জন্মদিন উপলক্ষে তিনি গত আট দিনে ৮০ কিলোমিটার দৌড়েছেন এবং সংগ্রহ করেছেন ৮০ হাজারের বেশি শুভেচ্ছাবার্তা। কিন্তু সু চি এগুলোর কিছুই দেখতে পারবেন না। তিনি মিয়ানমারের রাজধানী নেপিডোতে সেনাবাহিনীর কঠোর নিয়ন্ত্রণে বন্দি, যেখানে থেকে জান্তা গেরিলা বাহিনীর বিরুদ্ধে গৃহযুদ্ধ চালাচ্ছে।
কিম বলেন, ‘গত দুই বছরে শুধু একবার মায়ের কাছ থেকে চিঠি পেয়েছি। তাঁর স্বাস্থ্য সম্পর্কে কিছুই জানি না।’ তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন, মা হৃদরোগ, হাড় ও দাঁতের জটিলতায় ভুগছেন, কিন্তু চিকিৎসা পাচ্ছেন না।
ক্ষীণ প্রতিরোধ ও স্মরণ
সেনা নিয়ন্ত্রিত ম্যান্ডালে শহরে সু চির কিছু অনুসারী জন্মদিনের আগ মুহূর্তে ক্ষীণ প্রতীকী প্রতিবাদে অংশ নেন।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখা যায়, মুখোশ পরিহিত কয়েকজন ‘ভয়ের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা’ ও ‘শুভ জন্মদিন’ লেখা লিফলেট ছড়িয়ে দেন, আরেকজন কাঁপা হাতে সু চির ছবি ধরে রাখেন।
একজন বলেন, ‘তাঁকে কি এখনো মনে রাখেন?’ ভিডিওর সত্যতা স্বাধীনভাবে যাচাই করতে পারেনি এএফপি।
সাগাইং অঞ্চলের বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত এলাকায় নারীরা সু চির সম্মানে ফুল হাতে মিছিল করেছেন বলে স্থানীয় প্রতিবেদন জানিয়েছে।
আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতার পতন
দেশের ভেতরে এখনও সু চির জনপ্রিয়তা ব্যাপক হলেও আন্তর্জাতিকভাবে তাঁর গণতন্ত্রের প্রতীক হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা অনেকটাই ম্লান হয়ে গেছে।
বিশেষ করে, রোহিঙ্গা মুসলিমদের বিরুদ্ধে সামরিক দমন-পীড়নের সময় তিনি সেনাবাহিনীর পক্ষে অবস্থান নেওয়ায় আন্তর্জাতিক মহলে তীব্র সমালোচিত হন।
তাঁর শাসনামলে লাখ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসেন। যদিও অনেকেই মনে করেন, সু চির হাতে বাস্তব ক্ষমতা সীমিত ছিল এবং সামরিক প্রভাব অক্ষুণ্ন ছিল।
এই কারণে, সু চিকে দেয়া বহু আন্তর্জাতিক সম্মাননা ফিরিয়ে নেওয়া হয়েছে, আর তাঁর বর্তমান বন্দিত্ব তেমন একটা আন্তর্জাতিক মনোযোগ পায়নি।
রাজনীতির নীরব নায়িকা?
মিয়ানমারের জাতির পিতা অং সানের কন্যা সু চি ১৯৮৮ সালে মায়ের অসুস্থতায় দেশে ফিরে এসে আকস্মিকভাবে গণতন্ত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে আসেন।
সেনাবাহিনীর দমন-পীড়নের মধ্যে তিনি ১৫ বছর গৃহবন্দি ছিলেন, কিন্তু ইয়াঙ্গুনের লেকপাড়ের বাড়ির দেয়ালের ওপার থেকেও মানুষের কাছে বক্তৃতা দিতেন।
সামরিক জান্তা বারবার তাঁকে নির্বাসনে যেতে বললেও তিনি দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করেন। তাঁর এই মনোভাব তাঁকে ১৯৯১ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার এনে দেয়।
২০১০ সালে মুক্তি পাওয়ার পর তিনি ২০১৫ সালে ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি) দলকে জয়ের দিকে নিয়ে যান। যদিও সেনা রচিত সংবিধানের কারণে তিনি প্রেসিডেন্ট হতে পারেননি।
এনএলডি এক বিবৃতিতে বলেছে, ‘মিয়ানমারের চলমান সংকট নিরসনে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাধানে সু চিকে অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে গণ্য করতে হবে।’
তবে ছেলে কিম মনে করেন, যদি মা মুক্তি পানও, তিনি আর সক্রিয় রাজনীতিতে থাকবেন না।
মিয়ানমারের সেনাবাহিনী এ বছরের শেষ দিকে নতুন নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি দিলেও সু চির অসংখ্য অনুসারী যাঁরা এখন অস্ত্র হাতে বিদ্রোহে জড়িয়েছেন, তারা এই নির্বাচন বয়কটের ঘোষণা দিয়েছে।