ঢাকা, ১ জুলাই, ২০২৫ (বাসস) : ট্রাম্প্র প্রশাসন যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক সাহায্য কমিয়ে দেওয়ার ফলে ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ১ কোটি ৪০ লাখেরও বেশি মানুষ মারা যেতে পারেন, যাদের এক-তৃতীয়াংশই শিশু—এমন আশঙ্কাজনক তথ্য প্রকাশ পেয়েছে এক গবেষণায়।
প্যারিস থেকে এএফপি জানায়, ‘দ্য ল্যানসেট’ সাময়িকীতে প্রকাশিত এক গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে।
বিশ্বব্যাপী সহায়তা খাতকে পুনরুজ্জীবিত করতে বিশ্বের নেতৃবৃন্দ ও ব্যবসায়িক নেতারা এই সপ্তাহে স্পেনের সেভিয়ায় জাতিসংঘের এক সম্মেলনে অংশ নিচ্ছেন। এমন সময় এ গবেষণার তথ্য সামনে এলো।
যুক্তরাষ্ট্রের সংস্থা ইউএসএইড এতদিন বিশ্বব্যাপী মানবিক সহায়তার ৪০ শতাংশের বেশি যোগান দিয়ে আসছিল। কিন্তু জানুয়ারিতে ডোনাল্ড ট্রাম্প হোয়াইট হাউসে ফেরার পর পরিস্থিতি বদলে যায়। ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার দুই সপ্তাহ পর তার ঘনিষ্ঠ উপদেষ্টা ও বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি ইলন মাস্ক সংস্থাটিকে বন্ধ করে দেওয়ার দাবি জানান। পরে ট্রাম্প ইউএসএইডে ব্যাপকহারে অর্থায়ন কমিয়ে দেন।
গবেষণার সহ-লেখক ও বার্সেলোনা ইনস্টিটিউট ফর গ্লোবাল হেলথ-এর গবেষক ডাভিদে রাসেলা সতর্ক করে বলেন, এই তহবিল হ্রাস দুই দশকের স্বাস্থ্য অগ্রগতিকে থামিয়ে দিতে পারে, এমনকি উল্টো দিকে ঠেলে দিতে পারে। স্বল্প ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোর জন্য এর অভিঘাত একটি বৈশ্বিক মহামারি বা বড় ধরনের যুদ্ধের মতোই ভয়াবহ হতে পারে।
২০০১ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে ১৩৩টি দেশে সহায়তার তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এই সময় ইউএসএইড-এর সহায়তায় উন্নয়নশীল দেশগুলোতে ৯১.৮ মিলিয়নের বেশি মানুষকে মরণব্যাধি থেকে বাঁচানো সম্ভব হয়েছে। এটি ইতিহাসের সবচেয়ে প্রাণঘাতী যুদ্ধ- দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাণহানির সংখ্যাকেও ছাড়িয়ে গেছে।
মার্কিন সরকার ঘোষিত ৮৩ শতাংশ তহবিল হ্রাস বাস্তবায়িত হলে মৃত্যুর হার কীভাবে বাড়তে পারে, তা মডেলিংয়ের মাধ্যমে বিশ্লেষণ করেছেন গবেষকেরা।
তাদের হিসাবে দেখা যায়, এই সহায়তা হ্রাস ২০৩০ সালের মধ্যে ১ কোটি ৪০ লাখেরও বেশি প্রতিরোধযোগ্য মৃত্যুর কারণ হতে পারে। এর মধ্যে ৫ বছরের নিচে ৪৫ লাখের বেশি শিশু রয়েছে, অর্থাৎ প্রতি বছর প্রায় ৭ লাখ শিশু মারা যেতে পারে।
গবেষণায় আরও বলা হয়, ইউএসএইড-এর কর্মসূচিগুলোর মাধ্যমে মৃত্যু হার গড়ে ১৫ শতাংশ কমানো সম্ভব হয়েছে। আর শিশু মৃত্যুর হার ৩২ শতাংশ পর্যন্ত কমেছে।
বিশেষত, এইচআইভি/এইডস, ম্যালেরিয়া ও উপেক্ষিত ট্রপিক্যাল রোগগুলো প্রতিরোধে ইউএসএইড-এর ভূমিকা ছিল অত্যন্ত কার্যকর। উচ্চ সহায়তাপ্রাপ্ত দেশগুলোতে এইডসজনিত মৃত্যুর হার ৬৫ শতাংশ কমেছে এবং ম্যালেরিয়াজনিত মৃত্যুও প্রায় অর্ধেক কমেছে।
মোজাম্বিকের মানহিকা হেলথ রিসার্চ সেন্টারের গবেষক ও সহ-লেখক ফ্রান্সিসকো সৌতে বলেন, তিনি মাঠ পর্যায়ে দেখেছেন কীভাবে ইউএসএইড এইডস, ম্যালেরিয়া ও যক্ষ্মার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে কার্যকর অবদান রেখেছে। এখন এই অর্থ সহায়তা বন্ধ করা মানে শুধু মানুষকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া নয়, সেই অবকাঠামোকেও ধ্বংস করা, যা গড়ে তুলতে কয়েক দশক লেগেছে।
বোস্টন ইউনিভার্সিটির গবেষক ব্রুক নিকোলস পরিচালিত এক ট্র্যাকার অনুযায়ী, ইউএসএইড-এর তহবিল হ্রাস করার পর এখন পর্যন্ত প্রায় ১ লাখ ৮ হাজার প্রাপ্তবয়স্ক এবং ২ লাখ ২৪ হাজার শিশুর মৃত্যু হয়েছে। গড় হিসাবে প্রতি ঘণ্টায় ৮৮ জন মারা যাচ্ছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা সংস্থা ইউএসএইড কার্যত ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পর ফ্রান্স, জার্মানি ও যুক্তরাজ্যসহ আরও কয়েকটি বড় দাতা দেশও তাদের বৈদেশিক সহায়তা বাজেট কমানোর ঘোষণা দেয়। বিশেষ করে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সহায়তা কমানো ভবিষ্যতে আরও অনেক মানুষের মৃত্যুর কারণ হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন গবেষণা সহ-লেখক এবং আইএস গ্লোবালের ক্যাটেরিনা মোন্টি।
তবে গবেষকেরা বলেছেন, এই ভয়াবহ পূর্বাভাস বর্তমানে প্রতিশ্রুত সহায়তার পরিমাণের ভিত্তিতে তৈরি করা হয়েছে। যদি পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটে এবং সহায়তা বাড়ে, তাহলে এই মৃত্যুহার অনেকটাই কমে যেতে পারে।
এই সপ্তাহে বিশ্বের বহু রাষ্ট্রপ্রধান স্পেনের সেভিয়ায় এক দশকের মধ্যে সবচেয়ে বড় সহায়তা সম্মেলনে অংশ নিচ্ছেন। তবে যুক্তরাষ্ট্র সেখানে অংশ নিচ্ছে না।
গবেষণা সহ-লেখক ডাভিদে রাসেলা বলেন, এখন সময় হলো সহায়তা বাড়ানোর, কমানোর নয়।
তহবিল কমানোর আগে যুক্তরাষ্ট্র মোট ফেডারেল ব্যয়ের মাত্র ০.৩ শতাংশ ইউএসইইডকে প্রদান করত।
যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের জেমস ম্যাকিনকো বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকরা প্রতিদিন গড়ে মাত্র ১৭ সেন্ট বা বছরে প্রায় ৬৪ ডলার ইউএসইইড-এ অবদান রাখেন। আমি বিশ্বাস করি, যদি মানুষ জানতেন এই সামান্য অবদান কত লক্ষ প্রাণ বাঁচাতে পারে, তাহলে তারা অবশ্যই এই তহবিল চালু রাখার পক্ষে থাকতেন।