মোতাহার হোসেন
ঢাকা, ২ আগস্ট, ২০২৫ (বাসস) : ‘কেন্দ্রীয় কারাগারে মেঘনা বিল্ডিংয়ের ৩/২ নম্বর রুমে ৫ আগস্ট দুপুর তিনটার কিছু পরে, হাসিনার পতনের সংবাদ পাই। তখন আমার শরীরে ভয়ংকর জ্বর। চোখ মেলে তাকানোরও শক্তি নেই। সবাই থালাবাসন বাজিয়ে উল্লাস করছিল। আমার চোখে ছিল আনন্দের অশ্রু। মনে মনে ভাবছিলাম আজ থেকে মাতৃভূমি আমাদের জন্য নিরাপদ। গণভবন জনতা দখল করে রাষ্ট্রের মালিকানা বুঝে নিয়েছে। রাস্তাঘাটে চলতে এখন আর গ্রেফতার বা হামলার ভয়ে বুক কাঁপে না। কিন্তু তিন দিন গুম থাকা অবস্থার ট্রমা থেকে এখনও বের হতে পারিনি। প্রায়ই ঘুম থেকে চিৎকার করে লাফিয়ে উঠি, স্বপ্নে দেখি—চোখ আর হাত বাঁধা অবস্থায় আমাকে ক্রসফায়ার দিতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।’
জুলাই গণআন্দোলনের অন্যতম সংগঠক মাছুম বিল্লাহ বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থাকে (বাসস) দেয়া এক সাক্ষাৎকারে আন্দোলনের দিনগুলোর সেই দুঃসহ স্মৃতি তুলে ধরেন।
বাংলাদেশের ইতিহাসে ছাত্র আন্দোলনের ভূমিকা কখনোই অস্বীকার করার উপায় নেই। ২০২৪ সালে সুপ্রিম কোর্টের রায়ে কোটা ব্যবস্থা পুনর্বহাল হওয়াকে কেন্দ্র করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে যে তীব্র প্রতিবাদের আগুন জ্বলে ওঠে, তা অল্প সময়েই রূপ নেয় সর্বস্তরের ছাত্রসমাজের গণজাগরণে। এই আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক ছিলেন মাছুম বিল্লাহ, যিনি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এবং স্যার এ এফ রহমান হল শাখার সভাপতি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের এই মেধাবী শিক্ষার্থী আন্দোলনের শুরু থেকেই মাঠে ছিলেন, নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়নের মুখোমুখি হয়েছেন।
পুলিশের গুলিতে সহযোদ্ধাদের মৃত্যু, নিজে নির্মম নির্যাতনের শিকার হওয়া, গুম হয়ে থাকা ও ‘ক্রসফায়ার নাটক’ পেরিয়ে ফিরে আসা—এইসব ভয়াবহ অভিজ্ঞতা তাকে শুধু আন্দোলনের একজন কর্মী নয়, বরং ২০২৪-২৫ সালের ছাত্র রাজনীতির এক জীবন্ত সাক্ষ্য হিসেবে দাঁড় করিয়েছে।
এই বিশেষ সাক্ষাৎকারে মাছুম বিল্লাহ খোলামেলা ভাষায় তুলে ধরেছেন আন্দোলনের শুরু, উত্তাল দিনগুলো, রাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়া, বিএনপির সাংগঠনিক ভূমিকা এবং তার দৃষ্টিতে বাংলাদেশ কোন পথে হাঁটছে সেই মূল্যায়ন।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন বাসসের রিপোর্টার মোতাহার হোসেন।
বাসস: আপনি কোন রাজনৈতিক দলের সঙ্গ যুক্ত? রাজনীতিতে কীভাবে এলেন?
মাছুম বিল্লাহ: আমি বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের আদর্শে বিশ্বাসী। এখন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল কেন্দ্রীয় সংসদের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছি। একই সঙ্গে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যার এ. এফ. রহমান হল শাখা ছাত্রদলের সভাপতি। আমি পারিবারিকভাবেই জাতীয়তাবাদী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। আমার বাবা প্রায় ১৫ বছর যাবৎ ওয়ার্ড বিএনপির সভাপতি ছিলেন। বাবার আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে আমি শহীদ রাষ্ট্রপতি ও বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতার ঘোষক জিয়াউর রহমানের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হই।
বাসস: কোটা আন্দোলনের যৌক্তিকতা সম্পর্কে কিছু বলুন। কোন সময় থেকে এই আন্দোলন চূড়ান্ত পরিণতির দিকে এগিয়ে যেতে থাকে?
মাছুম বিল্লাহ: বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই আন্দোলনের যৌক্তিকতা ছিল শতভাগ। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার এই যুগে উন্নত বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যেতে হলে সরকারি চাকরিতে অবশ্যই মেধাবীদের অগ্রাধিকার দিতে হবে। আমি মনে করি, দেশে আমলাতান্ত্রিক স্থবিরতার অন্যতম কারণ হল ৫৬% কোটার ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া।
বাসস: কোটা সংস্কার আন্দোলন কয়েকটা ধাপে এগিয়েছে। এ আন্দোলনে আপনি কীভাবে যুক্ত হলেন? আপনি আন্দোলনের কোন সময়টাতে সবচেয়ে বেশি সক্রিয় ছিলেন? শুরু থেকেই আন্দোলনের প্রতি আপনার কি সমর্থন ছিল?
মাছুম বিল্লাহ: কোটা বিরোধী আন্দোলন প্রথম শুরু হয় ২০১৩-২০১৪ সালে। আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী। যতদূর মনে পড়ে, বিশ্ববিদ্যালয়ে কোটা বিরোধী সাধারণ শিক্ষার্থীদের প্রথম মিছিলেই অংশ নিয়েছিলাম। এরপর ২০১৮ সালে জোরালো কোটা বিরোধী আন্দোলন হয়, সেই আন্দোলনের তীব্রতায় সরকার এক পর্যায়ে কোটা বিলুপ্তির দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয়। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় ২০২৪ সালের ৫ জুন কোটা বাতিলের উচ্চ আদালতের রায় আপিল বিভাগ বাতিল করে দিলে, পুনরায় আমরা রাজপথে নামতে বাধ্য হই। এই আন্দোলন চূড়ান্ত পরিণতি লাভ করে ৫ আগস্ট।
বাসস: ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে আদর্শিক দ্বন্দ্ব রয়েছে। কিন্তু এ আন্দোলনে সবাই একজোট হয়ে অংশ নিয়েছে। এ বিষয়টি আপনার কেমন লেগেছে? এর পেছনে কী কারণ থাকতে পারে বলে মনে করেন?
মাছুম বিল্লাহ: মহান মুক্তিযুদ্ধসহ যৌক্তিক যেকোন আন্দোলনে বাংলাদেশের সব শ্রেণি পেশার মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়ে আন্দোলন করেছে। ৯০-এর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন মূলত সফল হয়েছিল ছাত্রদের ঐক্যের কারণে। আপনি জানেন, মইনউদ্দিন-ফখরুদ্দিনের সেনাসমর্থিত সরকারের বিরুদ্ধেও একজোট হয়ে আন্দোলন করেছে ছাত্র সংগঠনগুলো।
কিন্তু কোটা আন্দোলনের বাস্তবতা পুরোপুরি ভিন্ন। যেখানে রাষ্ট্রীয় বাহিনী ছাড়াও আমাদের প্রধান প্রতিপক্ষ ছিল সরকারি দল আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসী ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ। নিশ্চয়ই দেখে থাকবেন, কী নির্মমভাবে—প্রথমে কোটা বিরোধী, তারপর বৈষম্যের বিরোধী আন্দোলনের শিক্ষার্থীদের ওপর তারা বারবার হামলা করেছে। দেশের কোটি শিক্ষার্থীর সেন্টিমেন্টের বিরুদ্ধে গিয়ে তারা নিজেদের ভাইদের হত্যা করেছে, শুধুমাত্র ভোটবিহীন একটি সরকারের ইগো রক্ষার জন্য। যা জাতির জন্য অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। যদিও পরবর্তীতে তারা আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছে।
বাসস: আন্দোলনে কোন কোন জায়গায় চ্যালেঞ্জ ছিল বলে আপনার মনে হয়?
মাছুম বিল্লাহ : একটা ভোটবিহীন সরকার ১৬ বছর বাংলাদেশকে শোষণ করেছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিক্রি করে। সাময়িক বেগতিক অবস্থায় পড়ে ২০১৮ সালে কোটা বিলুপ্তির দাবি মেনে নিলেও বিনা ভোটে চতুর্থবার ক্ষমতায় এসে শেখ হাসিনা আপিল বিভাগকে দিয়ে উচ্চ আদালতের রায় বাতিল করে তার ইগোর বিষয়টি প্রাধান্য দেন। কোটা বিরোধীদের দমন করতে তিনি সর্বশক্তি প্রয়োগ করেন। স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে গিয়ে একটি ছাত্র-গণঅভ্যুত্থান সফল করার প্রতিটি পর্যায়ই ছিল অনেক বড় চ্যালেঞ্জ।
বাসস: কোন সময়টাতে এই আন্দোলন চূড়ান্ত রূপ লাভ করে বলে মনে করেন?
মাছুম বিল্লাহ: ৫ জুন ২০২৪, সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ কোটা বাতিলের হাইকোর্টের রায় বাতিল করে কোটা পুনর্বহালের আদেশ জারি করে। সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের ইচ্ছা অনুযায়ী আপিল বিভাগের এই হঠকারী সিদ্ধান্তের পরই মূলত আন্দোলন চূড়ান্ত পরিণতির দিকে ধাবিত হতে শুরু করে। আন্দোলনের এক পর্যায়ে স্বৈরাচার শেখ হাসিনা আমাদেরকে ‘রাজাকারের সন্তান’ আখ্যা দিয়ে কটাক্ষ করেন, তারপরই এই আন্দোলন দাবানলের মতো বিস্তার লাভ করতে শুরু করে।
বাসস: ঠিক কী কারণে কোটা বাতিলের এই আন্দোলন সরকার পতনের আন্দোলনের দিকে ধাবিত হয় বলে মনে করেন?
মাছুম বিল্লাহ: দেখুন, ভোটবিহীন স্বৈরাচার শেখ হাসিনা সরকারের প্রতি দেশবাসীর অনাস্থা দীর্ঘ সময়ের। সরকারি বাহিনীর গুম-খুন এবং কারাগারের ভয়ে সাধারণ মানুষ প্রকাশ্যে সরকারের সমালোচনা করতে সাহস পেত না। বিএনপি ছাড়া কোন রাজনৈতিক দলকেও সরকারের বিরুদ্ধে রাজপথে দেখা যায়নি। ছাত্রদের যৌক্তিক আন্দোলনেও বিএনপির সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ তুলে সরকার নানাভাবে আন্দোলনকারীদের দমনের চেষ্টা করে। সাধারণ শিক্ষার্থীর ব্যানারে কোটা বাতিলের আন্দোলনে আমরা ছাত্রদল সর্বাত্মকভাবে অংশগ্রহণ করি, কিন্তু কৌশলে আমরা মিডিয়া এড়িয়ে চলতাম যাতে সরকার এই আন্দোলনকে ছাত্রদলের আন্দোলনের ট্যাগ দিয়ে বড় ধরনের গণহত্যা চালাতে না পারে।
কিন্তু ১৬ জুলাই রংপুরে আবু সাইদ এবং চট্টগ্রামে ওয়াসিম, রাব্বি, ফারুকসহ সারাদেশে পুলিশের গুলিতে ৬ জন নিহত হওয়ার পর দেশব্যাপী বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। সারাদেশে ছাত্র হত্যার দায় সরাসরি শেখ হাসিনার। পরদিন ১৭ জুলাই সারাদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে পুলিশের সঙ্গে আমাদের দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। আমরা সর্বাত্মক চেষ্টা করি যাতে ঢাবি প্রশাসন তাদের নির্দেশনা মত হল খালি করতে না পারে। এক পর্যায়ে পুলিশের টিয়ার গ্যাস ও রাবার বুলেটের সামনে টিকতে না পেরে অধিকাংশ শিক্ষার্থী হল ছেড়ে চলে যায়।
মূলত ১৬ জুলাই সারাদেশে শিক্ষার্থী হত্যার পর, ওইদিন রাতেই বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের নির্দেশে ছাত্রদল এই আন্দোলনকে সরকার পতনের আন্দোলনে রূপ দেওয়ার ছক তৈরি করে। সেই ছক বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ১৭ জুলাই থেকে আমরা সর্বাত্মকভাবে রাজপথে ঝাঁপিয়ে পড়ি।
১৭ জুলাই সন্ধ্যায় বাসায় ফেরার পথে চাঁনখারপুল মোড় থেকে আওয়ামী লীগের ওত পেতে থাকা সন্ত্রাসীরা আমাকে তুলে নিয়ে নির্মম নির্যাতন করে। এক পর্যায়ে মৃত ভেবে চকবাজার থানা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করে। পরে সেখান থেকে ডিবি পুলিশ আমাকে নিয়ে চারদিন গুম করে রেখে অমানুষিক নির্যাতন করে। এরপর ২১ জুলাই গভীর রাতে আমাকে নিয়ে অস্ত্র উদ্ধারের নাটক সাজিয়ে সেই অস্ত্র রিকভারি দেখিয়ে মামলায় আদালতে তোলে।
বাসস: ১৭ জুলাই মূলত কী ঘটেছিল আপনার সঙ্গে?
মাছুম বিল্লাহ: ১৭ জুলাই রাত আনুমানিক ১১:৪০। গামছা দিয়ে শক্ত করে চোখ বাঁধা এবং দু’হাত পিছমোড় করে হাতকড়া পড়ানো অবস্থায় ছিলাম আমি। আমাকে ডিবি পুলিশের হেফাজতে দেওয়ার সময় চকবাজার থানার ওসির রুমে বসে লালবাগ জোনের সরকারি কমিশনার বাবু বলছিলেন, ‘খুব ইচ্ছে ছিল, নিজে তোর মাথায় রিভলবার ঠেকিয়ে গুলি করে একটা অন্তত ছাত্রদল মারার! কিন্তু ভাগ্যগুণে আজকে তুই আমার হাত থেকে বেঁচে গেলি, তোর যা করার, উনারা করবেন।’ সাদা পোশাকের একজন অফিসার আমার চোখ বেঁধেছিল এবং অন্য একজন হাতকড়া পড়িয়েছিল। কিছুদূর হাঁটিয়ে নিয়ে গাড়িতে ওঠানোর পর বুঝতে পেরেছিলাম, সব মিলিয়ে মোট ৬/৭ জন আমাকে নিতে এসেছে।
পুলিশে দেওয়ার আগে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা এমনভাবে আমার নাক ফাটিয়েছিল যে মাথা একটু নিচু করলেই নাক দিয়ে রক্ত ঝরত। তাই ঘাড় উঁচু করে রাখতে রাখতে ঘাড় ব্যথা হয়ে গিয়েছিল। বাম পায়ের হাঁটুতেও অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছিল। সব মিলিয়ে আমি তখন ব্যথায় গোঙাচ্ছিলাম। সঙ্গে ছিল চোখ বাঁধা অবস্থায় যেকোন সময় গুলি করে দিতে পারে সেই ভয়।
রাস্তায় গাড়ি কিছুদূর যেতেই আমার দু’পাশে ও পেছনে ক্লিক করে তিনটা শব্দ হলো! আমি ‘ও আল্লাহ’ বলে চিৎকার দিলাম এবং জোরে কলেমা পড়ে কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে বললাম, ‘আল্লাহর ওয়াস্তে আমাকে গুলি কইরেন না।’ এরই মধ্যে নাক দিয়ে রক্ত ঝরে গলা পর্যন্ত ভিজে গেছে। গাড়িতে আমার বাম পাশের সিটে বসা অফিসার কিছু একটা দিয়ে আমার মুখের রক্ত পরিষ্কার করে দিয়ে ঘাড় উঁচু করে রাখতে বললেন। সামনে থেকে একজন খুব কর্কশ গলায় ধমক দিয়ে বললেন, যেন আর এভাবে চিৎকার না করি। সঙ্গে ছাত্রদলের ১৪ গোষ্ঠী তুলে গালি দিলেন।
১৭ জুলাই ২০২৪। ওইদিন সারাদিন আমরা ঢাবি ক্যাম্পাসে সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশের বিরুদ্ধে লড়াই করি যেন তারা হলগুলো বন্ধ করতে না পারে। সন্ধ্যা ৭টার কিছু পরে বাসায় ফেরার পথে চাঁনখারপুলে ওত পেতে থাকা আওয়ামী সন্ত্রাসীরা সদলবলে আমার আর হলের ছোটভাই হায়াতের ওপর আক্রমণ করে। হায়াতকে তারা চিনতে পারেনি এবং তার সঙ্গে মোবাইল ছিল না বিধায় তার পরিচয় শনাক্ত করতে পারেনি।
আমাকে ধরেই প্রথমে মোবাইল, মানিব্যাগ আর পায়ের জুতা ছিনিয়ে নেয়। তারপর মাটিতে ফেলে যে যেভাবে পারে মারতে থাকে। এভাবে ৮/১০ মিনিট মারার পরে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক আক্তার হোসেন পরামর্শ দেয় উপরে একটা রুমে নিয়ে আমাকে যা করার করতে, কারণ এখানে নাকি সাংবাদিক চলে আসতে পারে। তখনই বুঝে গিয়েছিলাম, আমি আর বেশিক্ষণ বাঁচব না।
৭/৮ জন মিলে আমাকে পুরাতন আফতাব হোটেলে (বর্তমানে আবাসিক হোটেল) নিয়ে যায়। সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় কেউ বলছে আমার চোখ তুলে ফেলতে হবে, কেউ বলছে হাত-পা কেটে ফেলতে হবে। ঘটনার একদিন আগে চাঁনখারপুল মোড়ে স্থানীয় আওয়ামী লীগের সঙ্গে ঢাবি ছাত্রদের সংঘর্ষে মাথায় আঘাত পাওয়া এক লীগ সন্ত্রাসী বলে উঠল, ‘কোন কাহিনি চলবে না, জবাই করে লাশ কুত্তা দিয়ে খাওয়াবো!’ আমি যত পারি কলেমা পড়ে নিচ্ছিলাম।
দ্বিতীয় তলায় তারা আমাকে ছোট একটা রুমে আটকে রেখে স্থানীয় বিএনপির বিভিন্ন লোকের নাম ও তাদের অবস্থান জানাতে চায়। আমি কাউকেই চিনি না বললে, ২/৩ জন মিলে চরথাপ্পড় মারতে থাকে। যাদের কথা বলেছে আসলেই তাদের কাউকে চিনতাম না। আমাকে বসানো হয়েছিল বিছানার ওপর। ওরা চেয়ারে বসেছিল। এভাবে ৩০/৪০ মিনিট জিজ্ঞাসাবাদের পর দুজন পুলিশ এবং ক্রিকেট স্ট্যাম্পসহ আরো দুজন আসে উপরে। আগে থেকে ছিল ৩ জন। তারা এসেই রুমের লাইট বন্ধ করে এলোপাতাড়ি স্ট্যাম্প দিয়ে আঘাত করতে থাকে। আমি জোরে চিৎকার করতে থাকি।
বাম পায়ের হাঁটুতে ৩/৪টা আঘাত খুব জোরে লাগে। ফলে, পরবর্তী ৮/১০ দিন আমি ওই পায়ে ভর দিতে পারিনি এবং ভাঁজ করতে পারিনি। আমাকে আটকে রাখা রুমটা ছিল ছোট, আর হামলকারী বেশি হওয়ায় খুব বেশি সুবিধা করতে পারেনি। আমাকে বেদম প্রহারের সময় দুই পুলিশ একবারের জন্যও তাদের থামাতে চেষ্টা করেননি! লাইট বন্ধ থাকায় স্ট্যাম্পের ২/৩টা আঘাত তাদের লোকজনের গায়েও লাগে। তখন তারাই মার থামাতে বলে এবং রুমের লাইট অন করে।
স্ট্যাম্পের আঘাতেও ওই সময়ে খুব বেশি কষ্ট পাইনি, কারণ পুলিশ দেখে আমি এইটুকু আশ্বস্ত হয়েছিলাম যে আমাকে অন্তত মারবে না। এক তো পুলিশ আসছে, তার ওপর ধারালো কোনো অস্ত্র নেই, সুতরাং মেরে ফেলার চান্স খুব কম। পুলিশ যখন আমার হাতে হাতকড়া লাগায় তখন মনে মনে ‘আলহামদুলিল্লাহ’ পড়ি, ভাবি আল্লাহ নিশ্চিত লাশ হওয়া থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছেন। গ্রেফতার তো আগেও চারবার হয়েছি।
কিন্তু আমার জীবনের বিভীষিকাময় সেই রাতে মৃত্যুভয় ফিরে আসতে দুই ঘণ্টাও লাগেনি। নিয়ম অনুযায়ী চকবাজার থানা থেকে পরদিন আমাকে আদালতে চালান করার কথা, কিন্তু রাতেই তারা আমাকে চোখ-হাত বেঁধে কুখ্যাত ডিবি পুলিশের হাতে তুলে দেয়।
ডিবির গাড়ি যত সামনে যাচ্ছিল, আমার কাঁপুনি তত বাড়ছিল। গাড়িতে অফিসারেরা দেশের কোথায় কোথায় আজকে লাশ পড়েছে সেই গল্প করছিল। আমি ধরেই নিয়েছিলাম যে দূরে কোথাও নিয়ে আমাকে ‘ক্রসফায়ার’ দেওয়া হবে। দোয়া-দরূদ যা জানতাম সব একে একে পড়ে নিচ্ছিলাম। এরই মধ্যে এক অফিসার হঠাৎ বলে উঠল, ‘আল্লাহর ওপর ভরসা করেন, তাঁর হুকুম ছাড়া কিছু হয় না।’ আসলেই আল্লাহর হুকুম ছাড়া কিছু হয় না।
ভয়ে শরীরের কাঁপুনিতে আমার কণ্ঠ আটকে যাচ্ছিল। বহু কষ্টে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ‘আমাকে কি ক্রসফায়ার দিতে নিয়ে যাচ্ছেন? দয়া করে আমার চোখটা খুলে দেন, নয়তো ভয়েই আমি মারা যাব।’ এবার পেছন থেকে এক অফিসার ধমক দিয়ে আমাকে চুপ করতে বলল, হলে মুখও বেঁধে ফেলবে বলে হুমকি দেয়।
একই সাথে চোখ আর হাত বেঁধে রাখার মত অসহায়ত্ব সম্ভবত জীবিত অবস্থায় আর নেই। গাড়ি কোনদিকে যাচ্ছিল, অনুমান করার উপায় ছিল না। তবে টোল দিচ্ছে শুনে অনুমান করেছিলাম হয়তো মাওয়া না হয় চট্টগ্রামের রাস্তা। মোট দু’বার টোল দিয়েছিল—সম্ভবত একবার যেতে, আরেকবার আসতে। মাঝখানে ২০/২৫ মিনিটের জন্য গাড়িতে আমার সঙ্গে একজন রেখে বাকিরা কোন আসামিকে খুঁজতে যায়, কিন্তু না পেয়ে আবার রওনা দেয়।
মাইকে ফজরের আজান শোনার ১০/১৫ মিনিট পর কোথাও একটা জায়গায় গাড়ি থামায়। আমার সঙ্গে গাড়িতে একজন বসে ছিল, বাকিরা নেমে যয়া। ৪/৫ মিনিট পর দুজন এসে আমার চোখের বাঁধন ঠিক আছে কি না চেক করে গাড়ি থেকে নামায়। আব্বা-আম্মা, ভাইবোন আর প্রিয় মানুষটার চেহারা মনে করে অঝোরে কাঁদছিলাম। বাম পাশে একজনের কাঁধে ভর দিয়ে আমাকে নিয়ে যাচ্ছিল। কিছুদূর হাঁটার পর বলল, ‘এখন সিঁড়ি।’ ৩/৪টা ধাপ কাঁধে ভর দিয়ে উঠে একটা ছোট রুমে নিয়ে প্রথমে হাতকড়া, তারপর চোখ খুলে দিয়ে ফ্লোরে বসতে বলল। কয়েক মিনিট চোখ ঝাপসা দেখছিলাম।
সেখানে রাত না দিন বুঝতে পারছিলাম না। হাতকড়ার চাপে দুই হাতের কব্জি ফুলে মোটা হয়ে গিয়েছিল। দুই কাঁধেই প্রচণ্ড ব্যথা অনুভব করছিলাম তখন। মৃত্যুর আতঙ্কে সেদিকে মনোযোগ ছিল না এতক্ষণ। ছোট দরজার একটা রুম, খুব উঁচু। উপরে একটা বাদামি আলোর বাল্ব আর একটা সিসিটিভি ক্যামেরা। নিচে ফ্লোরে ২ লিটারের একটা ফ্রেশ পানির বোতল, অর্ধেক ভরা। আমাকে রুমে রেখেই লোকটা দরজা লক করে দিয়ে চলে গেল। মুখে মাস্ক এবং মাথায় ক্যাপ থাকায় চেহারা দেখতে পাইনি। যাওয়ার সময় বলে, ‘আপনার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হবে স্যার এলে।’ গলা শুকিয়ে কাঠ হয়েছিল। থানার গারদের মত খাবার আর পানি দেবে মনে করে বোতলের প্রায় সবটুকু পানি একবারে খেয়ে ফেলি। লিফটের মত ছোট একটা রুমে আমি একা বন্দি। বাইরে থেকে কোনো শব্দও ভেতরে আসে না। চিকন লম্বা একটা ভেন্টিলেটর অনেক উপরে, সিসিটিভি ক্যামেরার পাশে—অক্সিজেন দেওয়ার জন্য রেখেছে সম্ভবত।
কিছুক্ষণ বসে থাকার পর মৃত্যুর আতঙ্ক কিছুটা কমতেই ক্ষুধার যন্ত্রণা শুরু হয়। গ্রেফতারের দিন দুপুরে পুরোপুরি না খাওয়া ছিলাম আমি, কারণ ক্যাম্পাসে সেদিন খাওয়ার মত কিছুই ছিল না। ইচ্ছে ছিল বাসায় গিয়ে আগে পেটভরে ভাত খাব, তারপর গোসল করব। সন্ধ্যায় গ্রেফতারের পর দু’বার পানি ছাড়া কিছুই খেতে দেয়নি আমাকে। ছোটবেলা থেকেই বেশি ক্ষুধা লাগলে হাত-পা কাঁপতে থাকে আমার। তখন কাঁপুনি যেন আরো বেড়ে গিয়েছিল।
২/৩ মিনিট পরপরই সিসিটিভিতে খাবারের জন্য ইশারা করেছি বহুবার, কেউ আসেনি খাবার নিয়ে। একটা পর্যায়ে মনে হচ্ছিল, ক্ষুধার যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে মরেই যাব। ঠিক সেদিন আমি উপলব্ধি করেছিলাম—খাবারের জন্য কেন মানুষ খুন পর্যন্ত করে।
অবশেষে ৪/৫ ঘণ্টা পর একজন পঞ্চাশোর্ধ্ব লোক দরজা খুলে এক প্লেট ভাত, ডিম ভুনা, ডাল আর এক বোতল পানি দিয়ে গেল। খাবার দেখে আমি ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকি। সেই সময়টা মনে পড়লে এখনো আমার চোখে পানি চলে আসে।
প্লেটের ভাতে পেট না ভরলেও শরীরের কাঁপুনি বন্ধ হয়েছিল। খাওয়া শেষ করতেই একজন এসে আমাকে যথারীতি চোখ-হাত বেঁধে অফিসারের রুমে নিয়ে যায়। সেখানে গিয়ে চোখ খুলে দিলেও হাতকড়া খোলেনি। চোখ খুলে দিতেই বোঝার চেষ্টা করি, আমি আসলে কোথায়। বাইরে কিছুই দেখার সুযোগ ছিল না। তবে কিছু ফাইল দেখে বুঝে গিয়েছিলাম যে ডিবির কোন অফিসে আছি।
জিজ্ঞাসাবাদের সময় আমার ফোন অফিসারের হাতেই ছিল। চকবাজার থানা থেকেই ফোনের পাসওয়ার্ড রিমুভ করে নিয়েছিল। ছাত্রদলের সব হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত ছিলাম বিধায়, অফিসার আমার ফোন ঘেঁটে অনেক তথ্য বের করে সে বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে। প্রথমেই বলে, ‘তুমি শিক্ষিত ছেলে, আশা করি টর্চার রুমে নিতে হবে না। এমনিতেই তোমার শরীরের অবস্থা খারাপ, আমাদের এখানে চিকিৎসার ব্যবস্থাও নাই। টর্চার রুমে নিলেতো স্ট্রোক করবা। যা জিজ্ঞাসা করব, সত্যি সত্যি বলবা।’ আমি মাথা নেড়ে ঠিক আছে বলি।
লম্বা সময় ধরে চলতে থাকে জিজ্ঞাসাবাদ। মাঝখানে আমাকে চা দেয়। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী—এটা জানার পরে সবাই আমাকে ‘তুই’ থেকে ‘তুমি’ বলে সম্বোধন করতে শুরু করে।
জিজ্ঞাসাবাদ শেষে আমি অফিসারের কাছে অনুরোধ করে বলি, ‘ভাই, বাড়িতে আমার আব্বা-আম্মা দু’জনই অসুস্থ। দেশে খুব গণ্ডগোল চলছে। প্রায় ২৪ ঘণ্টা হয়ে গেছে, তারা জানে না আমি কোথায়, বেঁচে আছি নাকি মরে গেছি। দয়া করে বাড়িতে একটা ফোন দিয়ে বলেন যে আমি আপনাদের হেফাজতে আছি। নয়তো সন্তানের চিন্তায় তারাও হয়তো মারা যাবে!’
তখন অফিসার একটু রাগ করে উত্তর দেয়, “তুমি এখনও ‘নন-এন্ট্রি’। গ্রেফতার দেখাব, না মেরে লাশ গুম করব—সেই সিদ্ধান্ত এখনও আসেনি।” এসব বলেই পাশে থাকা একজনকে নির্দেশ দেয় আমাকে নিয়ে যেতে।
সেই লোক আবার আমার চোখ বেঁধে বাম পাশে ধরে সেই রুমটায় নিয়ে যায়। আব্বা-আম্মার কথা ভেবে চোখ দিয়ে অঝোরে পানি বেয়ে পড়ছিল তখন। সারাটা জীবন কষ্ট ছাড়া আর কিছুই দেইনি পরিবারকে।
হাতকড়া আর চোখ খুলে রুমে ঢুকিয়ে দিয়ে লোকটা আমাকে বলে, ‘আগামীকাল এই সময় আবার খাবার দেওয়া হবে!’ যদিও খাবার হজম হয়ে তখনই ক্ষুধা লেগে গিয়েছিল আমার। কিন্তু আমাকে মেরে ফেলার সিদ্ধান্ত এখনো পেন্ডিং শুনে খাওয়ার চিন্তা উধাও হয়ে গিয়েছিল। ২৪ ঘণ্টা যে কত দীর্ঘ সময়—সেদিন হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিলাম। এক সেকেন্ডের জন্যও ঘুম আসেনি। শুধু একটাই চিন্তা—কখন জানি ক্রসফায়ার দিয়ে দেয়। দিন-রাত কাঁদতাম আর আল্লাহর কাছে জীবনটা ভিক্ষা চাইতাম। কবর ছাড়া আর কোথাও মানুষ এতটা অসহায় থাকে না।
পরের দিন আল্লাহ আমার ফরিয়াদ কবুল করেন। দ্বিতীয় দিনেও একই খাবার দেওয়া হয় এবং খাবার শেষে অফিসারের রুমে নিয়ে যাওয়া হয়, শুধু হাতকড়া পড়িয়ে। প্রথম দিনের মত আমি অফিসারের রুমের টয়লেটে যাই। তারপর শুরু হয় মানসিক অত্যাচার। ৩০ মিনিট মত জিজ্ঞাসাবাদ করার পরে অফিসার বলেন, ‘তোমাকে নিয়ে এখন অপারেশনে বের হব!’ শুনেই আচমকা বৈদ্যুতিক শকের মতো বুকে একটা জোরালো ধাক্কা লাগে। মনে হচ্ছিল—আমাকে এখানেই গুলি করে মেরে ফেলুক। আয়োজন করে আমাকে জানিয়ে কেন মারতে হবে। শরীরের কাপুনিতে দাঁতে দাঁত লেগে কটকট শব্দ হচ্ছিল।
হঠাৎ সামনে অফিসের একজনকে পেয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘ভাই, এখন দিন নাকি রাত?' তিনি উত্তর দেন, ‘দুপুর।’ তখন মনে হল—ক্রসফায়ার তো রাতে দেয়, তাহলে দুপুরে কোন অপারেশনে নিয়ে যাবে?
যাহোক, আমার ওপর আল্লাহর সবচেয়ে বড় রহমত বর্ষিত হয়েছিল সেদিন। অফিসারের সঙ্গে অপারেশনে যাবে এমন দুজনের খাওয়া হয়নি তখনও, তাই বের হতে দেরী হচ্ছিল। হঠাৎ দৌড়ে একজন লোক এসে হাঁপাতে হাঁপাতে বলে—ছাত্ররা নাকি ডিবি অফিস আক্রমণ করবে! ডিসি স্যার সবাইকে রেডি হতে বলেছে।
উল্লেখ্য, তখনই আমি প্রথম নিশ্চিত হই যে আমাকে ডিবি অফিসে রাখা হয়েছে। আক্রমণ হতে পারে—এমন খবর শুনেই শুরু হয় হুড়োহুড়ি। কেউ হেলমেট বের করছে, কেউ জ্যাকেট গায়ে দিচ্ছে, কেউ পায়ে গার্ড পড়ছে, একজনকে দেখলাম বন্দুক লোড করছে। এমতাবস্থায় আমার দিকে কেউ নজরই দিচ্ছে না। এরই মধ্যে একজন ছোট অফিসার আমার দিকে ইশারা করে অফিসারকে জিজ্ঞাসা করে, ‘স্যার, এরে কি করব?' অফিসার বলেন, ‘নন-এন্ট্রি খাতায় দিয়ে গারদে রেখে আস।’
এই কথা শুনে মনে মনে ‘আলহামদুলিল্লাহ’ পড়ি। কারণ গারদ মানে অনেক আসামি। এদের সঙ্গে দেখা হয়ে গেলে অন্তত মেরে ফেলতে পারবে না। চোখ বেঁধে, হাতকড়া পড়িয়ে লিফটে করে গারদে নিয়ে যাওয়া হয়। তবে উপর থেকে নিচে নামলাম নাকি নিচ থেকে উপরে উঠলাম, ঠিক বুঝতে পারিনি।
পায়ে ব্যথার কারণে ধীরে ধীরে হেঁটে গারদের সামনে যাই। সেখানে আমার চোখ খুলে দেয়। দেখি, গারদের বন্দিরা আমার দিকে তাকিয়ে আছে। এরপর তিতুমীর কলেজের বর্তমান সভাপতি ইমাম ভাই আমাকে ডাক দেন। পরিচিত লোক দেখে হৃদয়ের মধ্যে প্রশান্তির হাওয়া বয়ে যায়।
ভেতরে গিয়ে দেখি, সাবেক সভাপতি শ্রাবণ ভাই ঘুমাচ্ছেন। শ্রাবণ ভাই এবং ইমাম ভাই তখন ডিবিতে রিমান্ডে ছিলেন। তাদের দেখে মনে হচ্ছিল-সব বিপদ কেটে গেছে। জীবনের সেরা মুহূর্তগুলোর একটা ছিল গারদে যেতে পারা।
এই ভেবে আরো শান্তি পাচ্ছিলাম যে পরদিন ভাইদের রিমান্ড শেষ হবে, তারা কোর্টে গিয়ে উকিলের মাধ্যমে আমার বাসায় ফোন করে আমার বেঁচে থাকার সংবাদ দিতে পারবে। নতুন গ্রেফতার হওয়া আসামিদের কাছে জানতে পারি যে বাইরে আন্দোলন তুঙ্গে, প্রতিদিন শত শত লোক মারা যাচ্ছে। তখন আব্বা-আম্মার মানসিক অবস্থা মনে করে কান্না চলে আসে।
সেদিন রাতেই সুলতান সালাউদ্দিন টুকু ভাইকে ধরে আনে ডিবি পুলিশ। গারদে ঢুকেই ভাই আমাকে দেখে অবাক হন, কিন্তু পরক্ষণেই বুকে জড়িয়ে ধরে বলেন, ‘আমরা ভাবছিলাম, তোকে মেরে ফেলছে।’ কিছু সময় পরেই বুঝতে পারছিলাম—ভাইয়ের ওপরও অমানুষিক নির্যাতন হয়েছে। ভাই সেই রাতে নিজের ওষুধের সঙ্গে আমার জন্যও প্রয়োজনীয় ওষুধ আনার ব্যবস্থা করেছিলেন, পরিচিত এক কনস্টেবলকে দিয়ে।
পরদিন সকাল থেকেই টুকু ভাই, বাবুল ভাই, আমিনুল ভাইসহ সিনিয়র নেতাদের গারদ থেকে টর্চার সেলে নিয়ে দফায় দফায় নির্যাতন করা হয়। যখন কাউকে ডেকে নিয়ে যাওয়া হয়, বাকি সবাই ভয়ে তটস্থ হয়ে থাকত। সে এক বিভীষিকাময় সময়!
২১ জুলাই রাত তখন দেড়টা হবে। টুকু ভাইকে হাতকড়া পড়িয়ে ঝুলিয়ে নির্যাতন করা হয়েছিল বিধায় ভাইয়ের কাঁধে খুব ব্যথা করছিল। আমি তার কাঁধে ম্যাসাজ করছিলাম। ঠিক তখনই ১০/১২ জন কালো পোশাক পরা সৈনিক গারদের সামনে এসে ‘মাছুম বিল্লাহ, পিতা মো. চাঁন মিয়া’ বলে চিৎকার করতে থাকে। আমি সামনে এগুতেই তারা বের হতে বলে।
গারদের দেড়শ’র বেশি আসামির মধ্যে তখন পিনপতন নীরবতা। ভিভিআইপি সেল থেকে আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, নজরুল ইসলাম খান, রুহুল কবির রিজভী এবং কাজী সাইদুল আলম বাবুল ভাই এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিলেন। আমি গারদ থেকে বের হতেই একজন আমার হাতে হাতকড়া আর আরেকজন কালো কাপড় দিয়ে চোখ বেঁধে দেয়।
বাম পায়ে ভর দিতে পারি না বললে, দুজন সৈনিক অভিনব কায়দায় আমাকে কোলে করে নিয়ে একটা গাড়িতে বসিয়ে দরজা লক করে দেয়। মুহূর্তের মধ্যে যেন বিনা মেঘে বজ্রপাত নেমে এলো আমার জীবনে।
অফিসারদের কথাবার্তা শুনে স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম—তারা আমাকে নিয়ে অপারেশনে যাচ্ছে। আর ‘অপারেশন’ মানেই ‘ক্রসফায়ার’। আমি কিছুতেই হিসাব মিলাতে পারছিলাম না, এতগুলো সিনিয়র নেতার মাঝখান থেকে তারা আমাকে মেরে ফেলবে! যদিও হাসিনার পুলিশের দ্বারা সবই সম্ভব ছিল।
গাড়িতে উঠে বুঝতে পারি, আমি আর অল্প কিছু সময়ের অতিথি। থরথরিয়ে শরীর কাঁপছিল তখন। পাশের সিটে আরো এক আসামিকে বসানো হয়। আমরা দুজন ছাড়া আরো ৫/৬ জন সৈনিক গাড়িতে উঠেছিল। আগে-পেছনে আরো অনেক গাড়ি ছিল তা বুঝতে পারছিলাম।
গাড়ি চলে আর আমি দোয়া-দরুদ পাঠ করতে থাকি। ৫/৬ মিনিট পর গাড়ি থেমে যায়। এরপর একজন অফিসার বলে, কোন শব্দ করা যাবে না। দুই হাতে দুটো ব্যাগ দিব, ব্যাগ নিয়ে আমাদের সামনে সামনে হাঁটবেন। সাবধান, ব্যাগে যেন চাপ না লাগে। এই বলে চোখ এবং হাতকড়া খুলে দেন।
চোখ খুলে দেখি—রমনা টেনিস ক্লাবের সামনে পুরো মঞ্চ প্রস্তুত করে বসে আছে। কমপক্ষে ২০টা হাইএস গাড়ি সারি করে দাঁড়ানো রাস্তার দু’পাশে। ১০০/১২০ জন সৈনিক, ডিবি এবং র্যাবের পোশাক পরে আমাদের দিকে বন্দুক তাক করে দাঁড়িয়ে আছে।
ওই রাতেই প্রথম কারফিউ দেওয়া হয়েছিল, তাই রাস্তায় কোন মানুষজন ছিল না। আমাকে শহীদ জিয়া শিশু পার্কের গেট থেকে শাহবাগের দিকে হাঁটতে বলা হয় হাতে ব্যাগ নিয়ে। আমি ব্যাটালিয়নের সামনে হাঁটছি আর পুলিশের দু’জন মোবাইল দিয়ে ভিডিও করছে। অপর পাশ থেকে রাস্তা ক্রস করে এক অফিসার বলে, ‘এই কারা এরা? হাতের ব্যাগে কী আছে?'’আমার পেছন থেকে একজন উত্তর দেয়, ‘স্যার, দুইজন বোমা ভাগাভাগি করছিল, হাতেনাতে ধরেছি।’
তারপর একটা ফুলের দোকানের সামান্য আলোতে গিয়ে ব্যাগ খোলে এবং ব্যাগের ভিতরে থাকা ককটেল ও পেট্রোলের বোতলের ভিডিও ধারণ করে। ভিডিও ধারণ করা দেখে কিছুটা স্বস্তি পেয়েছিলাম এই ভেবে—এভাবে ক্রসফায়ারের কাহিনি আগে শুনিনি। এভাবে মূলত নাটক সাজিয়ে আসামিকে অস্ত্র বা গোলাবারুদ রিকভারি দেওয়া হয়।
আমার ক্ষেত্রেও তাই হয়। পরের দিন আদালতে উঠিয়ে রিমান্ড চাওয়ার সময় জানতে পারি, গতরাতে নাকি শাহবাগ থেকে আমাকে ১০টা ককটেল আর ১২টা পেট্রোলবোমাসহ হাতেনাতে গ্রেপ্তার করেছে! আদালত ২ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে পুনরায় ডিবি কার্যালয়ে পাঠায়।
কোর্টের এজলাসে দাঁড়িয়ে আদালতে থাকা উর্মি আপুর ফোন দিয়ে বাড়িতে ফোন করি। আমার কণ্ঠ শুনেই আম্মা ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে। ‘আম্মা, আমি মাছুম’—আর কোনো কথা বলতে পারিনি।
চকবাজার থানাসহ ঢাকার প্রায় সব থানা এবং পুলিশ ফাঁড়িতেই নাকি আমার খোঁজ করেছিল ছোট ভাই নাহিদ আর বিজয়। কিন্তু কেউ আমার গ্রেপ্তার স্বীকার করেনি। শাহবাগ থানার ডিউটি অফিসার নাকি ধমক দিয়ে বলেছিল, এখন আওয়ামী লীগ ধরলে কাউকে জীবিত ছাড়ে না। ঢাকা মেডিকেলের মর্গে কয়েকটা বেওয়ারিশ লাশ আছে, সেখানে গিয়ে খুঁজে দেখেন।
আদালত থেকে ডিবিতে রিমান্ডে নিয়ে যাওয়ার সময় পুলিশ ভ্যানে বসে বসে ভাবছিলাম—আহারে জীবন! কত অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে গেল গত তিনটা দিন। কত কষ্ট পেয়েছে আমার পরিবার আর স্বজনরা, হাসিনা আমার জন্য দেশটাকে পুরোপুরি নরকে পরিণত করেছে। ৬/৭ মাস পরে নিশ্চয়ই জামিনে বের হব, কিন্তু এই দেশে হাসিনা আর শান্তিতে বাঁচতে দিবে না আমাকে।
৫ আগস্ট, কেন্দ্রীয় কারাগারে মেঘনা বিল্ডিংয়ের ৩/২ নম্বর রুমে দুপুর তিনটার কিছু পরে, হাসিনার পতনের সংবাদ পাই। তখন আমার শরীরে ভয়ংকর জ্বর। চোখ মেলে তাকানোরও শক্তি নেই। সবাই থালাবাসন বাজিয়ে উল্লাস করছিল। আমার চোখে ছিল আনন্দের অশ্রু। মনে মনে ভাবছিলাম আজ থেকে মাতৃভূমি আমাদের জন্য নিরাপদ।
এখন প্রায় ১ বছর, স্বৈরাচারের পতন হয়েছে। হাসিনা পালিয়ে গেছে, গণভবন জনতা দখল করে রাষ্ট্রের মালিকানা বুঝে নিয়েছে। রাস্তাঘাটে চলতে এখন আর গ্রেফতার বা হামলার ভয়ে বুক কাঁপে না। কিন্তু তিন দিন গুম থাকা অবস্থায় জমাট বাঁধা ট্রমা থেকে এখনও বের হতে পারিনি। প্রায়ই ঘুম থেকে চিৎকার করে লাফিয়ে উঠি, স্বপ্নে দেখি—চোখ আর হাত বাঁধা অবস্থায় আমাকে ক্রসফায়ার দিতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
বাসস: যে বাংলাদেশের স্বপ্ন নিয়ে ২ হাজারের বেশি মানুষ শহীদ হয়েছে এবং আপনিও মৃত্যুকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন, বর্তমান বাংলাদেশ কি সেই পথে আছে?
মাছুম বিল্লাহ: দেখুন, সাধারণ শিক্ষার্থীদের কোটা বাতিলের আন্দোলন পুরোপুরি সফল হয়েছে। বর্তমানে দেশ চালাচ্ছে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। প্রায় দেড় যুগ ধরে দেশের মানুষ তাদের ভোটের অধিকার থেকে বঞ্চিত। এই অবস্থায় আমার মনে হয়, একটি অবাধ, সুষ্ঠু এবং গ্রহণযোগ্য জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনের মাধ্যমে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা জরুরি। তাহলে নির্বাচিত সরকার গণমানুষের আকাঙ্ক্ষা ধারণ করে বাংলাদেশকে বিশ্বদরবারে একটি মর্যাদাশীল জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারবে।