ঢাকা, ২৭ জুন, ২০২৫ (বাসস) : যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নেতৃত্বে তীব্র বিদেশি সহায়তা কর্তন এবং বৈশ্বিক অস্থিরতার কারণে দারিদ্র্য, ক্ষুধা ও জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় অগ্রগতি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে- এ প্রেক্ষাপটে আগামী সপ্তাহে স্পেন একটি জাতিসংঘ সম্মেলন আয়োজন করছে যাতে নতুন করে উন্নয়ন সহায়তার প্রতিশ্রুতি আহ্বান জানানো হবে।
মাদ্রিদ থেকে এএফপি জানায়, দক্ষিণ স্পেনের সেভিয়ায় ৩০ জুন থেকে ৩ জুলাই পর্যন্ত অনুষ্ঠেয় চতুর্থ আন্তর্জাতিক উন্নয়ন অর্থায়ন সম্মেলনে প্রায় ৭০টি দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান অংশ নেবেন।
ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁ, দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাফোসা এবং ইকুয়েডরের দানিয়েল নোবোয়া আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকছেন।
তবে এই সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্রের অনুপস্থিতি উন্নয়ন সহায়তায় বৈশ্বিক সমন্বয়ের ক্ষেত্রে এক বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবেই দেখা হচ্ছে।
জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস, বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট অজয় বাঙ্গা এবং ৪,০০০-এর বেশি ব্যবসায়ী, এনজিও ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি সম্মেলনে অংশ নিচ্ছেন।
বিশ্বের সবচেয়ে ধনী দেশগুলো বাজেট সংকোচন শুরু করায় এবং ২০৩০ সালের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) বাস্তবায়ন থেকে ক্রমে পিছিয়ে পড়ায়, এই সম্মেলনের তাৎপর্য বহুগুণে বেড়েছে।
গুতেরেস জানিয়েছেন, বৈশ্বিক উন্নয়ন সহায়তার ক্ষেত্রে বার্ষিক অর্থ ঘাটতি ৪ ট্রিলিয়ন ডলার।
ট্রাম্পের নেতৃত্বে যুক্তরাষ্ট্র আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা (ইউএসএইড)-এর বাজেট ব্যাপকভাবে কমিয়ে দিয়েছে। ইউএসএইড ছিল বিশ্বব্যাপী সবচেয়ে বড় সহায়তা প্রদানকারী সংস্থা, যার বরাদ্দ হ্রাসে বহু মানবিক প্রকল্প ধাক্কা খেয়েছে।
যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানি, নেদারল্যান্ডস ও বেলজিয়ামও সাম্প্রতিক সময়ে সহায়তা কমিয়ে দিয়েছে। এর ফলে আফ্রিকায় এইডস প্রতিরোধ, বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শিশুদের শিক্ষা কার্যক্রমসহ নানা উদ্যোগ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থা (ইউএনএইচসিআর) ইতোমধ্যে ৩,৫০০ পদ ছাঁটাইয়ের ঘোষণা দিয়েছে, যা বিশ্বের সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকা মানুষের জীবন ও সেবায় সরাসরি প্রভাব ফেলবে।
এর পাশাপাশি, মধ্যপ্রাচ্য ও ইউক্রেনে চলমান সংঘাত, ট্রাম্পের শুল্ক যুদ্ধ এবং বহুপক্ষীয় সহযোগিতার টানাপোড়েন বৈশ্বিক উন্নয়নের সংকটকে আরও জটিল করে তুলেছে।
করোনা-পরবর্তী সময় থেকে অনেক উন্নয়নশীল দেশ তাদের আয়ের বড় অংশ ঋণের সুদ মেটাতে ব্যয় করছে, ফলে স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
দ ষধঃব পোপ ফ্রান্সিসের তত্ত্বাবধানে এবং নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ জোসেফ স্টিগলিৎজের নেতৃত্বে এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বে ৩.৩ বিলিয়ন মানুষ এমন দেশে বাস করছে, যারা কেবল ঋণের সুদ পরিশোধে স্বাস্থ্য খাতের চেয়ে বেশি ব্যয় করে।
এই প্রেক্ষাপটে বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সংস্কার নিয়ে সমালোচনার ঝড় উঠেছে।
জাতিসংঘ মহাসচিব গুতেরেস বলেন, ‘সেভিয়া হলো একটি অচল, বৈষম্যমূলক এবং পুরাতন আন্তর্জাতিক আর্থিক ব্যবস্থাকে সংস্কারের একটি অনন্য সুযোগ।’
নিউইয়র্কে জুন মাসে অনুষ্ঠিত প্রস্তুতিমূলক বৈঠকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া সব সদস্যরাষ্ট্র একটি খসড়া নথিতে সম্মত হয়, যা সেভিয়ায় গৃহীত হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
এই নথিতে বিশেষ করে দারিদ্র্য দূরীকরণ, ক্ষুধার অবসান, এবং লিঙ্গসমতা অর্জনের লক্ষ্যে ২০৩০ সালের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য পূরণের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করা হয়েছে।
এতে করব্যবস্থার সংস্কার, আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে গ্লোবাল সাউথ-এর প্রতিনিধিত্ব বাড়ানো, উন্নয়ন ব্যাংকগুলোর ঋণ সক্ষমতা তিনগুণ করা, সামাজিক ব্যয় নিশ্চিতে পূর্ব-প্রাক্কলিত অর্থায়ন এবং কর ফাঁকির বিরুদ্ধে সহযোগিতা জোরদারের আহ্বান জানানো হয়েছে।
তবে যুক্তরাষ্ট্র জানিয়েছে, তারা এমন উদ্যোগের বিরোধিতা করছে যা ‘জাতীয় সার্বভৌমত্বে হস্তক্ষেপ করে’, আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ওপর চাপ সৃষ্টি করে এবং ‘লিঙ্গভিত্তিক অগ্রাধিকার’ ধারণ করে।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন এই ঐকমত্যকে সফলতা হিসেবে দেখালেও অনেক এনজিও বলছে, এটি পর্যাপ্ত নয়।
ক্রিশ্চিয়ান এইড-এর বৈশ্বিক কণ্ঠস্বর বিভাগের প্রধান মারিয়ানা পাওলি বলেন, ‘এই নথি ঋণ ও জীবাশ্ম জ্বালানি ভর্তুকি বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিশ্রুতি দুর্বল করেছে, যা গ্লোবাল সাউথ বারবার দাবি করে আসছিল।’
তিনি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিবন্ধকতাকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে ধনী দেশগুলো সংস্কারকে আটকে রাখছে। এটা কোনো নেতৃত্ব নয়, এটা আত্মপ্রবঞ্চনা।’
পূর্ববর্তী প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে ধনী দেশগুলোর ব্যর্থতাও আস্থার সংকট সৃষ্টি করেছে। ২০২০ সালের মধ্যে দরিদ্র দেশগুলোকে বছরে ১০০ বিলিয়ন ডলার জলবায়ু সহায়তা দেওয়ার কথা থাকলেও সেই লক্ষ্য অর্জিত হয় কেবল ২০২২ সালে।
২০২৪ সালে আজারবাইজানে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘ জলবায়ু সম্মেলনের বিতর্কিত আলোচনায় ধনী দেশগুলো ২০৩৫ সালের মধ্যে বছরে ৩০০ বিলিয়ন ডলার জলবায়ু অর্থায়নের প্রতিশ্রুতি দেয়, যা গ্লোবাল সাউথ ও জলবায়ু কর্মীদের মতে ‘অপর্যাপ্ত’।
স্বাধীন বিশ্লেষকরা বলেছেন, আসল প্রয়োজন বছরে ১ ট্রিলিয়ন ডলারেরও বেশি।
সেভিয়ায় অনুষ্ঠেয় সম্মেলনটি জাতিসংঘের উন্নয়ন অর্থায়ন বিষয়ক চতুর্থ সম্মেলন এবং এটি প্রথমবারের মতো কোনো উন্নত দেশ আয়োজন করছে। এর আগে ২০০২ সালে মেক্সিকো, ২০০৮ সালে কাতার এবং ২০১৫ সালে ইথিওপিয়ায় এ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল।