এ.এস.এম.নাসিম
নোয়াখালী, ২৬ জুলাই ২০২৫ (বাসস): ২৬ জুলাই ২০২৪। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলন তখন ক্রমশ: গণঅভ্যুত্থানে রূপ নিচ্ছে। এই দিনে সকাল ৬টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত নোয়াখালীতে কারফিউ শিথিল করে জেলা প্রশাসন।
২৫ জুলাই ২০২৪ তারিখ দিবাগত রাতে সেসময়কার নোয়াখালীর জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট দেওয়ান মাহবুবুর রহমান গণমাধ্যমকে কারফিউ শিথিল করার বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
তবে কারফিউ শিথিল করা হলেও শহরের গুরুত্বপূর্ণ সড়কগুলোতে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ করা হয়। জনমনে আতঙ্ক ও ভয় তৈরির জন্যই স্বৈরাচার হাসিনার সরকার এ পদ্ধতি বেছে নেয়। শহর জুড়ে চলে সেনাবাহিনীর টহল। কারফিউ শিথিলের ফলে নোয়াখালীর সর্বস্তরের মানুষের কাছে সাময়িক স্বস্তি মিললেও সবাই স্বৈরাচার হাসিনার পতনের দিনক্ষণ গুণতে থাকে।
এদিন সারাদেশে ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় ছাত্রদের অভ্যন্তরীণ যোগাযোগে কিছুটা ভাটা পড়ে। মুঠোফোনের মাধ্যমে একে অপরকে কল করেই ঢাকাসহ সারাদেশের খোঁজখবর নিতে থাকে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল, বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির, ছাত্র অধিকার পরিষদসহ অন্যান্য ফ্যাসিবাদ বিরোধী ছাত্র সংগঠনগুলোকে একত্রিত করার কাজ করতে থাকেন। যে কোন মূল্যে খুনি হাসিনাকে তার গদি থেকে অপসারণ করতেই হবে এই মূলমন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে ফ্যাসিবাদ বিরোধী ছাত্র ঐক্য গঠন করা হয়। নিরাপত্তার স্বার্থে সে ঐক্যের কথা কাউকে না জানিয়েই বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে তারা আন্দোলন অব্যাহত রাখেন।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক আরিফুল ইসলাম, মেহেদী হাসান সীমান্ত, ফরহাদুল ইসলাম, বনি ইয়ামিন, ইখতিয়ার হোসেন আয়াত, হাসিবুল হাসান, প্রীতিসহ অন্যান্য সমন্বয়করা মিলেই বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সাথে যোগাযোগ বাড়াতে থাকেন।
এদিন দুপুর তিনটায় নোয়াখালীর মাইজদী প্রধান সড়কে ছাত্র জনতা অবস্থান নিয়ে ঘণ্টাব্যাপী বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেন। সড়কের এক পাশ বন্ধ করে তাদের এই বিক্ষোভ কর্মসূচি অনুষ্ঠিত হয়।
বিক্ষোভ কর্মসূচিতে ছাত্রনেতা মেহেদী হাসান সীমান্তের 'তুমি কে আমি কে রাজাকার রাজাকার, কে বলেছে কে বলেছে স্বৈরাচার স্বৈরাচার', 'টুঙ্গিপাড়ার গোপালী আর কতকাল জ্বালাবি', 'দফা এক দাবি এক, খুনি হাসিনার পদত্যাগ', 'আমার ভাই মরল কেন, খুনি হাসিনা জবাব দে' সহ আরো অনেক জ্বালাময়ী স্লোগান আন্দোলনকে আরো বেগবান করে।
কর্মসূচি স্থলের চারপাশে নোয়াখালীর সেসময়কার পুলিশ সুপার মো. আসাদুজ্জামান এর নেতৃত্বে শতাধিক পুলিশ সদস্য অবস্থান নেয়। যদিও পুলিশের পক্ষ থেকে সাধারণ শিক্ষার্থীদের সাথে আলোচনা সাপেক্ষে সেদিন কোনো বাধা দেয়া হয়নি। তবে নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে শহরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মোড় এবং শহর থেকে বের হওয়ার পথসমূহে অবস্থান নেয় এবং আন্দোলনে আসা শিক্ষার্থীদের নানা ধরনের হয়রানি করে।
জানতে চাইলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক ও নোয়াখালী সরকারি কলেজের ছাত্রনেতা ইখতিয়ার হোসেন আয়াত বাসসকে বলেন, ‘সেসময় জীবনের ঝুঁকি নিয়েই গণঅভ্যুত্থানে অংশ নিয়েছিলাম। আমরা খালি হাতেই প্রতিবাদ করেছিলাম। কিন্তু আমাদের মনোবলের কোন ঘাটতি ছিল না। দিনভর আন্দোলন করলেও রাতভর পুলিশ ও সশস্ত্র ছাত্রলীগ ও যুবলীগ এর গুণ্ডাদের ভয়ে পালিয়ে থাকতে হয়েছে। নিজের বাসায় ঘুমাতে পারিনি। প্রতিদিন শহরে আন্দোলন শেষে আমাদের ভাই-বোনেরা বাড়িতে যাওয়ার পথে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা আমাদের ভাই বোনদের উপর নির্যাতন চালাত। তাদের নানাভাবে হয়রানি করতো।’
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নোয়াখালী জেলার সহকারী মুখপাত্র সুমাইয়া আক্তার বাসসকে বলেন, সেসব দিনের কথা মনে হলে এখনো গা শিউরে ওঠে। আমার বাবা দেশের বাইরে ছিলেন। ইন্টারনেট শাটডাউনের কারণে কয়েকদিন বাবার সাথে যোগাযোগ করতে পারিনি। নিজের জীবনের কথা চিন্তা না করেই দেশকে যেকোনো মূল্যে বাঁচাতে হবে এই মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে প্রতিদিনই আন্দোলনে যেতাম। মনে কোনো ভয় তখন কাজ করতো না।
তিনি বলেন, ‘যেকোনো মূল্যে খুনি হাসিনাকে পদত্যাগ করাতে হবে’ এই একটা কথাতে সবাই আমরা একমত হয়েছিলাম। দেশের ছাত্র জনতার বুকের তাজা রক্তের বিনিময়ে খুনি হাসিনা এ দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়। আগামীতে যারা শাসক হয়ে আসবেন তারাও যেন স্বৈরাচারী না হয়ে উঠেন। যদি কেউ আবার ভবিষ্যতে দেশের বুকে স্বৈরাচার হয়ে ওঠার দুঃস্বপ্ন দেখেন আমরা ছাত্র-জনতা তখনো থেমে থাকবো না। যেখানে স্বৈরাচারী মনোভাব দেখবো সেখানেই আমরা আমাদের জুলাই আন্দোলন চালিয়ে যাব।