ঢাকা, ২৬ জুলাই, ২০২৫ (বাসস) : ৩৬ জুলাই বিপ্লবে বীর শহীদদের সম্মানে স্মরণ সভায় বক্তারা বলেছেন, জুলাই মাসের মধ্যেই জুলাই সনদ প্রণয়ন করতে হবে। অবিলম্বে গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারগুলো বাস্তবায়ন করতে হবে। একই সাথে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনাসহ জুলাই গণহত্যার প্রধান আসামিদের বিচার প্রক্রিয়া শেষ করে রায় বাস্তবায়ন করতে হবে।
আজ শনিবার রাজধানীর চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে জুলাই-২৪ শহীদ পরিবার সোসাইটির উদ্যোগে আয়োজিত ৩৬ জুলাই বিপ্লবে বীর শহীদদের সম্মানে স্মরণ সভায় বক্তারা এ দাবি জানান।
জুলাই শহীদদের স্মরণ সভায় বক্তব্য দেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম, জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম, ইসলামী আন্দোলনের প্রেসিডিয়াম সদস্য অধ্যাপক আশরাফ আলী আকন প্রমুখ।
জুলাই-২৪ শহীদ পরিবার সোসাইটির চেয়ারম্যান ও শহীদ গোলাম নাফিসের পিতা গালাম রহমানের সভাপতিত্বে স্মরণ সভায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা ও শহীদ পরিবারের সদস্যরা বক্তব্য দেন।
জামায়াত আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেন, ‘শহীদ পরিবারের সদস্যরা জুলাই সনদের কথা বলেছেন। এটা তো বাংলাদেশের ১৮ কোটি মানুষের মুক্তির সনদ। এটা শুধু শহীদ পরিবারের জন্য প্রয়োজন তা নয়। এটা দেশের প্রত্যেকটা মানুষের জন্য প্রয়োজন।
তিনি বলেন, সংসদের অবর্তমানে এই সনদ প্রণয়নের দায় হচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর। রাজনৈতিক দলগুলোর চিন্তা করা উচিত, এই যে আমরা ঐকমত্য কমিশনে বসি, যদি জুলাই যোদ্ধারা জীবন দিয়ে আমাদের জন্য পরিবর্তন না এনে দিতেন, আমরা এখানে বসতে পারতাম? নাকি আমরা কেরানীগঞ্জে কারাগারে থাকতাম। অথবা আমরা কাশিমপুর কারাগারে থাকতাম। আমরা এতো তাড়াতাড়ি ভুলে যাই কীভাবে। আমরা তো মাসের পর মাস সেখানে ছিলাম। আজ এখানে জুলাই যোদ্ধার পাশাপাশি যাদেরকে বছরের পর বছর আয়না ঘরে গুম করে রাখা হয়েছিল তারাও এখানে উপস্থিত আছেন। একটি জল্লাদ সরকারের হাত থেকে যারা আমাদের মুক্তি এনে দিল, আমরা কেন তাদেরকে ভুলে যাচ্ছি। ইতিহাস আমাদের ক্ষমা করবে না। আগামী প্রজন্ম আমাদের কাছ থেকে কাড়ায় গন্ডায় তার হিসাব নেবে। এই জন্য আমি শহীদ পরিবারের সাথে কণ্ঠ মিলিয়ে বলি সব কিছু দূরে রাখেন। জুলাই সনদ আগে পাস করুন সবাই মিলে। এই ব্যাপারে আমাদের পক্ষ থেকে সামান্যতম কোনো দুর্বলতা যেন প্রদর্শন না করা হয়।
তিনি বলেন, ‘অন্যান্য দলগুলোকে আমি বলব-ক্ষমতায় কে যাবে না যাবে সেটা মহান আল্লাহ নির্ধারণ করবেন। নির্বাচন কখন হবে না হবে এটাও আল্লাহ নির্ধারণ করবেন। আগে নিজের কর্তব্যগুলো আমরা পালন করি।
তিনি আরো বলেন, শহীদ পরিবার রাষ্ট্রের কাছে স্বীকৃতি চেয়েছে। একটু সম্মান চেয়েছে। কিন্তু এই সম্মান ও স্বীকৃতি দিতে কোথায় যেন একটু লুকোচুরি চলে। এই হীন মন্যতা কেন? কেন আমরা উপলব্ধি করিনা, বর্তমান সরকার থেকে প্রত্যেকটা মুক্ত নাগরিক তাদের কাছে রক্তের জালে বন্দী। তাদের রক্তের ঋণ পরিশোধ করা আমাদের পবিত্র কর্তব্য।
তিনি আরও বলেন, এক বছর হতে চলল, আজ পর্যন্ত শহীদদের প্রোফাইল তৈরি করা সম্ভব হল না। আমি বিস্মিত। তবে আমরা ঘরে ঘরে গিয়ে খোঁজ-খবর নিয়ে শহীদদের ইতিহাস লিপিবদ্ধ করার চেষ্টা করেছি। ইতোমধ্যেই আমরা প্রথমে ১০ খণ্ড প্রকাশ করেছি এবং পরে আরও দুই খণ্ড প্রস্তুত করা হয়েছে। এগুলোর ইংরেজি ভার্সনও প্রস্তুত করা হয়েছে। এ প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে। ৫ বছর পরও যদি কোনো শহীদের খবর পাই, আমরা তার প্রোফাইল তুলে আনব ইনশাআল্লাহ। আমরা চাই আমাদের শহীদরা অম্লান হয়ে থাকুক।
তিনি আরও বলেন, ত্রিশ হাজারের বেশি মানুষ আহত হয়েছে। তাদের অনেকেই হাত-পা-চোখ হারিয়ে হাসপাতালে বা নিজ বাড়িতে ঘরের বিছানায় প্যারালাইজড হয়ে পড়ে আছে। তাদের প্রোফাইলও প্রকাশের কাজে হাত দিয়েছি। তাদেরও দুটি ভলিউম ইতোমধ্যেই সম্পন্ন হয়েছে। আমাদের ধারণা এই ভলিউম ১০০ খণ্ডে চলে যেতে পারে। সরকার করুক বা না করুক একটা দায়িত্বশীল সংগঠন হিসেবে আমরা এটা চালিয়ে যাব ইনশাআল্লাহ। এই শহীদ ও আহত পরিবারগুলোকে বুকে নিয়ে আমরা গর্বের সাথে বাঁচতে চাই।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বলেন, মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার বিচার কোনো সাধারণ বিচার নয়। মানবতাবিরোধী অপরাধ অর্থাৎ গণহত্যার বিচার বিশ্বের সবচেয়ে জটিলতম অপরাধের বিচার। মানবতাবিরোধী অপরাধকে বলা হয়, অপরাধেরও অপরাধ। বিশ্বের অন্যান্য দেশে মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলার তদন্ত রিপোর্ট আসতে গড়ে দুই বছরেরও বেশি সময় লেগেছে। সেখানে মাত্র ছয় মাসের মধ্যে আমরা তদন্ত রিপোর্ট পেয়েছি। আর মাত্র ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আমরা মামলার ফরমাল চার্জ দাখিল করেছি। যেটা দাখিল করতে একমাস সময় লাগে।
তিনি বলেন, ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে চারটি মামলার দৃশ্যমান বিচার চলছে। বিচার কার্যক্রম চলমান আছে। আমরা লাইভ দেখিয়েছি। তবে সব কিছু লাইভে দেখানো যাবে না। আগামী ৩ ও ৪ আগস্ট শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে প্রথম সাক্ষী আদালতে জবানবন্দি দেবেন। সেদিন গোটা জাতি টিভিতে চোখ রাখবেন। যাদের পক্ষে সম্ভব হবে আদালতে আসবেন। এক এক করে আয়নার মতো পরিষ্কার করে আমরা দুনিয়ার কাছে শুধু বাংলাদেশের কাছে না, ইনশাআল্লাহ আমরা প্রমাণ করতে সক্ষম হব। কি অপরাধ তিনি করেছেন, তার অপরাধের কি প্রমাণ এবং তার অপরাধের কি শাস্তি হওয়া উচিত। গণহত্যার মামলার বিচার এক বছরে শেষ করা যায় না। এটা মোবাইল কোট না। এই বিচার দেখার জন্য বাংলাদেশের ১৮ কোটি মানুষের ৩৬ কোটি চোখের পাশাপাশি গোটা দুনিয়ার সমস্ত সচেতন মানুষের চোখ রয়েছে। এই বিচার যদি আমরা সঠিকভাবে না করতে পারি। তাহলে ভুল বিচার করার দায়ে আপনারাই একদিন দাবি করবেন তোমাদের বিচার করা হবে। আমাদের বিচার সেই দিন আপনারা চাইবেন- আমরা সেই সুযোগ দেবনা গোটা দুনিয়ার কাউকে। আমরা বিচার করব। অপরাধীর প্রাপ্য শাস্তি নিশ্চিত করব। কিন্তু কোনো রকমের অন্যায় প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নয়। গোটা দুনিয়ার কেউ যাতে প্রশ্ন তুলতে না পারে যে বিচার হয়েছে, সেটা কলঙ্কিত বিচার। যেটা আওয়ামী লীগ করেছিল। সে রকম কলঙ্কিত কোনো বিচার আমাদের হাত দিয়ে হবে না।’
সারজিস আলম বলেন, এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে বিচার, জুলাই সনদ এবং মৌলিক সংস্কার বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সবার সাথে, সকল শহীদ পরিবারের সাথে বসতে হবে।