ইসমে আজম
ঢাকা, ২০ জুলাই, ২০২৫ (বাসস) : বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল (জেসিডি)-এর যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মানসুরা আলম দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের রাজনৈতিক আন্দোলনের অগ্রভাগে রয়েছেন। রাজপথে তার অবিচল উপস্থিতি এবং গণতান্ত্রিক অধিকার ও ন্যায় বিচারের পক্ষে লড়াই তাকে একটি পরিচিত মুখে পরিণত করেছে।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানেও তিনি ছিলেন রাজপথে। আন্দোলনের সময় সবকিছু ভুলে গিয়ে মিশে গিয়েছিলেন সাধারণ জনতার কাতারে, অংশগ্রহণ করেছিলেন সকল কর্মসূচিতে। বিভিন্নভাবে অবদান রেখেছিলেন আন্দোলনের কঠিন মুহুর্তগুলোতে। আন্দোলনে আহতদের খোঁজ খবর জানতে ১৯ জুলাই বিকেলে ঢাকা মেডিকেলে গিয়ে চোখের পানি ধরে রাখতে পারেননি বলে জানান মানসুরা আলম। সম্প্রতি বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা’কে (বাসস) দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি জুলাই গণঅভ্যুত্থানে একজন নারী হিসেবে তার অবদান ও অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেন। সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছেন বাসসের প্রতিবেদক ইসমে আজম।
বাসস : আমরা দেখেছি রাজপথে আপনার একটা দীর্ঘদিনের লড়াই-সংগ্রামের ইতিহাস আছে। গত বছর ৫ই জুন যখন আনুষ্ঠানিকভাবে শিক্ষার্থীরা কোটার বিরুদ্ধে রাজপথে নেমে আসে, তখন আপনি কী ভেবেছিলেন এই আন্দোলন সম্পর্কে?
মানসুরা আলম : আমরা যারা ছাত্রদল এবং বিএনপির রাজনীতির সাথে জড়িত রাজপথে আমাদের লড়াই-সংগ্রামের ইতিহাস অনেক পুরোনো। ২০২৪ সালের ৫ই জুন হাইকোর্ট কোটা পুনর্বহাল করে রায় দিলে ছাত্রসমাজ ফুঁসে ওঠে এবং তারা আন্দোলনের পথে নামে। স্বাভাবিকভাবে আমি যেহেতু একটা ছাত্রসংগঠনের সাথে যুক্ত ছিলাম সেহেতু শিক্ষার্থীদের সাথে আন্দোলনে যুক্ত হই। শিক্ষার্থীদের দাবি-দাওয়ার সাথে একাত্মতা পোষণ করেছিলাম। ফ্যাসিস্ট হাসিনা আমাদের ওপর যে অত্যাচার নির্যাতন চালিয়েছিল এই আন্দোলনকে তার প্রতিশোধ হিসেবেই মনে হয়েছিল।
দীর্ঘদিন ধরে একটা ট্যাবু তৈরি হয়েছিল যে কোনো আন্দোলনের সাথে ছাত্রদল-বিএনপির কেউ যুক্ত হলে সেই আন্দোলনটি সরকার বিরোধী আন্দোলন হয়ে যায়। সে কারণে শুরুর দিকে শিক্ষার্থীরা আমাদের সরাসরি অংশগ্রহণে দ্বিমত পোষণ করলেও ধীরে ধীরে আমরা এই আন্দোলনের সম্মুখ যোদ্ধায় পরিণত হই। তবে প্রথমদিকে আন্দোলনের গতিপথ যাতে না বদলায় এবং আন্দোলনটি যাতে পূর্ণতা লাভ করে, সে জন্য আমরা আমাদের অবস্থান থেকে সাধারণ শিক্ষার্থী হিসেবে এই আন্দোলনে যোগদান করি। আমাদের রাজনৈতিক পরিচয়ে বা আমরা ব্যানার হিসেবে সেখানে যাইনি।
তবে আন্দোলনটি যেহেতু চাকরির কোটা কেন্দ্রিক ছিল, সে কারণে সকল শ্রেণির শিক্ষার্থী নিজেদের অধিকার আদায়ের জন্য স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাজপথে নেমেছিল।
বাসস : আপনি সরাসরি আন্দোলনে যুক্ত হয়েছিলেন কবে থেকে?
মানসুরা আলম : প্রথম থেকে এই আন্দোলনে আমি সরাসরি যুক্ত ছিলাম। তবে কখনো ফোকাসে আসিনি। কারণ স্বৈরাচার হাসিনা আমাদের নাম দিয়ে আন্দোলনকে অন্যদিকে প্রবাহিত করতে পারে এমনটা ভেবে সরাসরি ফোকাসে আসিনি। তবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রতিটি প্রোগ্রামে আমি অংশগ্রহণ করেছিলাম। আমরা চেষ্টা করেছি আমাদের যারা সাধারণ শিক্ষার্থী তারা যাতে অন্তত একদম সামনের দিকে থাকে।
বাসস : এই আন্দোলনের শুরু থেকে আমরা দেখেছি যে নারী আন্দোলনকারীদের উপস্থিতি ছিল উল্লেখযোগ্য। এক্ষেত্রে আপনার কোনো ভূমিকা ছিল কিনা? থাকলে কীভাবে কাজ করছিলেন ওই সময়টাতে?
মানসুরা আলম : চাকরিতে নারী শিক্ষার্থীদের কোটা থাকা সত্ত্বেও তারা রাজপথে নেমে এসেছিল। তারা জানত এই আন্দোলন সফল হলে তাদের আর কোটা থাকবে না, তারপরও তারা তা উপেক্ষা করে আন্দোলনে যোগ দিয়েছিল। নারী-পুরুষ সবাই একসাথে মিলে আন্দোলন করেছে বৈষম্যের বিরুদ্ধে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে। যা একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। ইতিহাসে এরকম ঘটনা বিরল।
ছাত্রদলের রাজনীতিতে যুক্ত থাকার কারণে এই আন্দোলনে আমার সীমাবদ্ধতাগুলো আগেই উল্লেখ করেছি। তারপরও আমাদের জায়গা থেকে আমরা আন্দোলনকারী নারী শিক্ষার্থী যারা ছিল, তাদের সাথে বিভিন্ন সময় যোগাযোগ করে গেছি, তারা কী অবস্থায় আছে এবং আমরা কীভাবে তাদেরকে হেল্প করতে পারি ইত্যাদি বিষয়ে আমি বেশ কয়েকজনের সাথে যোগাযোগ রেখেছিলাম।
১৫ই জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগ হামলা চালালে সে সময় নারী শিক্ষার্থীসহ অনেকেই আহত হয়। তাদের অনেককে ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। ওখানে গিয়ে আমি সকল নারী শিক্ষার্থীদের খোঁজ খবর নিয়েছিলাম। অনেক শিক্ষার্থী হলে যেতে পারছিল না, আমরা ব্যবস্থা করে দিয়েছিলাম। তখন যেভাবে সাপোর্ট দেওয়া দরকার ছিল সেভাবেই আমি এবং আমার সংগঠন শিক্ষার্থীদের পাশে ছিলাম।
বাসস : ১৪ জুলাই রাতের অভিজ্ঞতা যদি বর্ণনা করতেন?
মানসুরা আলম : ১৪ জুলাই রাতে আমি আমার নিজ বাসাতেই অবস্থান করছিলাম। পরে শুনতে পাই যে মেয়েরা স্লোগান দিয়ে হল থেকে বেরিয়ে আসছে। এটা শোনার পর পরই আমি ক্যাম্পাসে চলে আসি। সবাই স্লোগান দিচ্ছিল ‘তুমি কে? আমি কে? রাজাকার-রাজাকার।’ আবার আমাদের ছাত্রদলের ছেলেমেয়েরা স্লোগান দিচ্ছিল ‘তুমি কে? আমি কে? রাজাকার-রাজাকার; কে বলেছে? কে বলেছে? স্বৈরাচার-স্বৈরাচার।’ এই সময়টা ছিল এক ধরনের অদ্ভুত উন্মাদনা!
আমরা যারা পতিত ফ্যাসিস্ট হাসিনার বিরুদ্ধে লড়াই সংগ্রাম করেছি, তাদের জন্য এই মুহুর্তটা ছিল স্বপ্ন সত্যি হওয়ার মতো। পরে সকল শিক্ষার্থী হলে ফিরে যাওয়ার পরও আমি ক্যাম্পাসে অবস্থান করেছিলাম। রাজনীতির কারণে আসলে আমার জীবনে দিন-রাত ছিল না। সবকিছুতে অভ্যস্থ হয়ে গিয়েছিলাম।
বাসস : ১৫ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগ শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করেছিল, সেদিনের অভিজ্ঞতা নিয়ে কিছু বলুন।
মানসুরা আলম : ক্যাম্পাসে মারামারি হচ্ছে এটা শোনার পর আমি ক্যাম্পাসে আসি। যেহেতু ওইরাতে বাইরে ছিলাম, সে কারণে সকালে বাসায় অবস্থান করছিলাম। তবে বাসা থেকে ক্যাম্পাস কাছে হওয়ায় হামলার খবর শুনে দ্রুত ক্যাম্পাসে আসি। এরপর আহত শিক্ষার্থীদের খোঁজ খবর নেওয়ার জন্য ঢাকা মেডিকেল, ইসলামী ব্যাংক হসপিটালসহ বেশ কয়েকটি মেডিকেল পরিদর্শন করেছিলাম সেদিন।
ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসী বাহিনী ছাত্রলীগ, যুবলীগ এবং পুলিশবাহিনী প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলন, অধিকার আদায়ের আন্দোলনে হামলা করতো। এরপর ভুক্তোভোগীরা চিকিৎসাসেবা নেওয়ার জন্য হাসপাতালে গেলে সেখানেও তারা হামলা চালাতো। এদিনও একই ঘটনা ঘটেছিল। ক্যাম্পাসে হামলার পরও তারা মেডিকেলের জরুরি বিভাগে হামলা চালায়।
কয়েকটি হাসপাতাল ঘুরে দেখেছিলাম গুরুতর আঘাতের কারণে যে যেভাবে পারে হাসপাতালের মেঝেতে শুয়ে আছে। মেয়েরা কান্নাকাটি করে বলছিল যে তারা হলে ঢুকতে পারবে না। কীভাবে হলে ঢুকবে, সেটা নিয়ে ভয় পাচ্ছিল। ওই সময়ে আমি তাদেরকে অভয় দিয়েছিলাম। তাদের পাশে থাকার কথা জানিয়েছিলাম। তাদেরকে বলেছিলাম কারো হলে থাকার সমস্যা হলে আমাকে জানাতে।
বাসস : ১৬ এবং ১৭ জুলাই কি করেছিলেন?
মানসুরা আলম : ১৬ জুলাই শহীদ মিনারে প্রোগ্রাম ছিল। ওই দিন আবু সাঈদ ও ওয়াসিমসহ ৬ জন শহীদ হয়েছিলেন। আমি শহীদ মিনারে অবস্থান করছিলাম। চারপাশে তখন থমথমে অবস্থা বিরাজ করছিল। পেটুয়া ছাত্রলীগ বাহিনী তখন টিএসসির দিকে অবস্থান করছিল। এসময় কিছু ছেলে এসে আমার সাথে পরিচিত হয়েছিল। তারা পরিচয় দিল যে তাদেরকে ইশরাক ভাই পাঠিয়েছে কর্মসূচি সফল করার জন্য। তাদের সাথে পরিচয় হওয়ার পর উদ্দীপনা আরও বেড়ে গিয়েছিল। সেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ আমাদের ছাত্রদলের আশেপাশের সকল ইউনিট শহীদ মিনারে চলে এসেছিল।
এসময় একটা ছেলে এসে আমাকে বলে যে ‘আপু, আপনিতো ছাত্রদলের পরিচিত মুখ। তাই সবার সামনে না থেকে একটু পিছনে অথবা আড়ালে থাকলে ভালো হয়।’
তখন আমি ওই ছেলের উপর ক্ষিপ্ত হয়ে বলেছিলাম যে তুমি আমাকে এটা বলতে পারো না। কারণ ইতোমধ্যে ছাত্রদলের একজন শহীদ হয়েছে। ওয়াসিমের মৃত্যুর খবর ততক্ষণে চলে এসেছিল।
আমি বলেছিলাম, আমি দেখতে পাচ্ছি যে আশেপাশে সবই আমাদের লোকজন, ছাত্রদলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীরা এখানে উপস্থিত। ছাত্রদলের একজন শহীদ হয়েছে, এরপরও আমাকে কেন বলা হবে যে আমি এখানে থাকতে পারবো না, মানে এখনো কিসের ট্যাগ নিয়ে ভয়?
এরপর আমরা শহীদ মিনারে সন্ধ্যা পর্যন্ত অবস্থান করেছিলাম। পরে একটা মিছিল শুরু হওয়ার কথা ছিল যেটি দোয়েল চত্বর দিয়ে রাজু ভাস্কর্যে প্রবেশ করবে। কিন্তু মিছিলটি শুরু হওয়ার পর দোয়েল চত্বর এসে থেমে গেল। আমরা সবাই চাচ্ছিলাম সব বাধা পেরিয়ে টিএসসিতে অবস্থান নিতে। তবে যারা লিড দিচ্ছিল তারা সিন্ধান্ত নিতে পারছিল না। এ কারণে তখন আমরা সকলে অনেক হতাশ হয়ে পড়েছিলাম। তখন অনেকেই রাগ হয়ে বলেছিল যে 'সমস্যা কী ভাই? কেন আপনারা আগাচ্ছেন না? কেন এতগুলো মানুষের জীবন আপনারা ঝুঁকিতে ফেলাচ্ছেন? আমরা টিএসসি গিয়ে কিছু একটা করবো নতুবা এখান থেকে পিছিয়ে যাব। আপনারা দাঁড়িয়ে কেন আছেন? মানে কী করতে চাচ্ছেন?’
তবে এসব ডামাডোলের মধ্যে এক সময় ঘোষণা আসলো যে আজকের কর্মসূচি এখানেই শেষ।
তারপর যেটা হয়েছে সেটা হচ্ছে, শহীদ মিনারে অবস্থান নেওয়া শিক্ষার্থীরা যখন নিজ নিজ গন্তব্যে ফিরছিল তখন সন্ত্রাসী ছাত্রলীগ বিভিন্ন মোড়ে অবস্থান নিয়ে শিক্ষার্থীদের তল্লাশি করে হামলা চালায়। অনেকেই সেদিন এই অযাচিত হামলার শিকার হয়েছিল।
মিছিল শেষ হওয়ার পর আমি একটি রিকশা নিয়ে বাসায় ফিরেছিলাম। তবে রাতে হল থেকে ছাত্রলীগ বের করে দেওয়ার খবর শুনে আবারও ক্যাম্পাসে এসেছিলাম। আমি হলের গ্রুপগুলোতে আপডে নিচ্ছিলাম। তখন সবাই ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করার জন্য লিখিত নিচ্ছিল, যা নিয়ে আমি আমাদের সংগঠনের শীর্ষ নেতাদের সাথে আলোচনা করি। এ ব্যপারে আমাদেরকে উপর মহল থেকে জানানো হয়েছিল যে এটা কোনো সমস্যা না। ওদের সাথে আমাদের আলোচনা হয়েছে যে এটা আসলে লোক দেখানোর ম্যান্ডেট হিসেবে থাকবে। শিক্ষার্থীরা যেভাবে চাচ্ছে আন্দোলনের স্বার্থে, আন্দোলনটাকে এগিয়ে নেয়ার স্বার্থে, আমাদেরকে এখন তা মেনে নিতে হবে।
এরপর এক এক করে হল থেকে ছাত্রলীগকে বের করে দেওয়া শুরু হল। নানা উত্তেজনার সাথে ওই রাতে আমি ক্যাম্পাসে অবস্থান করছিলাম।
১৭ তারিখ গায়েবানা জানাজা নামাজ ও কফিন মিছিল ছিল। ওইদিন সকাল ১১ টার দিকে এসে দেখি পুলিশ টিয়ারগ্যাস ছুড়ে ছাত্রদের ছত্রভঙ্গ করে দিয়েছে। পুরো ক্যাম্পাস তখন ধোঁয়াচ্ছন্ন। এদিকে হল ছাড়ার ঘোষণা দেওয়ায় শিক্ষার্থীরা হল থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। যখন কফিন মিছিল নিয়ে আমরা রাজু ভাস্কর্যের দিকে যাচ্ছিলাম তখন পুলিশ আমাদের ওপর গুলি ছুঁড়ে। এসময় আমরা সবাই দিশেহারা হয়ে পড়ি। সবাই বিভিন্ন দিকে দৌঁড়ে পালাই। আমি তখন গিয়াস উদ্দিন আবাসিক কোয়ার্টারে অবস্থান নিই। সেখানে আমি কয়েক ঘন্টা অবস্থান করছিলাম। কিন্তু পরিস্থিতি এতোটাই খারাপ ছিল যে সংগঠিত হওয়ার মতো অবস্থা একদমই ছিল না। ১৭ তারিখ রাতটা খুবই হতাশার মধ্যে কেটেছিল।
বাসস : ১৭ জুলাই থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল এবং ১৮ তারিখ বিকেল থেকে নেটওয়ার্ক বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। এই সময়টাতে কিভাবে আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন?
মানসুরা আলম : ১৭ জুলাই ক্যাম্পাস বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর ১৮ তারিখ প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমে আসে। তাদের কারণে আন্দোলন আর একটি নতুন মোড় পায়। ১৮ তারিখ আমি শহরের বিভিন্ন পয়েন্ট পর্যবেক্ষণ করেছিলাম এবং বেশ কয়েকটি জায়গায় পিকেটিং করেছিলাম। পরে বিকেলের দিকে যখন নেট স্লো করে দেয় এবং রাতে যখন পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়া হয় তখন আমি এসএমএসের মাধ্যমে সবাইকে সংগঠিত হওয়ার আহ্বান জানাই।
নেটওয়ার্ক বন্ধের দিনগুলোতে টিভি চ্যানেলগুলো এমন নিউজ প্রচার করছিল যা ছিল খুবই হতাশার ছিল। চারদিকে নারকীয় গণহত্যা চলছিল অথচ টিভি চ্যানেলগুলো এসবের কিছুই প্রকাশ করেনি।
১৯ এবং ২০ জুলাই সবচেয়ে বেশি হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছিল ঢাকায়। ১৯ জুলাই যাত্রাবাড়ীতে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। এতে অনেক লোক প্রাণ হারায়। ঢাকা মেডিকেলে অনেকের লাশ পড়ে আছে শুনে শত বাধা সত্বেও আমি ঢাকা মেডিকেল যাই। মেডিকেলে গিয়ে আর চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি। এতো বিভৎস হত্যাকাণ্ড চালিয়েছিলো পতিত ফ্যাসিস্ট স্বৈরাচার, যা বলার মত নয়।
আমি পরিস্থিতি দেখার জন্য পরের কয়েকদিন রেগুলার মেডিকেলে গিয়েছিলাম । তখন আমার মনে হচ্ছিল আমি সেখানে গিয়ে কাউকে একটু হেল্প করি, কারো কোনো কিছু দরকার আছে কিনা, আমি সেটা দেখি।
আমি ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করি যে এতোগুলা মানুষ জীবন দিয়েছে, তাদের জীবন বৃথা যেতে পারে না। ফ্যাস্টিস্ট হাসিনাকে এর মূল্য দিতে হবে। তাই আমি আমার আশেপাশের সবাইকে ইনফ্লুয়েন্স করার চেষ্টা করি যে এতগুলো লাশের সাথে আমরা বেইমানি করতে পারি না। আমাদেরকে আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে। তখন বলেছিলাম, আসলে এতো মানুষ মারা যাওয়ার পর এই সরকারের থাকার কোনো বৈধতা নেই। এই সময় আমি এক দফার কথা সবাইকে বলেছিলাম।
বাসস : নেটওয়ার্ক ফিরে আসার পরের দিনগুলোতে আপনার অভিজ্ঞতা কেমন ছিল?
মানসুরা আলম : এর পরে তো বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দেয়াল লিখনসহ নানা ধরনের প্রোগ্রাম ছিল এবং শিক্ষকদেরও তখন বিভিন্ন কর্মসূচি ছিল। আমি সেই কর্মসূচিগুলোতে অংশগ্রহণ করেছিলাম। এই সময়টাতে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে কিভাবে প্রবেশ করা যায় এসব নিয়ে ভেবেছিলাম। নিহতের পরিবারদের সাথে যোগাযোগ রাখছিলাম এবং আহত যারা ছিল তাদের সাথে যোগাযোগ করে চিকিৎসার খোঁজ খবর নিচ্ছিলাম।
বাসস : ১ থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত কী কী করছিলেন?
মানসুরা আলম : ১৬ তারিখে যখন ৬ জন শহীদ হয়েছিল আমি তখন থেকেই এক দফার কথা ভাবছিলাম। আমি বলেছিলাম আমাদেরকে অবশ্যই এক দফার দিকে আগাতে হবে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ঘোষণা দিয়েছিলেন যে সব ধরনের রাজনৈতিক হিসাব ভুলে আমাদেরকে দেশের মানুষের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আন্দোলন করে যেতে হবে এবং হাসিনার পতন না হওয়া পর্যন্ত আমাদেরকে সেটা চালিয়ে যেতে হবে। আমরা এমন স্পিরিটের মধ্যে ছিলাম যে আন্দোলনের যেকোনো পরিস্থিতিতে আমাদেরকে শতভাগ সেটার সাথে থাকতে হবে। এবং মাঠে থাকার পাশাপাশি মানুষকে সহায়তা করা, মানুষের পাশে থাকা— বিশেষ যারা আহত ছিল তাদের পাশে আমরা ছিলাম এবং এখনো আছি।
৩ জুলাই যখন সবাই শহীদ মিনারে অবস্থান করেছিল। তখন একদ দফা ঘোষণার আগেই উপস্থিত জনতা ‘এক দফা চাই!’ বলে স্লোগান দেওয়া শুরু করেছিল। পরবর্তীতে নাহিদ একদফা ঘোষণা করেছিল। তখন আমি শহীদ মিনারেই অবস্থান করছিলাম। এর পরের দিন অর্থাৎ ৪ তারিখে প্রথমে দুই দিনের কর্মসূচি একসাথে ঘোষণা করা হয়েছিল। কিন্তু পরে তা সংশোধন করে ৫ তারিখে মার্চ টু ঢাকা ঘোষণা করা হয়। বিএনপির সকল সংগঠনকে এই কর্মসূচি সফল করার জন্য কঠিন নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। ৪ তারিখ রাতে সারারাত ঘুমাতে পারিনি। মনের মধ্যে একটা ভয় কাজ করছিল। নানা উৎকন্ঠার মধ্যে পার করি এই ঐতিহাসিক রাত।
৪ তারিখ ভোরের দিকে ঘুমিয়ে ৫ তারিখ সকাল ৯ টার দিকে ঘুম থেকে উঠেছিলাম। এরপর শহীদ মিনারের উদ্দেশ্যে বের হয়ে জানতে পারলাম আমাদের ছাত্রদলের অনেক নেতাকর্মী ঢাকা মেডিকেলের ভিতরে আটকা পড়েছে এবং ওখানে একজনের মৃত্যু হয়েছে।
এই ঘটনার কিছুক্ষণ পরে আরও জানতে পারলাম সম্ভবত হাসিনা আর থাকবে না, তাকে পালিয়ে যেতে হবে। এমন সময় আমার একজন ঘনিষ্ঠ বড় আপু ফোন দিয়ে আবেগঘন আবস্থায় কান্না করতে করতে বলছিল যে আমাদের এতোদিনের আন্দোলন অতঃপর সফল হতে যাচ্ছে। শেখ হাসিনা পালিয়ে যাচ্ছে। তখন আসলে কি রিয়েক্ট করবো বুঝে উঠতে পারছিলাম না।
এই সময় আমি কাঁটাবনের দিকে অবস্থান করছিলাম। ওই আপুর সাথে কথা বলে আমি শাহবাগের দিকে যাচ্ছিলাম এবং সবাইকে বলছিলাম যে শেখ হাসিনা পালিয়ে গেছে। কিন্তু তখন আমার কথা কেউ বিশ্বাস করছিল না। কারণ তখনও নেটওয়ার্ক বন্ধ ছিল, সে কারণে সবাই খবরটা পায়নি।
রাস্তায় মানুষ ভাবছে যে আমরা মজা করছি, অনেকে ভাবছে যে হয়তো সত্যি হতে পারে। এর কিছুক্ষণ পর ইন্টারনেট আসলো। তখন আমরা শেখ হাসিনার পালিয়ে যাওয়ার ভিডিওটি দেখলাম। এই সময়ের অনুভূতিটা আসলে ভাষায় প্রকাশ করার মতো না।
বাসস : এই আন্দোলনে নারীদের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল। তো ৫ আগস্ট পরবর্তী বাংলাদেশে রাজনীতিতে নারীদের অংশগ্রহণ নিয়ে আপনার প্রত্যাশা কেমন?
মানসুরা আলম : আন্দোলনে নারীদের অংশগ্রহণের কোনো বিষয় নিয়ে আসলে আমার বাড়িয়ে বলার কিছু নেই। এই আন্দোলনে নারী শিক্ষার্থীরা তাদেরকে অনেকভাবেই প্রমাণ করেছেন। তারা অনেক বেশি সাহসিকতার উদাহরণ দেখিয়েছেন।
কিন্তু বর্তমান রাজনীতিতে মেয়েদের অংশগ্রহণ এবং নারীদের যে স্পেস দেওয়া নিয়ে আমরা কথা বলছি তা নানা সংকটের মধ্যে রয়েছে। রাজনীতিতে নারীদের অংশগ্রহণ নিয়ে যে প্রপাগান্ডা এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় তাদেরকে আক্রমণ করা— এগুলো যদি না থামে, তাহলে মেয়েদের জন্য যে স্পেস তৈরির কথা বলছি তা শুধু আলোচনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে। আমার প্রত্যাশা হচ্ছে এই সীমাবদ্ধতাগুলো কাটিয়ে সমাজে নারীদের জন্য একটি সুস্থ ও সুন্দর পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে, যেখানে নারীরা নিরাপদে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারবেন।