ঢাকা, ২০ জুন, ২০২৫ (বাসস) : জ্বালানির দহন ও বন উজাড় থেকে সৃষ্ট কার্বন দূষণ, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, এবং পৃথিবীর উষ্ণতা বৃদ্ধির হার— সবই বর্তমানে এমন এক মাত্রায় পৌঁছেছে যা আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় বেশি উদ্বেগজনক। বৃহস্পতিবার প্রকাশিত একটি পর্যালোচিত বৈজ্ঞানিক হালনাগাদ প্রতিবেদনে বিশ্বের ৬০ জনেরও বেশি শীর্ষ বিজ্ঞানী এই বিষয়টি তুলে ধরেছেন।
বিজ্ঞানীরা জানান, ২০২৪ সালে বৈশ্বিক কার্বন নিঃসরণ সর্বোচ্চ মাত্রায় পৌঁছেছে। গত এক দশকের গড় অনুযায়ী বছরে ৫৩.৬ বিলিয়ন টন, অর্থাৎ প্রতি মিনিটে ১ লাখ টন কার্বন ডাইঅক্সাইড বা সমমানের গ্যাস নির্গত হয়েছে।
প্যারিস থেকে এএফপি জানায়, পৃথিবীর পৃষ্ঠতলের তাপমাত্রা গত বছর প্রথমবারের মতো ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে গেছে। বিজ্ঞানীদের হিসেব অনুযায়ী, এই সীমা অতিক্রম না করতে চাইলে আর মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই কার্বন বাজেট নিঃশেষ হয়ে যাবে।
পরিচ্ছন্ন জ্বালানি খাতে বিনিয়োগ এখন জীবাশ্ম জ্বালানিরখাতের চেয়ে দ্বিগুণ হলেও বিশ্বের মোট শক্তি ব্যবহার এখনও ৮০ শতাংশের বেশি জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরশীল, এবং নবায়নযোগ্য শক্তির প্রবৃদ্ধি চাহিদা বৃদ্ধির সঙ্গে তাল মেলাতে পারছে না।
২০১৫ সালের প্যারিস জলবায়ু চুক্তিতে গৃহীত ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস লক্ষ্যকে আগে 'আদর্শ' হিসেবে ধরা হয়েছে। এখন বিজ্ঞান বলছে এটি জলবায়ু বিপর্যয় এড়ানোর জন্য অপরিহার্য বাস্তবতা।
এই হালনাগাদ প্রতিবেদনটি আর্থ সিস্টেম সায়েন্স ডেট জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। এটি জাতিসংঘের আন্তঃসরকার জলবায়ু পরিবর্তন প্যানেল (আইপিসিসি)-র আগের রিপোর্টগুলোর অনানুষ্ঠানিক অথচ কর্তৃত্বশীল হালনাগাদ হিসেবে বিবেচিত।
ইউনিভার্সিটি অব লিডস-এর 'প্রিস্টলি সেন্টার ফর ক্লাইমেট ফিউচারস'-এর পরিচালক ও প্রধান লেখক পিয়ার্স ফস্টার বলেন, 'আমি সাধারণত আশাবাদী মানুষ। কিন্তু এবারকার রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, সবকিছু ভুল দিকে এগোচ্ছে।'
গবেষণায় দেখা গেছে, মানবসৃষ্ট উষ্ণতা বৃদ্ধির হার গত এক দশকে অভূতপূর্বভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে, যা ২০১০-২০১৯ সময়ের আইপিসিসি গড়ের চেয়েও অনেক বেশি।
সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ভয়াবহ গতিতে বাড়ছে। বিজ্ঞানীরা জানান, ১৯০১ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত গড়ে প্রতি বছর সমুদ্রপৃষ্ঠ ২ মিলিমিটারের নিচে বাড়ছিল। কিন্তু ২০১৯ সালের পর থেকে এটি বেড়ে বছরে ৪.৩ মিলিমিটারে দাঁড়িয়েছে।
গত ১২৫ বছরে সমুদ্রপৃষ্ঠ ২৩ সেন্টিমিটার বেড়েছে, যা ইতোমধ্যেই ছোট দ্বীপ রাষ্ট্রগুলোকে হুমকির মুখে ফেলেছে এবং ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের ধ্বংসাত্মক প্রভাবকে বহুগুণে বাড়িয়েছে।
পূর্ববর্তী এক গবেষণায় দেখা গেছে, ২০৫০ সালের মধ্যে আরও ২০ সেন্টিমিটার বাড়লে বিশ্বের ১৩৬টি প্রধান উপকূলীয় শহরে বছরে প্রায় এক ট্রিলিয়ন ডলারের ক্ষয়ক্ষতি হতে পারে।
জলবায়ু পরিবর্তনের পেছনে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো পৃথিবীর শক্তির ভারসাম্য— অর্থাৎ যত সৌরশক্তি পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করে, তার তুলনায় কতটা শক্তি তা ফেরত পাঠায়।
এই শক্তির ভারসাম্যগত ঘাটতি এখন প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে গত ২০ বছরে। যদিও এখন পর্যন্ত ৯১ শতাংশ অতিরিক্ত তাপ সমুদ্র শোষণ করেছে, বিজ্ঞানীরা সতর্ক করছেন, সমুদ্র আর কতদিন এই বোঝা বইতে পারবে তা অনিশ্চিত।
গবেষকরা জানিয়েছেন, পরবর্তী এক-দুই দশকে জলবায়ু বিপর্যয়ের কিছু প্রভাব অনিবার্য, কিন্তু এরপর কী হবে, তা মানবজাতির বর্তমান সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করছে।
সাবেক আইপিসিসি সহ-সভাপতি এবং এই গবেষণার অন্যতম লেখক ভ্যালেরি ম্যাসোঁ-দেলমত বলেন, 'আমরা দ্রুত ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস উষ্ণতার সীমায় পৌঁছব। কিন্তু এরপর কি তাপমাত্রা স্থায়ীভাবে বাড়বে, নাকি আমরা আবার তা কমিয়ে আনতে পারব— এটাই এখন মূল প্রশ্ন।'
২০২৫ সালের শেষদিকে ব্রাজিলে অনুষ্ঠেয় গুরুত্বপূর্ণ জলবায়ু সম্মেলনের আগে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ব্যাপকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের জলবায়ু নীতিমালার ধ্বংসাত্মক পদক্ষেপ এবং প্যারিস চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সরে আসা বিশ্বজুড়ে জলবায়ু উদ্যোগে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
ট্রাম্প প্রশাসনের এই অবস্থান শুধু যুক্তরাষ্ট্রকেই নিরুৎসাহিত করেনি, বরং অন্য দেশগুলোকেও তাদের প্রতিশ্রুতি দুর্বল করতে প্রভাবিত করছে।