\ নুসরাত সুপ্তি \
নারায়ণগঞ্জ, ২৬ জুলাই, ২০২৫ (বাসস) : ছাত্র জনতার গণ-অভ্যুত্থানে ২০২৪ সালের ২৬ জুলাই দিনটা ছিল শুক্রবার। প্রতি সপ্তাহে জুম্মার নামাজটা বেশ প্রশান্তির সাথে আদায় করেন মুসল্লিরা। কিন্তু সে দিনটা ছিল আতঙ্কের। জনমনে ছিল তীব্র আক্রোশ ও ক্ষোভে ভরা। ওইদিন আমাদের এলাকার মসজিদে জুমার নামাজে ইমাম মোনাজাত ধরতেই মসজিদের মুসল্লিরা কেঁদে উঠেন। সকলের মাঝেই ছিল ভয় আর বেদনা। মোনাজাতে ইমাম এক পর্যায়ে বলেই ফেললেন, আল্লাহ আমাদের সন্তানদের রক্ষা করো, জালিমের জুলুম থেকে রক্ষা করো। সবাই সমস্বরে বলে উঠলো , আমিন।
তখন আমার মনে একটা ধাক্কা লাগলো। মনে হলো মানুষ স্বৈরাচারের ভয় কাটিয়ে উঠতেছে, তাদের মধ্যে প্রতিরোধের স্পৃহা জেগে উঠেছে। নামাজের পড়েই ঢাকা-চট্রগ্রাম মহাসড়কসহ গুরুত্বপূর্ণ সড়কে মুসল্লিরা জমায়েত হয়ে মিছিলে নামে। পিতারা তাদের শিশু সন্তান নিয়ে সড়কে নেমে আন্দোলনে যুক্ত হয়।
কথাগুলো বলছিলেন জুলাই আন্দোলনের যোদ্ধা ও নারায়ণগঞ্জ জেলা এনসিপির সদস্য সোহেল খান। তিনি নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ থানার বাসিন্দা। বর্ণনা দিচ্ছিলেন আন্দোলনের মাঝামাঝি সময়ে সেদিনের দৃশ্যপট কেমন দেখেছিলেন তার চোখে।
চব্বিশের ২৫ জুলাই কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সহিংসতার ঘটনায় সারাদেশের ন্যায় নারায়ণগঞ্জেও গণগ্রেপ্তার চলে। ২৬ জুলাই শুক্রবার নারায়ণগঞ্জে বসেছিলো বিশেষ আদালত। এদিন অর্ধশতাধিকের বেশি আসামিদের আদালতে তোলা হয়। যাদের প্রায় অধিকাংশ আসামিদের ৫৪ ধারায় মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে প্রায় সকলকেই কারাগারে পাঠানো হয়। আদালত প্রাঙ্গণে অসহায় মানুষের আহাজারি আর চোখের পানি হয়ে উঠে নিত্যনৈমিত্তিক বিষয়। গ্রেপ্তারকৃতদের অধিকাংশই ছিলেন সাধারণ মানুষ। যাদের সাথে রাজনীতির ন্যূনতম সম্পর্ক ছিল না।
আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর আইনজীবি আবুল কালাম আজাদ জাকির এ বিষয়ে বলেন, নারায়ণগঞ্জে ২০২৪ সালের ২৬ জুলাই বিশেষ আদালতে অর্ধশতাধিকের বেশি আসামিকে ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে উঠানো হয়। পরে হওয়া বিভিন্ন মামলায় এই আসামিদের অধিকাংশের নাম যুক্ত করে দেওয়া হয়।
সেদিন সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত নারায়ণগঞ্জ শহর ও শহরতলীতে মানুষের চলাচল স্বাভাবিক থাকলেও ভেতর ছিলো চাপা উৎকন্ঠা। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা নিজ নিজ এলাকাভিত্তিক আন্দোলনকারীদের তালিকা তৈরি করতে থাকে। তাদেরকে পুলিশে ধরিয়ে দিতে থানায় থানায় তালিকা পাঠিয়ে দেয়ার সংবাদ পাওয়া যায়।
গ্রেপ্তার এড়াতে আন্দোলনকারীদের সরে থাকতে খোদ সহায়তা করেন আন্দোলনকারীদের পাড়া প্রতিবেশীরাও। জেলা ছাত্রদলের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক মেহেদী হাসান দোলন বলেন, আন্দোলনে যুক্ত হবার পরেই আমার নামে মামলা হয়। আন্দোলন আহত হয়েছি কিন্তু মামলা থাকায় ঠিকমতো চিকিৎসাও নিতে পারি নাই। ২০ জুলাই পর থেকেই পুলিশ আমাদের সহযোদ্ধাদের গ্রেফতার করতেছিল। আমার মনে আছে ২৬ জুলাই এর সকালে যখন আমি আন্দোলনের জন্য বের হই, তখন আমাদের বাসার কয়েকজন ভাড়াটিয়া, পার্শ্ববর্তী আন্টিরা আমাকে কয়েক হাজার টাকা দেয়। তারা চেয়েছিলো আমরা যেন নিরাপদে থাকি। এসব মানুষের ঋণ কখনোই শোধ করতে পার না।
সন্ধ্যার পর থেকেই জেলার শহরে কমতে থাকে সাধারণ মানুষের আনাগোনা। মহাসড়কেও যানবাহনের পরিমাণ ছিল খুবই কম। রাত ৮টার পরেই ফাঁকা হয়ে যায় পুরো শহর। থমথমে নগরীতে রাত হলেই নামতো যৌথ বাহিনীর অভিযান। যেখানে বিএনপি জামায়াত কর্মীর নাম করে গ্রেপ্তার করা হতো সাধারণ নিরীহ মানুষদের।