\মাহমুদুর রহমান নাজিদ\
ঢাকা, ৯ জুলাই, ২০২৫ (বাসস) : ছাত্র-জনতার জুলাই গণআন্দোলনের খবরগুলো মৃত্যু ভয় উপেক্ষা করে সংগঠকদের কাছে পৌঁছে দিতাম। তাছাড়া নিজেদের মোবাইলের ওয়ালপেপারে এমন একটি ছবি দিয়েছিলাম যেখানে নিজেদের নাম, বাবার নাম, মায়ের নাম, ঠিকানা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নাম এবং রক্তের গ্রুপ লেখা ছিল।
যাতে করে আহত বা নিহত হলে পরিবারের কাছে সহজে খবর পৌঁছানো যায়। বিপুল হতাহত দেখে জীবন বাজি রেখে রাজপথে নেমেছি, এই লড়াইয়ে আমি শহীদ হতে চেয়েছিলাম। জুলাই গণআন্দোলনের অন্যতম সংগঠক মেহেদী হাসান ইমরান বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থাকে (বাসস) দেয়া এক সাক্ষাৎকারে এ কথা বলেন।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দেয়া এই আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক ছিলেন ঢাকা সিটি কলেজের ছাত্র মেহেদী হাসান ইমরান যিনি শুধু একজন শিক্ষার্থীই নন বরং এক সাহসী নাগরিক হিসেবে দেশের স্বপ্নভঙ্গ, শোষণ ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে বুক পেতে দাঁড়িয়েছেন। ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগের ২০২১-২২ সেশনের এই শিক্ষার্থী নিজেই একটি স্বপ্ন হারানোর গল্পকে রূপান্তরিত করেছেন আত্মত্যাগ ও সংগ্রামের অনুপ্রেরণায়।
তার গ্রামের বাড়ি ফেনী জেলার দাগনভূঁঞা উপজেলার উত্তর খুশিপুর গ্রামে। ছয় ভাই-বোনের মধ্যে মেহেদী সবার ছোট। তার পিতা মোহাম্মদ বাহার মিয়া একজন প্রবাসী এবং মাতা মোসাম্মদা মাসুদা একজন গৃহিণী।
সম্প্রতি তিনি জাতীয় বার্তা সংস্থা বাসসের সাথে সাক্ষাৎকারে জুলাই আন্দোলনের স্মৃতিচারণ করেছেন।
বাসস : জুলাই আন্দোলনের ১ বছর পূর্ণ হলো, ওই সংগ্রামের সময় গুলো এখনো কি আপনি অনুভব করেন?
মেহেদী হাসান ইমরান : হ্যাঁ, আন্দোলনের সময়কার অভিজ্ঞতা আমার জীবনে গভীর প্রভাব ফেলেছে। ওই সময় আমরা যেমন ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিবাদ করেছি, ঠিক তেমনই আজও মনে করি অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলা দায়িত্বের অংশ। এক বছর পার হয়ে গেলেও ওই সময়ের শিক্ষা ও উপলব্ধি আমার চিন্তায় এখনও প্রভাব রাখে।
বাসস : জুলাই আন্দোলনের সূত্রপাত কীভাবে হয়েছিলো? আপনি কীভাবে যুক্ত হয়েছিলেন ?
মেহেদী হাসান ইমরান : এই আন্দোলনের মূল প্রেক্ষাপট ছিল চাকরি প্রাপ্তিতে অবিচার এবং মেধার যথাযথ মূল্যায়নের অভাব। শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে গঠিত কিছু সংগঠন ও সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে আন্দোলনটি শুরু হয় এবং অল্প সময়েই তা দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে যাতে আমার ও অংশগ্রহণ ছিল।
বাসস : কোটা আন্দোলন থেকে স্বৈরাচার সরকার বিরোধী আন্দোলনে রূপ নেয় কীভাবে ?
মেহেদী হাসান ইমরান : প্রথমে আমরা শুধু ন্যায্যতার দাবি নিয়েই মাঠে নেমেছিলাম, মেধার মূল্যায়ন হোক, সবাই সমান সুযোগ পাক। কিন্তু খুব দ্রুতই বুঝে ফেললাম, এই রাষ্ট্রযন্ত্র শুধু আমাদের কণ্ঠ রোধ করতেই ব্যস্ত।
আমাদের ওপর লাঠিচার্জ হলো, মামলা হলো, ক্যাম্পাসে ঘেরাও করা হলো, এমনকি ফেসবুক পোস্টের জন্যেও হেনস্তা করা হলো। এছাড়া ১৫ই জুলাই তৎকালীন সরকারের পেটুয়া বাহিনী ও ছাত্রলীগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে নির্বিচারে শিক্ষার্থীদের উপরে হামলা চালায়, রংপুরে পুলিশের গুলিতে শহীদ হয় আবু সাঈদ। এর পরই উপলব্ধি করি—এটা আর কেবল কোটা সংস্কারের প্রশ্ন নয়, এটা একটা পুরো আওয়ামী ফ্যাসিস্ট ব্যবস্থার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যাওয়ার মুহূর্ত। আমরা বুঝে গেছি, যে রাষ্ট্র ন্যায্য দাবি শুনতে চায় না, তা শুধু স্বৈরশাসনেই পরিচালিত হতে পারে। এই উপলব্ধিই আন্দোলনের গতিপথ বদলে দেয় এবং এটি রূপ নেয় জনগণের অধিকার আদায় এবং ফ্যাসিস্ট সরকার বিরোধী আন্দোলনে।
বাসস : আপনারা কীভাবে আপনাদের ক্যাম্পাসে আন্দোলন শুরু করেছিলেন এবং সবাইকে সংগঠিত করেছিলেন?
মেহেদী হাসান ইমরান : যেহেতু আমরা কলেজ পর্যায়ে আন্দোলন সংগ্রাম গড়ে তুলেছিলাম। সেহেতু আমি বলবো, আমরা আন্দোলনে যোগদান শুরু করেছিলেন ১৬ই জুলাই থেকে। ১৫ই জুলাই ছাত্রলীগের হামলার পর আমাদের অনেক ভাই এবং বোন খুবই গুরুতর আহত হয়ে ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি হয়, তবে ঢাকা মেডিক্যালের ভিতরে গিয়েও ছাত্রলীগ আহতদের উপরে আবার হামলা চালায়। যেগুলো ১৫ই জুলাই দিনভর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে যায়। একটি যৌক্তিক আন্দোলনের এই ভাবে হামলা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। তাই তার পরের দিন আমরা কলেজ পর্যায়ে আন্দোলন শুরু করি। তবে শুরুটা আমাদের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সাথে হলেও পরবর্তীতে আমরা নিজেরাই আমাদের কলেজ পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের নিয়ে আন্দোলন চালিয়ে যাই। এই ক্ষেত্রে আমাদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে থাকা কলেজের ফেইসবুক অ্যাকাউন্ট এবং পেজগুলোর মাধ্যমে আমারা আন্দোলনের ডাক ছড়িয়ে দেই।
বাসস: জুলাই আন্দোলনে আপনাদের সাথে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ও সাধারণ জনগণের অংশগ্রহণ কেমন ছিলো?
মেহেদী হাসান ইমরান : ২০২৪ সালের জুলাই মাসে ছাত্র আন্দোলন কোটাবিরোধী অবস্থান থেকে শুরু হয়ে দ্রুতই ফ্যাসিবাদ বিরোধী এক গণ-আন্দোলনে রূপ নেয়। এই আন্দোলন সাধারণ শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে নানা শ্রেণি-পেশার মানুষকে একত্রিত করে। তবে শুরুতে সাধারণ জনগণের উপস্থিতি না থাকলেও ১৫ই জুলাইয়ে ছাত্রলীগের হামলা এবং রংপুরে আবু সাইদ শহীদ হওয়ার পর থেকে সাধারণ জনগণ এই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করা শুরু করে।
বাসস : আপনারা কিভাবে ধারাবাহিকভাবে আন্দোলন করেছিলেন?
মেহেদী হাসান ইমরান : ১৬ই জুলাই থেকে আমরা প্রতিনিয়ত আন্দোলনের সাথে সংযুক্ত ছিলাম। ছাত্র সমন্বয়কদের কথামতো আমরা ধানমন্ডি সাইন্স ল্যাব মোড়ে আন্দোলন চলমান রাখি। এছাড়া আমাদের সাবেক শিক্ষার্থীরা যেমন : ১৭ ব্যাচ, ২১ ব্যাচ এবং ২২ ব্যাচের কিছু শিক্ষার্থীরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আন্দোলনে ঘটে যাওয়া সকল তথ্য চিত্র তুলে ধরে এবং সকলকে একত্রিত করে এবং অতঃপর আমরা আমাদের ক্যাম্পাসে একটি সমন্বয়ক এবং সহ-সমন্বয়কদের লিস্ট তৈরি করি। তাছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষার্থীদের সাথে আমাদের নিয়মিত যোগাযোগ হতো। যাদের মাধ্যমে আমরা বিভিন্ন রকম তথ্য এবং আন্দোলন সম্পর্কিত আপডেট পাই । ঠিক এই ভাবেই আমরা ধারাবাহিকতা অনুসরণ করে আন্দোলন করেছিলাম।
বাসস : জুলাই আন্দোলনে আপনাদের কলেজের শিক্ষকদের ভূমিকা কেমন ছিলো?
মেহেদী হাসান ইমরান : ঢাকা সিটি কলেজ বাংলাদেশের মধ্যে একটি স্বনামধন্য কলেজ। জুলাই আন্দোলনের প্রায় শুরু থেকে ঢাকা সিটি কলেজের শিক্ষার্থীরা অংশগ্রহণ করেছিল। তবে খুবই দুঃখের সাথে বলতে হয়, সাধারণ শিক্ষার্থীদের পাশে শিক্ষকরা প্রথম থেকে ছিল না। তবে আন্দোলনের মাঝামাঝি সময়ে ঢাকা সিটি কলেজর ২২ ব্যাচের একজন শিক্ষার্থীকে পুলিশ এরেস্ট করার পর তৎকালীন ভাইস প্রিন্সিপাল অধ্যাপক মোশারফ হোসেন চৌধুরী স্যার তাকে ছাড়াতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করে এবং তিনি তার নিজ অর্থায়নে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে খাবার এবং পানি দিয়ে সহযোগিতা করেন। এছাড়া আন্দোলনের শেষ পর্যায়ে কয়েকজন শিক্ষক আন্দোলনে যুক্ত হয়।
১৬ই জুলাই সাইন্স ল্যাবে সকাল ১২ টা নাগাদ ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের হামলা শুরু হয়, অতঃপর সাধারণ শিক্ষার্থীরা ঢাকা সিটি কলেজের আশ্রয়ের জন্য কলেজের গেটের সামনে গেলে তৎকালীন অধ্যক্ষ অধ্যাপক বেদারুদ্দিন আহমেদ গেট বন্ধ করে দেন।
বাসস: আপনারা যেখানে আন্দোলন করেছিলেন সেখানে পুলিশের ভূমিকা কেমন ছিলো বা তাদের ব্যবহার কেমন ছিলো?
মেহেদী হাসান ইমরান : জুলাইয়ে শুরু হওয়া ছাত্র-জনতার গণ-আন্দোলনে সরকারের দমননীতির অংশ হিসেবে পুলিশ বাহিনীর ভূমিকা ছিল অত্যন্ত আলোচিত ও সমালোচিত। একদিকে পুলিশের দায়িত্ব ছিল জননিরাপত্তা বজায় রাখা, সহিংসতা ঠেকানো এবং যান চলাচল সচল রাখা।
দায়িত্ব পালনের নামে তারা অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ, গ্রেপ্তার, মারধর এবং অনেকে বলেছে ‘রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস’ চালিয়েছে। এককথায় বলতে গেলে পুলিশের ভূমিকা ছাত্রলীগের পেটুয়া বাহিনীর মতো ছিল।
বাসস: আপনারা আন্দোলনের সময় অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজের সাথে কীভাবে সমন্বয় করতেন বা যোগাযোগ করতেন?
মেহেদী হাসান ইমরান : এইক্ষেত্রে বলতে চাই আমরা কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে সমন্বয় করিনি। আমরা শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু বড় ভাই থেকে প্রয়োজনীয় আপডেট নিয়ে বাকি সকল কার্যক্রম আমরা নিজেরাই পরিচালনা করি। ধানমন্ডি সাইন্স ল্যাবে ৫টি কলেজের সমন্বয় করেই আমরা আন্দোলন কার্যক্রম সংগঠিত করেছিলাম।
বাসস: আপনাদের সাথে আওয়ামী লীগ বা পুলিশের সাথে সংঘর্ষ কীভাবে হয়েছিলো ?
মেহেদী হাসান ইমরান : আমাদের সাথে সংঘর্ষ শুরু হয়েছিল ১৬ই জুলাই সকাল ১২ টা থেকে। শুরুতে হামলা করে ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগ। অতঃপর ছাত্রলীগের সাথে একত্রিত হয়ে পুলিশ টিআরসেল গ্যাস থেকে শুরু করে লাঠি চার্চ এবং শুধু শুধু সাধারণ ছাত্রদের আটক করা শুরু করে।
বাসস: আপনি ব্যক্তিগত বা পারিবারিক ভাবে কোন হুমকির মুখে ছিলেন?
মেহেদী হাসান ইমরান : এই ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত ভাবে ধানমন্ডি শাখা ছাত্রলীগের কিছু নেতা কর্মীদের থেকে হত্যার হুমকি পেলেও পারিবারিকভাবে কোন হুমকি ছিল না। তবে প্রত্যেক মা-বাবাই চায় তার সন্তান নিরাপদে থাকুক সেক্ষেত্রে আমার বাবা-মা ও আমাকে সতর্ক করেছিলেন এবং বলেছিলেন এই আন্দোলনে যুক্ত না হতে তবে আমি এটা অত্যন্ত স্বাভাবিক বিষয় বলে মনে করি। বাবা মা রা এরকমই বলেন।
বাসস : আপনি কীভাবে কেন্দ্রীয় সমন্বয়কদের সাথে যোগাযোগ করতেন?
মেহেদী হাসান ইমরান : কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক বলতে আমরা কারো সাথে তেমন যোগাযোগ করিনি। অনলাইনে বা যোগাযোগ মাধ্যমে আমরা যা দেখেছি এবং যে-রকম আপডেট পেয়েছি ওই অনুযায়ী আমরা আন্দোলন কার্যক্রম চলমান রেখেছিলাম।
বাসস : আপনাদের আন্দোলন এলাকায় কোন সহযোদ্ধা আহত বা শহীদ হয়েছিলো কিনা?
মেহেদী হাসান ইমরান : হ্যাঁ, জুলাই গণঅভ্যুত্থানে ঢাকা সিটি কলেজের শিক্ষার্থীদের অনেকেই গুরুতর আহত হয়েছে এবং আমি নিজেও। তবে নিহত হয়েছে কিনা এ ব্যাপারে আমার কাছে সঠিক কোন তথ্য নেই। আমরা আন্দোলনের পরবর্তী সময়ে খোঁজ নিয়ে দেখেছিলাম ঢাকা সিটি কলেজের কোন শিক্ষার্থী নিহত হয়নি।
বাসস : আন্দোলনের সময় যখন ইন্টারনেট বন্ধ ছিলো তখন আপনারা কীভাবে যোগাযোগ করেছিলেন?
মেহেদী হাসান ইমরান : এক্ষেত্রে আমরা যেখানে মোবাইল সিগন্যাল সীমিতভাবে পাওয়া যাচ্ছিল, সেখানে এসএমএস বা ব্লুটুথের মাধ্যমে একজন আরেকজনের কাছে মেসেজে যোগাযোগ করেছিলাম। তাছাড়া পূর্বে কিছু টেলিগ্রাম গ্রুপ এবং হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে আগাম নির্দেশনা দেওয়া ছিল। এগুলো অনুসরণ করা হয়েছিল। তাছাড়া আমরা কলেজ পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা নিজেরা এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় হেঁটে হেঁটে গিয়ে সবার কাছে খবর পৌঁছে দিয়েছিলাম।
আমরা মৃত্যুভয় উপেক্ষা করে এই খবরগুলো হেঁটে হেঁটে সবার কানে পৌঁছাতেছিলাম তখন নিজেদের মোবাইলের ওয়ালপেপারে নিজের একটি ছবি দিয়েছিলাম, যেখানে নিজেদের নাম, বাবার নাম মায়ের নাম, ঠিকানা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নাম এবং রক্তের গ্রুপ লেখা ছিল। যাতে করে আহত বা নিহত হলে পরিবারের কাছে সহজে খবর পৌঁছানো যায়।
বাসস: আপনি তো বিদেশে উচ্চশিক্ষার সুযোগ হারিয়ে ফেলেছিলেন তারপরও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আন্দোলনের সম্মুখ সারিতে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন আপনার ভেতরে এই আত্মত্যাগের প্রেরণা কীভাবে এলো?
মেহেদী হাসান ইমরান : ৪ আগস্ট সকাল থেকে সাইন্স ল্যাব সাধারণ শিক্ষার্থী এবং সাধারণ জনগণ আস্তে আস্তে জমায়েত হতে থাকে। আমি বাসা থেকে বের হই সকাল ১১টায়। ও হ্যাঁ একটি কথা না বললেই নয়, আমি আন্দোলনের সময় আমার বড় ফুফুর বাসায় ছিলাম। বাসা ছিল মহাখালী। প্রতিদিন মহাখালী থেকে সাইন্স ল্যাব সকালে আসতাম আর সন্ধ্যায় ফিরতাম। যেহেতু গাড়ি চলাচল বন্ধ ছিল তাই প্রতিদিন রিকশা করে তেজগাঁও নাখালপাড়ার ভিতর দিয়ে আসতাম। ৪ তারিখ সকালে তার ব্যতিক্রম কিছু ঘটেনি। নাখালপাড়ার ভিতর দিয়ে সাইন্সল্যাবে পৌঁছাই। সকাল ১২ টা থেকে জমায়াতে শুরু হয়। এরপর প্রায় বেলা ১টা নাগাদ জিগাতলা থেকে সাইন্স ল্যাব অভিমুখে ছাত্রলীগ হামলা শুরু করে। সাধারণ শিক্ষার্থী এবং জনগণের উপরে ছাত্রলীগ গুলি ছুঁড়ে এবং বোমা নিক্ষেপ করে। আমার কাছে ১৯ জুলাইয়ের পর থেকে অ্যান্ড্রয়েড ফোন ছিল না। কারণ আন্দোলনের সময় আমার ফোনটি পুলিশ নিয়ে গিয়েছিল। এরপর শুধু আমার কাছে একটি ছোট বাটন ফোন ছিল। আমার এখনো মনে আছে আমি যখন ধানমন্ডি ২ নাম্বার রোডে ‘ডমিনোজ পিৎজা’র বিল্ডিং এর সামনে এবং জিগাতলা থেকে ছাত্রলীগ গুলি এবং বোমা ছুঁড়ছিল ঠিক তখনই আমার বাবা আমাকে কল করেন। আমার বাবা বিদেশে থাকেন, আন্দোলনের সময় ইন্টারনেট না থাকায় আমার সাথে ওনার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় কিন্তু ৪ তারিখ তিনি সরাসরি আমকে কল করেন এবং আন্দোলনের মাঝখানে থেকেও আমি কলটি রিসিভ করি। তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন “বাবা, তুমি কোথায় আছো? জবাবে আমি বললাম আমি রাজপথে সংগ্রাম করছি। তারপর তিনি বললেন, ‘কেন গিয়েছো ওই জায়গায়?” জবাবে আমি বললাম আমার ভাইবোনদের এই ভাবে মেরে ফেলা হচ্ছে, আমি কি বাসায় বসে থাকবো, আমিও রাজপথে এসেছি জীবন দেওয়ার জন্য। এরপর উত্তরে আমার বাবা আমাকে একটি কথা বলেছে ‘ফি আমানিল্লাহ’। এরপর কল কেটে দিয়েছেন। ঠিক সেই মুহূর্ত থেকে কেন জানি না আমার আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার আগ্রহ আরো বেড়ে গিয়েছিল এবং অন্যরকম অনুভূতি নিয়ে সেদিন আমি ছাত্রলীগের আরো কাছে গিয়ে লড়াই করি বুক পেতে দেই যাতে আমাকে তারা গুলি করে, আমিও শহীদ হতে চাই। এখানে আমি আরে একটু কথা যুক্ত করি, আমি উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করার পর, দেশের বাহিরে পড়াশোনার জন্য যেতে চেয়েছিলাম এবং দেশ হিসেবে জাপান নির্বাচিত করি । জাপানি ভাষা শিখি। তারপর জাপানে যাওয়ার জন্য সকল প্রকার কার্যক্রম শেষ করি। পরিশ্রম করি এবং সকল কার্যক্রম সম্পন্ন হওয়ার পর জাপান থেকে আর সিইও আসে। তারপর আমি বাংলাদেশে জাপান দূতাবাসে ভিসার জন্য আবেদন করি কিন্তু দুর্ভাগ্য ক্রমে ৪ জুন তারিখে আমার জাপানের ভিসা বাংলাদেশ থেকে ক্যানসেল করে দেওয়া হয়। এটি আমার স্বপ্ন ছিল। জুলাই আন্দোলনের প্রতিদিন আমি চেয়েছিলাম শহীদের তালিকায় অংশগ্রহণ করতে। তাই বার বারই সবার সামনে গিয়ে পুলিশ এবং ছাত্রলীগের গুলির সামনে দাঁড়াতাম।
বাসস : কোন সংগঠন আপনাদের সাহায্য করেছিলো কিনা?
মেহেদী হাসান ইমরান : এই ক্ষেত্রে বলতে চাই কলেজ পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের, বিশেষ করে সাইন্স ল্যাবের পাঁচটি কলেজের সমন্বয়ে আমরা আন্দোলনের কার্যক্রম পরিচালনা করি। আলাদা কোন সংগঠন এক্ষেত্রে আমাদের সহযোগিতা করেনি। তাছাড়া আমরা কারো কাছে সহযোগিতা চাইনি। কারণ আমাদের মধ্যে একতা ছিল।
নিজেদের প্রতি বিশ্বাস ছিল আমরা পারবো, আমরা করে দেখাবো।
বাসস : বর্তমান তরুণ প্রজন্মের কাছে আপনার কী প্রত্যাশা ?
মেহেদী হাসান ইমরান : ফ্যাসিবাদ হলো একটি দমনমূলক রাজনৈতিক ব্যবস্থা যেখানে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর হাতে কেন্দ্রীভূত থাকে, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হরণ করা হয় এবং ভয়ভীতির মাধ্যমে জনগণকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। যখন এই শাসনের অবসান ঘটে, তখন একটি নতুন রাজনৈতিক পরিবেশের সূচনা হয় নতুন আশার, সম্ভাবনার এবং দায়িত্বের প্রতীক হয়ে ওঠে। এই নতুন প্রেক্ষাপটে তরুণ সমাজকে দেখা হয় ভবিষ্যতের চালিকাশক্তি হিসেবে। তাদের হাতেই গঠিত হবে ন্যায়ভিত্তিক ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ।
ফ্যাসিবাদের পতনের পর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হলো গণতন্ত্রকে পুনরুদ্ধার ও রক্ষা করা। তরুণদের প্রতি প্রত্যাশা থাকবে তারা যেন মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, আইনের শাসন এবং ভোটাধিকারের পক্ষে সোচ্চার থাকেন।
ভোটাধিকার, মতের স্বাধীনতা এবং সাংবিধানিক অধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে তরুণদের ভূমিকাই হবে নির্ধারক।
ফ্যাসিবাদ সাধারণত অন্ধ আনুগত্য ও তথ্য বিকৃতির ওপর নির্ভর করে। তরুণ সমাজের উচিত হবে যুক্তিনির্ভর চিন্তার চর্চা। মিথ্যা প্রচারণা থেকে দূরে থাকা। সত্য যাচাই করার সক্ষমতা অর্জন করা। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সামাজিক মিডিয়া ও সাংস্কৃতিক পরিসরে তারা যেন যুক্তিবাদী ও বিজ্ঞানমনস্ক ধারা তৈরি করে।
ফ্যাসিবাদ বিভক্তি ও ঘৃণার রাজনীতি করে। নতুন বাংলাদেশের তরুণদের কাজ হবে ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধা রাখা। ধর্ম, ভাষা, জাতি বা শ্রেণিভেদে বিভাজন না করা। একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গড়ে তোলা। তারা যেন ঘৃণার বদলে মানবিকতা ও সংলাপের পথে এগিয়ে যায়।
ফ্যাসিবাদের আরেকটি পরিচায়ক ছিল প্রশাসনিক দুর্নীতি ও জবাবদিহিতার অভাব। তরুণদের নৈতিক অবস্থান নিতে হবে। ঘুষ ও অনিয়মের বিরুদ্ধে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠায়। প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার থেকে।
বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে জলবায়ু পরিবর্তন একটি বড় চ্যালেঞ্জ। তরুণ সমাজের কাছে প্রত্যাশা থাকবে টেকসই উন্নয়ন ও পরিবেশবান্ধব জীবনচর্চা। প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনের মাধ্যমে সমাজ পরিবর্তন। ডিজিটাল দক্ষতা ব্যবহার করে সামাজিক সমস্যার সমাধান করা।
ফ্যাসিবাদের সময় গুম, খুন,দমন-পীড়ন ইত্যাদি ব্যাপক হারে ঘটেছে। তরুণদের পক্ষ থেকে দাবি আসা উচিত সকল অপরাধের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা। ইতিহাসকে বিকৃত না করে সত্য উদ্ঘাটনে সচেষ্ট হওয়া।
বিচারহীনতার সংস্কৃতির স্থায়ী অবসান ঘটানো।
তরুণদের শুধু ভোট দেওয়া নয়, নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রেও এগিয়ে আসা জরুরি। প্রত্যাশা থাকবে আদর্শভিত্তিক নেতৃত্ব গড়ে তোলা- ব্যক্তি নয়, নীতি ও দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রাধান্য দেওয়া। নতুন রাজনৈতিক মূল্যবোধের চর্চা করা, যেখানে সহনশীলতা, জবাবদিহিতা ও নাগরিকদের অংশগ্রহণ থাকবে।