ঢাকা, ২০ জুন, ২০২৫ (বাসস): এস্থার ও রিও—দুই অনাথ শিশু শিম্পাঞ্জি তাদের পরিচর্যাকারীর বুক আঁকড়ে ধরে আছে। সিয়েরা লিওনের একটি জাতীয় উদ্যানে অবস্থিত টাকুগামা শিম্পাঞ্জি অভয়ারণ্যে তাদের আশ্রয়। কিন্তু সেই উদ্যান এখন অবৈধ নগর সম্প্রসারণ ও নজিরবিহীন বন উজাড়ের হুমকিতে রয়েছে, যা বিপদ ডেকে আনছে পশু-পাখি ও মানুষ—উভয়ের জন্য।
তিন মাস বয়সে এই অভয়ারণ্যে আসা এই ছোট্ট শিম্পাঞ্জিরা এখন অন্যদের চিৎকার ও খেলাধুলার শব্দ শুনে চোখ মেলে তাকিয়ে থাকে।
অভয়ারণ্যের ঘন উদ্ভিদ, দম বন্ধ করা গরম আর পতঙ্গের কর্কশ গুঞ্জন—সব মিলে এখানকার বৈচিত্র্যময় প্রকৃতি এবং বিলুপ্তপ্রায় অনেক প্রজাতির আশ্রয়স্থল এই পার্কটি।
এই অভয়ারণ্য যেমন অনাথ পশ্চিমা শিম্পাঞ্জিদের পুনর্বাসনের জায়গা, তেমনি এটি বন্যপ্রাণী গবেষণা ও সংরক্ষণ শিক্ষার অন্যতম কেন্দ্র। এটি পর্যটকদের কাছেও জনপ্রিয়। কিন্তু মে মাসের শেষ থেকে একটি প্রতিবাদ হিসেবে এটি জনসাধারণের জন্য বন্ধ রাখা হয়েছে।
এই প্রতিবাদ সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণে—যাতে তারা পার্কের পরিবেশগত ধ্বংস রোধে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়।
টাকুগামা থেকে এএফপি জানায়, বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পরিবেশের এই অবক্ষয় শুধু শিম্পাঞ্জি নয়, পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের মানুষ, বিশেষত দুই মিলিয়ন জনসংখ্যার রাজধানী ফ্রিটাউনের বাসিন্দারাও হুমকির মুখে।
ফ্রিটাউনের মাত্র ১৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই অভয়ারণ্যটি ওয়েস্টার্ন এরিয়া পেনিনসুলা ন্যাশনাল পার্ক (ডব্লিউএপি-এনপি)'র অন্তর্গত।
খনি খনন, কাঠ কাটার কাজ ও শহর সম্প্রসারণে এই সবুজ পার্কের বিরাট অংশ ধ্বংস হয়ে গেছে। এদিকে, পাচারকারীরা অভয়ারণ্যের আশেপাশেই বিলুপ্তপ্রায় পশ্চিমা শিম্পাঞ্জিদের জন্য ফাঁদ পেতে রাখে। আন্তর্জাতিক প্রকৃতি সংরক্ষণ সংঘ (আইইউসিএন) এই প্রজাতিকে 'চরম বিপন্ন' হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
মনিটরিং প্ল্যাটফর্ম গ্লোবাল ফরেস্ট ওয়াচ জানায়, ২০০০ সালের পর থেকে সিয়েরা লিওনের ৩৯ শতাংশ বনাঞ্চল উজাড় হয়ে গেছে।
আর ডব্লিউএপি-এনপি'র ১৮,০০০ হেক্টর বনভূমির এক-তৃতীয়াংশ ২০১২ সালের পর থেকে ধ্বংস বা চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
'গত দুই-তিন বছরে আমরা বেশিসংখ্যক শিম্পাঞ্জি উদ্ধার করেছি,' বললেন অভয়ারণ্যের পরিচালক ও প্রতিষ্ঠাতা বালা আমারাসেকারান। তিনি ১৯৯৫ সালে এই অভয়ারণ্যটি প্রতিষ্ঠা করেন। 'এর কারণ, বাইরে যেখানে বন্য প্রাণীরা ছিল, সেই জায়গাগুলো ব্যাপকভাবে নষ্ট হয়েছে।'
ফ্রিটাউনের জন্য হুমকি
বন উজাড়ের ভয়াবহ প্রভাব শুধু শিম্পাঞ্জির ওপরই নয়—এটি ফ্রিটাউনের বাসিন্দাদের জন্যও বিপজ্জনক। শহরটির পানির একমাত্র উৎস গুমা বাঁধ, যা ডব্লিউএপি-এনপি'র মধ্যেই অবস্থিত।
এই বিশাল বাঁধটি অভয়ারণ্য থেকে প্রায় ৬ কিলোমিটার দক্ষিণে এবং এটি প্রাচীন, ঘন বৃক্ষ আচ্ছাদিত বৃষ্টি অরণ্যে ঘেরা।
কিন্তু নিচের উপত্যকায় দেখা যাচ্ছে নগরায়ণের ছাপ। এর ফলে বাঁধের জলাধারে পলি ও মাটি জমে যাচ্ছে, যা বিশেষত বর্ষাকালে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করে।
গুমা ভ্যালি ওয়াটার কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাদা কপেঙ্গে বলেন, 'এই বসতিটি তিন বছর আগেও ছিল না। কিন্তু প্রতি বছরই এখানে কিছু নতুন ঘর তৈরি হয়।' এই বসতির বাসিন্দারা দাবি করেন, তারা বৈধভাবেই জমি কিনেছেন।
বন উজাড় ও পানির সংকট
'প্রতি বছর আমরা কয়েক হাজার হেক্টর বন হারাচ্ছি,' বলেন কপেঙ্গে। 'এইভাবে চলতে থাকলে ১০ থেকে ১৫ বছরের মধ্যে আর বন থাকবে না বললেই চলে।'
গাছ না থাকায় পানির চক্রের স্বাভাবিক গতি ব্যাহত হবে এবং গুমা বাঁধের পানির স্তর ভয়াবহভাবে নেমে যাবে। 'ফ্রিটাউনে বসবাস করা তখন প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠবে,' তিনি বলেন।
সরকার আগের অস্বচ্ছ ও দুর্নীতিগ্রস্ত জমি বরাদ্দ ব্যবস্থাকে দায়ী করছে এবং বলছে, নতুন কঠোর আইন কার্যকর করা হয়েছে। তবে অভিযোগ রয়েছে, আইন প্রয়োগে অবহেলা ও দুর্বলতা রয়ে গেছে।
বন রক্ষায় রেঞ্জার টহল
এএফপি একদল অপর্যাপ্ত সরঞ্জামসজ্জিত বনরক্ষীর সঙ্গে পার্কে প্রবেশ করতে সক্ষম হয়। এরা নিয়মিত নিয়ম ভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে অভিযান চালান।
'পার্কে প্রচুর অবৈধ কর্মকাণ্ড চলছে,' বলেন আলফা মারা, যিনি ন্যাশনাল প্রটেকটেড এরিয়া অথরিটি (এনপিএএ)-তে বনরক্ষীদের কমান্ডার।
এই দিন তিনি এবং প্রায় ২০ জন রেঞ্জার একটি পিকআপ ট্রাকে চাপা পড়ে পার্ক ও আশপাশের এলাকায় ছয়টি স্থানে টহলে যান।
তাদের কাছে কোনো অস্ত্র বা সুরক্ষা উপকরণ ছিল না। একজন মাত্র রেঞ্জারের হাতে ছিল একটি দা।
অবৈধ ঘরবাড়ি ভাঙতে বা দখল করা জমির সীমাচিহ্ন সরাতে তারা খালি হাতেই কাজ করেন।
এক জায়গায় দা-ধারী রেঞ্জার টিনের ঘর কেটে ফেলে দেন। সেখানে এক তরুণী শিশু সন্তানকে বুকে চেপে কাঁপতে কাঁপতে বেরিয়ে আসেন।
তার নাম ফামাতা তুরায়। তিনি বলেন, তার স্বামী দেশের বাইরে থাকা এক ধনী ব্যক্তির জমি পাহারা দেন। 'এটি অবৈধ নির্মাণ,' রেঞ্জার ইব্রাহিম কামারা তাকে বলেন এবং ঘটনাস্থলের একটি প্রতিবেদন তৈরি করেন।
তুরায় কাঁদতে কাঁদতে বলেন, 'আমার ঘুমানোর আর কোনো জায়গা নেই, আমি জানতাম না এটা অবৈধ।'
বিশেষজ্ঞরা বলেন, বন উজাড়ের কারণে ফ্রিটাউন ও আশপাশের এলাকায় চরম গরম সহ্য করা কঠিন হয়ে উঠবে। এছাড়া, ভূমিধস আরও বেড়ে যাবে, বিশেষ করে বর্ষাকালে।
২০১৭ সালে আফ্রিকার ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ ভূমিধসে ফ্রিটাউনে ১,১৪১ জন নিহত হন—এই দুর্যোগ বন উজাড়ের কারণেই হয়েছিল।
টাকুগামা অভয়ারণ্যে ফিরে এসে পরিচালক আমারাসেকারান বলেন, 'যদি কেউ আইন ভাঙে, তবে তার শাস্তি হওয়া উচিত—কিন্তু বাস্তবে তা হচ্ছে না। এটি সরকারের প্রতিষ্ঠানিক ব্যর্থতা।'
এই অভয়ারণ্যে আসা অধিকাংশ অনাথ বনমানুষ পুষ্টিহীন, আহত বা বিকলাঙ্গ হয়ে থাকে। কেউ কেউ গুলির চিহ্ন বা দায়ের আঘাতের দাগ নিয়েও আসে। এদের অনেককে পোষা প্রাণী হিসেবে গ্রামে আটকে রাখা হয়েছিল।
এমনকি পুনর্বাসনের পরও এদের সারা জীবন অভয়ারণ্যের কয়েক ডজন হেক্টর বনভূমিতে কাটাতে হয়—যেখানে বর্তমানে প্রায় ১২০টি বনমানুষ বাস করছে।
'এই বনমানুষরাই এখন সিয়েরা লিওনের এক নম্বর ইকোট্যুরিজম আকর্ষণ,' বলেন আমারাসেকারান।
'একদিকে আপনি বলছেন, আমাদের একটি বিশ্বমানের অভয়ারণ্য আছে, আর অন্যদিকে সেটাই রক্ষা করতে আমরা ব্যর্থ হচ্ছি। তা তো হতে পারে না।'