বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যাশায় জুলাই-অভ্যুত্থানে শামিল হয়েছিলাম : তাজমিন রহমান 

বাসস
প্রকাশ: ০২ আগস্ট ২০২৫, ১৪:৫৭ আপডেট: : ০২ আগস্ট ২০২৫, ২৩:২৩
তাজমিন রহমান। ছবি: সংগৃহীত

আবু উবায়দা

ঢাকা, ২ আগস্ট,  ২০২৫ (বাসস): ২০২৪ এর জুলাইয়ের শুরুতে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে কোটা সংস্কার আন্দোলনের নতুন ঢেউ উঠে। ২ জুলাই কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে শুরু হয় কোটা সংস্কারের আন্দোলন। সেখানে পুরুষ শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি নারী শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ ছিল অভূতপূর্ব। আন্দোলনে নারীরা ছিলেন দৃঢ়, সাহসী, স্পষ্টভাষী।

তেমনই একজন ছিলেন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফোকলোর স্টাডিজ বিভাগের ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী তাজমিন রহমান। শুধু শিক্ষার্থী নন, তিনি একজন মা, একজন প্রতিবাদী নারী। কোলে তার দু’বছরের সন্তান, আর মুখে অন্যায়ের বিরুদ্ধে স্পষ্ট প্রতিবাদ। বর্তমানে তিনি ‘জাস্টিস ফর জুলাই’ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় শাখার মুখপাত্র হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

সম্প্রতি বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধিকে দেয়া এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে জুলাই আন্দোলনের স্মৃতি ও প্রত্যাশা নিয়ে কথা বলেছেন তাজমিন রহমান। 

বাসস: আন্দোলনে কবে থেকে সক্রিয় হয়েছেন? শুরুর দিকে আন্দোলন নিয়ে আপনার ভাবনা কী ছিল?

তাজমিন রহমান: আমি আন্দোলনে মূলত যুক্ত হয়েছি ১০ তারিখ থেকে। তখন সারাদেশে বাংলা ব্লকেড কর্মসূচি চলছিলো। সেদিন আমার বাবা এবং আমার ১৭ মাস বয়সী সন্তানও ছিল আমার সঙ্গে। আমি মূলত বৈষম্যের অবসানের দাবিতে এই আন্দোলনে যোগ দেই। আমরা সকলেই বুঝতে পারছিলাম আমাদের সাথে অন্যায় হচ্ছে। চাকরির বাজারে আমরা বৈষম্যের শিকার হচ্ছি। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম, আমার সন্তান যেন ভবিষ্যতে এ ধরনের কোন বৈষম্যের শিকার না হয় সেজন্য আমি আন্দোলনে যোগ দেই।

বাসস: ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনের সূচনা ও নারীদের অংশগ্রহণ নিয়ে আপনার মূল্যায়ন কী?

তাজমিন রহমান: আমাদের ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন কোটা সংস্কার আন্দোলন শুরু হয়, তখন কিন্তু আন্দোলনটা কেবল ছেলেদের হাত ধরেই হয়নি। যদিও আমি তখন সরাসরি যুক্ত ছিলাম না, কিন্তু আমি দেখেছি, জিনাত মালিহা সীমা, সাদিয়া মাহমুদ মিম, এরা পুরুষদের পাশাপাশি এসে প্রথম দিকেই অংশগ্রহণ করেছে। প্রথমে মেয়েদের সংখ্যা কম ছিল, কিন্তু পরবর্তীতে যখন সারাদেশে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে, সবাই যখন বুঝতে পারে তারা এক ধরনের বৈষম্যের শিকার হচ্ছে, তখন ছেলে মেয়ে সবাই নিজ নিজ জায়গা থেকে অধিকারের বিষয়ে সচেতন হয়ে ওঠে। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৭ই জুলাইয়ের সেই বিশাল আন্দোলন তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ। সেখানে আমরা নারীদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ দেখেছি। তারা হাতা, খুন্তি, বেলনা, ঘুটনি হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলো, যেন এগুলোই তাদের অস্ত্র। যখন হলগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয় তখনো তারা আন্দোলনে সক্রিয় ছিল। এছাড়া আন্দোলনের সময় ক্যাম্পাসজুড়ে যে সব গ্রাফিতি আঁকা হয়েছে, তার অনেকগুলোই মেয়েদের হাতেই হয়েছে। রাতের বেলা বৃষ্টির মধ্যেও আমরা ক্যাম্পাসের দেয়ালে নানা স্লোগান লিখেছি। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে নারীদের অংশগ্রহণ আন্দোলনটাকে আরও প্রাণবন্ত করে তোলে।

বাসস: আপনাকে সন্তান কোলে নিয়ে আন্দোলনে অংশ নিতে দেখা গিয়েছে, একজন মা হিসেবে আপনার সামনে আসার সিদ্ধান্তটি কতটা চ্যালেঞ্জিং ছিল? 

তাজমিন রহমান: এটা আসলে বলে বোঝানোর মতো না। এখন হয়ত অনেকে বিষয়টা সহজ ভাবে নিচ্ছে। বাহিরে গেলে অনেকে আমার ছেলের নাম ধরে বলে, ‘আপনি তো ছোট যোদ্ধার আম্মু।’ কিন্তু তখন বিষয়টা এত সহজ ছিল না। আমাদের ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিস্থিতি একটু ভিন্ন হলেই হয়ত খারাপ কিছু ঘটতে পারত। যেভাবে বিভিন্ন বাহিনীর সদস্যরা উপস্থিত হয়েছিল, পরিস্থিতি যদি সামান্য বদলে যেত, তাহলে আমি এবং আমার সন্তান দুজনেই হয়ত ক্ষতির মুখে পড়তে পারতাম। তবুও আমি সেই মুহূর্তে আমার সন্তানকে নিয়ে আন্দোলনে দাঁড়িয়েছি। আমার ব্যানার-ফেস্টুনের বদলে আমি নিজের সন্তানকেই প্রতিবাদের প্রতীক বানিয়েছিলাম। অভ্যুত্থানে সন্তানই ছিল আমার ব্যানার ও প্রতিবাদের ভাষা।

আর তাছাড়া এই আন্দোলনে যদি আমি মারা যেতাম, আর আমার ছেলে বেঁচে থাকত, তবুও সে বলতে পারত, ‘আমার মা বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলনে শহীদ হয়েছেন।’

অথবা উল্টোভাবে, আমি বলতে পারতাম, ‘আমি আমার সন্তানকে যৌক্তিক আন্দোলনের জন্য হারিয়েছি।’ সেই জায়গায় আমার কোনো আফসোস থাকত না।

বাসস: কোলের শিশুকে নিয়ে আন্দোলন করার ব্যাপারে পরিবারের অবস্থান কী ছিল?

তাজমিন রহমান: শুরুর দিকে পরিবার আমার আন্দোলনে অংশগ্রহণ নিয়ে কিছুটা শঙ্কিত ছিল। বিশেষ করে, আমার মা আমার নিরাপত্তা নিয়ে গভীর উদ্বিগ্ন ছিলেন এবং প্রায়ই কান্নাকাটি করতেন। তিনি চাইতেন না আমি আন্দোলনে যাই। তবে আমার বাবা আমার আন্দোলনে অংশগ্রহণের ব্যাপারে জানতেন কিন্তু বাধা দেননি। আমার স্বামী আমাকে সবসময় সতর্ক করতেন এবং নিরাপদে থাকতে বলতেন। আন্দোলনের শুরুর দিকে পারিবারিক ও পারিপার্শ্বিক পরিবেশ ছিল বেশ আতঙ্কজনক। কিন্তু যখন দেখা গেল আন্দোলনকারী ছাত্ররা যৌক্তিক দাবিতে নিপীড়নের শিকার হচ্ছে, রক্ত ঝরছে, তখন পরিস্থিতির মোড় ঘুরতে শুরু করে। এক পর্যায়ে, আমার মা নিজেই ফোন করে বললেন, ‘ফি সাবিলিল্লাহ’। তিনি আমাকে আন্দোলনে যাওয়ার গ্রিন সিগন্যাল দিয়ে দিলেন। আমার ভাইও আমাকে সবসময় মানসিকভাবে সমর্থন দিয়েছেন। 

বাসস: আন্দোলন চলাকালে কোনো হুমকির শিকার হয়েছেন কি?

তাজমিন রহমান: হঠাৎ করেই একদিন আমার সন্তানের আন্দোলনের একটি ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়ে যায়। আমি তখন জানতামই না, কারণ আমার হাতে স্মার্টফোন ছিল না, তাই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও সক্রিয় ছিলাম না। পরদিন আন্দোলনে এসে সবার মুখে মুখে শুনতে পেলাম, তানজিমের (আমার সন্তান) ছবি খুব ভাইরাল হয়ে গিয়েছে। সেই মুহূর্তে একটু ভয় ভয় লাগতে শুরু করলো। কারণ, তার আগ পর্যন্ত আমাকে কেউ চিনত না। কিন্তু ছবি ভাইরাল হওয়ার পর থেকে মানুষ আমাকে চিনে ফেলল। কারণ বাচ্চাটা সবসময় আমার কোলেই থাকত। এর কিছুদিন পর, এক রাতে হঠাৎ পুলিশ আমার বাসায় চলে আসে। আমি অবশ্য সবসময় বাসার সব লাইট বন্ধ করে রাখতাম, আর বাইরে থেকে তালা লাগিয়ে রাখতাম যেন মনে হয় বাসায় কেউ নেই। সেদিনও একইভাবে তালা লাগানো ছিল, তাই পুলিশ আমার উপস্থিতি আন্দাজ করতে না পেরে ফিরে যায়। কিন্তু এরপরই বাড়ির মালিক আমাকে জানিয়ে দিলেন দুই দিনের মধ্যেই বাসা ছেড়ে দিতে হবে। তখন সারাদেশে ১৪৪ ধারা জারি ছিল, সেনাবাহিনীর গাড়ি নিয়মিত আমার বাসার সামনের রাস্তায় টহল দিত। সেই সময়েই আমাকে বাসা ছেড়ে নতুন জায়গায় চলে যেতে হয়। এরপর শুরু হয় ফোনে হুমকি। উদ্ভট উদ্ভট নাম্বার থেকে ফোন আসত, বলা হতো-‘ক্যাম্পাসে ঢুকলে ঠ্যাং ভেঙে দেব।’ আমার কিছু বন্ধু আমাকে জানিয়েছিল যে ছাত্রলীগের একটি মেসেঞ্জার গ্রুপে আমাকে ‘বাচ্চা ওয়ালি’ বলে উল্লেখ করা হতো এবং বলা হতো, ‘ওই বাচ্চাওয়ালিকে আগে ধরতে হবে।’ 

আমার এক বান্ধবী আমাকে সতর্ক করে বলেছিল ‘আন্দোলন সফল না হলে, পরবর্তীতে তোমার ওপর হয়ত অনেক নির্যাতন চালাবে তারা।’ আমি তখন বলেছিলাম আন্দোলন সফল হবে কি না, আমাকে হয়রানি করা হবে কিনা সেটা অনেক পরের কথা। ওইদিকে আমার ভাই-বোনেরা মারা যাচ্ছে, আমি কীভাবে চুপ থাকি, আমি কি করে ঘরে বসে থাকতে পারি? তাই সবকিছু ছেড়ে, ঝুঁকি নিয়েই আমি আন্দোলনে এসে বারবার দাঁড়িয়েছি। কেন জানি না, ঘরে বসে থাকতে পারতাম না। আমার মনে হতো আমি যদি একটু দেরি করি, তাহলে অনেক কিছু মিস করে ফেলব।

বাসস: আন্দোলনে নারীদের এমন স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?

তাজমিন রহমান: দেশব্যাপী নারী শিক্ষার্থীরাই ছিল সম্মুখ সারির যোদ্ধা। আমরা দেখেছি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কীভাবে সন্ত্রাসী ছাত্রলীগ নারী শিক্ষার্থীদের উপর আক্রমণ চালিয়েছিলো। তাদের রক্তাক্ত করেছিলো। সেই রক্তাক্ত ছবিই কিন্তু আন্দোলনকে আরও বেগবান করে তোলে। হাসিনা হয়ত ভেবেছিলো হামলা করে শিক্ষার্থীদের দমন করা যাবে। কিন্তু ছাত্রলীগের সেই আক্রমণ শিক্ষার্থীদের দমন তো দূরের কথা, আন্দোলনে তাদের আরও উদ্বুদ্ধ করেছে। তারা এই জুলুমের বিরুদ্ধে এক যোগে মাঠে নেমে পড়েছিল। 

বাসস: পুরুষ সহযোদ্ধাদের কাছ থেকে কেমন সহযোগিতা পেয়েছেন?

তাজমিন রহমান: এই জায়গায় আমি বলতে চাই আলহামদুলিল্লাহ, আমার সহযোদ্ধারা শুরু থেকেই অসাধারণভাবে আমাকে সাহায্য করেছেন। ১০ তারিখে যখন আমি প্রথম আন্দোলনে যাই, তখন প্রচণ্ড গরম ছিল। আমরা রাস্তার মাঝখানে আন্দোলন করছিলাম, আর তখন তানজিমের বয়স মাত্র ১৭ মাস। সে তখন হাঁটতে শেখার চেষ্টা করছে, মুখে দুই-তিনটা দাঁত উঠছে। আমি যখন আন্দোলনে ব্যস্ত থাকতাম, অনেকে নিজে থেকে আমার সন্তানের দেখভাল করত। বাচ্চা কোলে নিয়ে যেন হাঁটতে না হয়, আমি যেন ক্লান্ত না হয়ে যাই সে জন্য তারা তাকে কোলে রাখত। অনেকে তাকে জুস বা চিপস কিনে দিত। এমনকি রাস্তার পাশের চা-ওয়ালা মামারাও মাঝে মাঝে বলতেন, ‘আপু, আমার কাছে রেখে যান।’ আমি তানজিমকে তাদের কাছেও রেখে দিয়েছি অনেকসময়।

আমাদের সমন্বয়ক প্যানেল থেকেও আমাকে সর্বোচ্চ সাপোর্ট দেওয়া হতো। বিশেষ করে সমন্বয়ক সুইট ভাই যাকে নিজের নিরাপত্তার জন্য রাতে সেফ জায়গায় থাকতে হতো, নিয়মিত সিম বদলাতে হতো, তবুও তিনি দুই-এক দিন পরপর আমাকে ফোন দিতেন, খোঁজ নিতেন আমি ঠিক আছি কিনা। এছাড়াও সহ-সমন্বয়ক ইয়াশিরুল ভাই আমার নিরাপত্তার বিষয়ে অনেক খোঁজখবর নিতেন। আন্দোলনের সময় সাংবাদিক জায়িম ভাই ও সাংবাদিক আজহার ভাই সবসময় আমাকে চোখে চোখে রাখতেন। আমি একদিন আজহার ভাইকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম ভাই আপনারা আমার এত খেয়াল কেন রাখেন? উত্তরে তিনি বলেছিলেন, ‘অন্তত তোকে আর তোর সন্তানকে যেন নিরাপত্তা দিতে পারি।’

যখন সারাদেশে সেনাবাহিনী মোতায়েন হলো, কারফিউ জারি হলো, বাজার-ঘাট সব বন্ধ সেই সময়ে জায়িম ভাই ফোন দিয়ে আমার খোঁজ নিতেন, আমার কিছু লাগবে কিনা, বাসায় যাবো কিনা ইত্যাদি বিষয়ে খোঁজ নিতেন। এত ব্যস্ততার মাঝেও তিনি আমার খোঁজ-খবর নিতে কখনও ভুলেননি। এছাড়া আমার ব্যাচের সাংবাদিক বন্ধু মুনিম, আবির, নাজমুল সবসময় আমার খোঁজ রাখতো, আমার সন্তানকে দেখে রাখতো। মোটকথা, আমার সহযোদ্ধারা আমাকে কখনও বোঝা মনে করেনি। বরং আমি মা, আমার সন্তান আছে এই কারণে কেউ আমাকে পিছনে রাখেনি। তারা আমাকে সবসময় ফ্রন্ট লাইনে রেখেছে, পিছন থেকে সাহস জুগিয়েছে। তাই আমি বলতে পারি, আমার সহযোদ্ধারা আন্তরিক ছিল, সহানুভূতিশীল ছিল, এবং তারাই মূলত আমাকে ফ্রন্ট লাইনে বাচ্চা নিয়েও দাঁড়ানোর শক্তি দিয়েছে।

বাসস: আন্দোলনের সময়কার সবচেয়ে স্মরণীয় কোনো স্মৃতি আছে কি? 

তাজমিন রহমান: ‘মরলে ওইদিকে গিয়ে মরো’, এমন উক্তি শুনতে হয়েছে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষকের কাছে। আন্দোলনের একদিন আমি একটু মেইন গেটের দিকে এসে দাঁড়াই, রাস্তায় তখন প্রচণ্ড রোদ আর গরম। আমি বাবুর কথা চিন্তা করে একটু ছায়ার দিকে এসেছিলাম। উনি আমাকে প্রথমে বহিরাগত মনে করেছিলেন। পরে যখন আমি পরিচয় দিলাম তখন বললেন, ‘ওইদিকে চলে যাও।’ আমি বললাম কেন যাবো? উনি আমাকে বললেন, ‘মরলে ওইদিকে গিয়ে মরো।’ আমি এই কথায় খুব মর্মাহত হয়েছিলাম। যেখানে কিনা শিক্ষকরা আমাদের পিতৃতুল্য, আমাদের অভিভাবক তারা। সেই তাদের কাছে এমন কথা শুনে আমি খুব কষ্ট পেয়েছিলাম। তারা আমাদেরকে সন্তান তো দূরের কথা, মানুষই মনে করেন না। 

আর সব থেকে বেশি ট্রমাটাইজড হয়েছিলাম, আবু সাইদ ভাই, মুগ্ধ ভাইদের সেই ভিডিওগুলো দেখে। সেগুলো দেখার পর থেকে আমি ঘুমাতে পারতাম না। আমার মন সবসময় আন্দোলনের দিকে পড়ে থাকতো। মনে হতো যে, আল্লাহ, কালকে সকালবেলা যে কি হয়? 

যখন সারা বাংলাদেশে ইন্টারনেট অফ করে দিলো, তখন সব থেকে বেশি আতঙ্ক কাজ করলো। যখন শুনলাম বাংলাদেশ সেনাবাহিনী মোতায়েন হয়ে গেছে তখন আমি খুব ভয় পেয়েছিলাম। আর এদিকে গেটে একটু শব্দ হলে মনে হতো এই বুঝি পুলিশ চলে এসেছে, এই বুঝি আমাকে ধরে নিয়ে যাবে। এভাবেই আতঙ্কের মধ্যে রাত গুলো পার করতাম।

বাসস: সরাসরি রাজপথে আন্দোলনের বাইরে আর কোনো কার্যক্রম করেছেন কী? সেগুলো কী? 

তাজমিন রহমান: আগস্টের ৩ তারিখ রাতে আমরা কয়েকজন মিলে ক্যাম্পাসে গ্রাফিতি ও দেয়াল লিখনের কাজ করি। তখন ক্যাম্পাসের পরিবেশ ছিল খুব ভয়াবহ ও থমথমে। সেই মুহূর্তে, আমার বাবুকে সঙ্গে নিয়েই আমরা কয়েকজন রাতে চুপিচুপি ক্যাম্পাসের ভেতরে গ্রাফিতি করি। সেসময় সাংবাদিক জায়িম ভাই, নাহিদ ভাই, রিফাত ভাই, সহ-সমন্বয়ক ইয়াশিরুল ভাই- তারা আমাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করছিলেন। এছাড়া আরও কয়েকজন সাংবাদিক ছিলেন তখন আমাদের পাশে। আমরা টিএসসি থেকে শুরু করে প্রশাসনিক ভবন, অনুষদ ভবনের দেয়ালে গ্রাফিতি করি। বৃষ্টির মধ্যেই আমরা কাজ চালিয়ে যাই। কাজ শেষ করে বের হতে হতে প্রায় রাত ১০টা বেজে গিয়েছিলো। যখন আমরা মেইন গেট পেরোচ্ছি, তখন দেখি ছাত্রলীগ নেতা বিপুল আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। এরপর চারুকলা বিভাগের ছোটবোন ঐশিকে ঝিনাইদহগামী বাসে তুলে দিয়ে আমি আর আমার স্বামী হেঁটে হেঁটে শেখপাড়া বাজারের দিকে যাচ্ছিলাম। তখন লক্ষ্য করি, বিপুল আমাদের পিছু নিয়েছে। তার খারাপ উদ্দেশ্য আঁচ পেয়ে আমরা নিরাপদ আশ্রয় নিই। পরে, যখন সে আমাদের খুঁজে পায়নি, তখন সেখান থেকে সরে যায়। তখন আমি সত্যিই ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। মনে হয়েছিল, সুযোগ পেলে সে আমাদের ক্ষতি করতো।

বাসস: ৫ আগস্টের বিজয় কীভাবে উদযাপন করেছিলেন?

তাজমিন রহমান: ৫ আগস্টের বিজয়ের আনন্দ আমি সরাসরি ক্যাম্পাসে উদযাপন করতে পারিনি। সে সময় জরুরি পারিবারিক কাজে আমাকে বাড়ি চলে যেতে হয়েছিলো।

৪ আগস্টের আন্দোলনে আমি শুধু উপস্থিতি নিশ্চিত করে ক্যাম্পাস ত্যাগ করি। ৫ তারিখে যখন বাড়ি পৌঁছাই, ঠিক বাস থেকে নামার কিছুক্ষণের মধ্যেই খবর পাই হাসিনা পালিয়েছে। তখন চারদিকে হইচই পড়ে যায়। আমাদের এলাকার মানুষ রাস্তায় দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলছিল, ‘শেখ হাসিনা পালাইছে রে!’। পরিবারের সবাই মিলে তখন আনন্দের আবহে মিষ্টি বিতরণ করি। আমি মেসেঞ্জারে বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলছিলাম, আপডেট নিচ্ছিলাম। বিশেষ করে সার্বক্ষণিক ইবি ক্যাম্পাসের খবর নিচ্ছিলাম। তবু একটা বড় আফসোস রয়ে গেছে, আমি বিজয়ের সেই মুহূর্তটা ক্যাম্পাসের সবাইকে নিয়ে উপভোগ করতে পারিনি। ভিডিওগুলোতে যখন দেখলাম ক্যাম্পাসে হাজারো মানুষের উল্লাস তখন খুব আফসোস হলো, ইশ! আমি যদি শেষ পর্যন্ত থাকতে পারতাম, তাহলে আমিও হয়ত সেই বিজয়ের সরাসরি সাক্ষী হতে পারতাম। যদিও বাড়ির পরিস্থিতিও তখন খুব একটা সহজ ছিল না। আমার ছোট বোন গুরুতর অসুস্থ ছিল, তাই মনটাও খুব ভারী হয়ে ছিল। এই না থাকা, এই মিস করে যাওয়া এটা আমার জন্য এক ধরনের হৃদয়ে গেঁথে থাকা বেদনা হয়ে আছে। বিজয়ের অংশ ছিলাম, কিন্তু তার আনন্দটা ঠিক উপভোগ করতে পারিনি। 

বাসস: আন্দোলনের এক বছর হয়ে গেল, প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি নিয়ে আপনার মতামত কী?

তাজমিন রহমান: আমাদের বিজয় অর্জনের এখন প্রায় এক বছর পার হতে চললো। আমরা একটা নতুন বাংলাদেশ পেয়েছি অনেক শহীদের রক্তের বিনিময়ে। আজ আমরা স্বাধীনভাবে কথা বলতে পারছি, এই অবস্থানটা অবশ্যই সহজে আসেনি। তবে আমি মনে করি, আমরা যে প্রত্যাশা নিয়ে আন্দোলন শুরু করেছিলাম, সেখান থেকে এখন অনেকেই কিছুটা সরে এসেছি। অনেকেই ব্যক্তি স্বার্থে বিভক্ত হয়ে পড়েছি। অথচ আমরা সবাই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে শুরু থেকে আন্দোলনে ছিলাম, এক সঙ্গে লড়েছিলাম। কিন্তু বিজয়ের পর আমরা সেই একতা ধরে রাখতে পারিনি। বিজয়টা ভাগাভাগি করে নিতে শুরু করেছি- কে কতটা ক্রেডিট নেবে, কোন দল কতটা সফলতার মালিকানা দাবি করবে- এই প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেছে। কিন্তু কথা ছিল, ‘আমরা একটা সুন্দর ও বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়ব।’ সেই প্রত্যাশা অনেকটাই অপূর্ণ থেকে গেছে। শহীদদের যথাযথ সম্মান দেওয়া হয়নি। অনেক শহীদ পরিবার এখনও প্রাপ্য স্বীকৃতি পায়নি। আহতদের জন্য সঠিক চিকিৎসাব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়নি, এখনও অনেক জায়গায় তাদের সুচিকিৎসা নিশ্চিত হয়নি। এই প্রত্যাশার ঘাটতিটা আমাদের মেনে নেওয়া উচিত না। কারণ এই আন্দোলনের মূল শক্তি ছিল- একটা ফ্যাসিস্টমুক্ত বাংলাদেশ গড়া, একটা সুন্দর বাংলাদেশ গড়া। অথচ যেই ফ্যাসিস্ট শক্তি আমাদের ওপর গুলি চালিয়েছে, আমাদের মানুষ হত্যা করেছে- তারা এখনও বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে বসে আছেন। এটা তো আমাদের শহীদদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা। আমরা হত্যাকারীদের বিচার চেয়েছিলাম। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, আমরা বিচারটা আবার সেই হত্যাকারীদের হাতেই তুলে দিয়েছি। তাহলে ন্যায়বিচার কীভাবে হবে? 

বাসস: বিশ্ববিদ্যালয় সংস্কারে প্রশাসনের কাছে আপনার প্রত্যাশা কেমন?

তাজমিন রহমান: আমার বিশ্ববিদ্যালয় যেন এক এতিম সন্তানের মতো- যার কোনো অভিভাবক নেই। প্রতিবার নতুন প্রশাসন আসে, নিজেদের স্বার্থে বিশ্ববিদ্যালয়টিকে ব্যবহার করে, কিন্তু শিক্ষার্থীদের জন্য কিছুই রেখে যায় না। ইতিহাস বারবার প্রমাণ করেছে, যারা আন্দোলন-সংগ্রামের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসে, তারাই ক্ষমতায় পৌঁছে অতীতের ত্যাগ ভুলে যায়। 

সম্প্রতি ঘটে যাওয়া জুলাই মাসের গণআন্দোলন, সেই ট্র্যাজেডি ও রক্তের দামে কেনা প্রত্যয়ের প্রতিফলন আমরা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনে দেখতে পাই না। প্রশাসন এখন ব্যস্ত বিভিন্ন উদ্বোধনী ও বিদায় অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেওয়া নিয়ে। অথচ আমাদের চাওয়া ছিল একটি শিক্ষার্থীবান্ধব প্রশাসন, যারা শিক্ষার্থীদের অধিকার, চাহিদা ও সমস্যাকে গুরুত্ব দেবে।

আজও ক্যাম্পাসের নিরাপত্তা প্রাচীর অরক্ষিত। নেই কমপ্লিট সিসিটিভি কভারেজ। ব্যাংকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে ফি দিতে হয়। সার্টিফিকেট তুলতে গেলে হঠাৎ অজানা কারণে বিশাল অঙ্কের ‘ডিউ’ দেখানো হয়, যা আগে থেকে জানার সুযোগ থাকলে সহজে সমাধান করা যেত। ডিজিটাল প্রযুক্তির যুগেও আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এখনও চলছে সেই পুরোনো পদ্ধতিতে। শুধু তাই নয়, যে সব শিক্ষক ফ্যাসিস্ট সময়ে নিপীড়নের প্রতীক ছিলেন, তারাও এখনও বহাল তবিয়তে দায়িত্ব পালন করছেন। যারা শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে স্লোগান দিয়েছিলো ‘আর নয় হেলাফেলা, এবার হবে ফাইনাল খেলা’ তাদের অনেককেই এখনও ক্যাম্পাসে সক্রিয় দেখা যায়। আমরা চাই, প্রশাসন শিক্ষার্থীদের কণ্ঠস্বর শুনুক, বাস্তব সমস্যাগুলোর দ্রুত সমাধান করুক এবং একটি সত্যিকারের শিক্ষার্থীবান্ধব পরিবেশ গড়ে তুলুক।

বাসস: আগামী দিনে কেমন বাংলাদেশ দেখতে চান?

তাজমিন রহমান: বাংলাদেশ একটি ছোট দেশ, কিন্তু এই ছোট্ট ভূখণ্ডেই এখন চতুর্দিকে দুর্নীতি আর অনিরাপত্তার করাল ছায়া। দুর্নীতি ছড়িয়ে পড়েছে রাষ্ট্রের প্রতিটি স্তরে- শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অবকাঠামো সব ক্ষেত্রে। এর পরিণতিতে আমরা একের পর এক মর্মান্তিক ঘটনার সম্মুখীন হচ্ছি। আজ ঘর থেকে বের হয়ে আমরা নিশ্চিত নই- জীবিত ফিরে আসতে পারব কি না। দুর্নীতি এখন যেন আমাদের সমাজের রক্তে মিশে গেছে। এর প্রভাব পড়ছে সবখানে- স্কুলে, রাস্তায়, হাসপাতালে। সন্তানকে স্কুলে পাঠিয়ে লাশ হয়ে ফেরত পাওয়ার আশঙ্কা কোনো সভ্য সমাজে কল্পনাও করা যায় না। 

আমি এমন একটি বাংলাদেশ চাই, যেখানে মানুষ নিরাপদে চলাফেরা করতে পারে, শিশুদের মুখে হাসি থাকে এবং প্রতিটি নাগরিকের ন্যূনতম জীবনমান নিশ্চিত হয়।

আমাদের বিশাল সেতু, মেট্রোরেল কিংবা ঝাঁ-চকচকে অবকাঠামোর চেয়ে বেশি দরকার- জীবনের নিরাপত্তা, সাম্য, দুর্নীতিমুক্ত সমাজ ও মানসম্মত শিক্ষাব্যবস্থা।

আমার স্বপ্ন একটি বৈষম্যহীন বাংলাদেশ, যেখানে মানুষ ডাল-ভাত খেয়ে হলেও নিরাপদে বাঁচতে পারে। এটাই আমার কাছে সত্যিকারের উন্নয়ন, এটাই আমি চাই।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
সর্বজনীন পেনশন স্কিমে ভুলত্রুটি থাকলে সংশোধন করা হবে : অর্থ উপদেষ্টা
চুয়াডাঙ্গায় বিভিন্ন অনিয়মের দায়ে তিনটি প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা
মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগরের ইউপি চেয়ারম্যান ও তার স্ত্রী’র বিরুদ্ধে দুদকের মামলা
ঢাকার উদ্দেশে কুয়ালালামপুর ছেড়েছেন প্রধান উপদেষ্টা
অধস্তন আদালতের নিয়ন্ত্রণ ও পৃথক সচিবালয় নিয়ে হাইকোর্টের রায় ২ সেপ্টেম্বর
রোহিঙ্গা ইস্যুতে মালয়েশিয়ার দূতের সঙ্গে ড. খলিলুর রহমানের আলোচনা
ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলের দুই গ্রাম দখলের দাবি রাশিয়ার
বাকৃবিতে 'বাংলাদেশে বৃহৎ পরিসরে ফুড ফর্টিফিকেশন’ শীর্ষক কর্মশালা
রংপুরে তিস্তা বাঁধে ধস, শঙ্কায় হাজারো পরিবার
বাংলাদেশ জাতীয় কর্তৃপক্ষের চট্টগ্রাম কাস্টমসের রাসায়নিক ল্যাব পরিদর্শন ও প্রশিক্ষণ 
১০